এবারের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল গণিতের নিয়মেই প্রত্যাশিত। তৃণমূল ৩০% মুসলিম ভোট, ৬৫% মহিলা ভোটের ‘এডভান্টেজ’ নিয়ে খেলা শুরু করে। এমন খেলাত শুরুর আগেই শেষ হওয়ার কথা। আগেরবার লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৪টি সিট পাবে ভেবেছিলাম। কিন্ত ১৮টি পেয়ে যাওয়ায় সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম। আসলে কখনওই ভাবিনি, সিপিএমের সব ভোট বিজেপিতে যাবে! যেটা আমার কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিল।

তবে বিজেপি ৭০টির বেশী সিট পাওয়ায়,  বলতে হবে বিজেপি খুব ভাল ফল করেছে। কারণ, শুধু ১২% অবাঙালী ভোট আর ৩৫% হিন্দু পুরুষ ভোটের ওপর নির্ভর করে খেলা হয় না। এই গণতন্ত্র সবার।

এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে যা শিক্ষনীয়-

(১) কেন্দ্রীয় নেতা ভাড়া করে বড় রাজ্যের নির্বাচন জেতা যায় না। যেখানে বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন রাজনৈতিকভাবে একজন শক্তিশালী স্থানীয় নেত্রী রয়েছেন।

(২) স্থানীয় নেতাদের ওপর অন্যদল থেকে আনা দুর্নীতিপরায়ণ নেতা চাপানো যায় না। বিজেপির অনেক কর্মীই বসে গেছিল। আমি মার্চ মাসে বাংলায় ছিলাম। তখন দেখেছিলাম শুধু তৃণমূলেরই মিটিং, মিছিল আর হোর্ডিং। এমন কী বিজেপির একটাও দেওয়াল লিখন, মিছিল চোখে আসেনি। কারণ, বিজেপির অন্তর্দন্দ্ব। আমি দেখেছি তৃণমূল যেখানে একটি ‘সিঙ্গল পার্টি’ হিসাবে কাজ করছে। সেখানে বিজেপির মধ্যে শুধুই খেয়োখেয়ি ছিল। শুধু মিডিয়াকে পয়সা দিয়ে, বিড়ালকে বাঘ করে দেখালেই ভোটে জেতা যায় না।

(৩) বিজেপি সংখ্যার বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে না। ২০১৯ সালের ভোটের হিসেব খুব পরিষ্কার ছিল। সিপিএমের সমর্থকরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। বামেরা রাতারাতি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এর মানে ছিল-সিপিএম মমতা বিরোধী হিসেবে ভোট দিচ্ছে। টিমসি’র বিরোধিতার জায়গা থেকে ভোট দিচ্ছিল। সেই ক্ষেত্রে তৃণমূলের নেতাদের দলে নিয়ে আগেই আত্মহত্যা করেছিল বিজেপি। আমি স্থানীয় অনেক সিপিএম সমর্থকের সাথে কথা বলেছি। তারা সত্যিই হতাশ ছিল। যখন দেখেছে যেসব তৃণমূল নেতাদের জন্য বিজেপিকে তারা ভোট দিচ্ছিল, তারাই বিজেপিতে- তখন তারা আশাহত হয়। প্রশান্ত কিশোর হলে সিপিএমের স্থানীয় নেতাদের ভাঙিয়ে বিজেপিতে তুলত।  বিজেপি সেটা করেনি। উল্টে তৃণমূলের দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের নিয়েছে। পুরোপুরি গোড়ায় গলদ।

(৪) মুখ্যমন্ত্রীর মুখ না তৈরী করে নির্বাচনে যাওয়া মানে, আরও অনেক পিছিয়ে থেকে খেলা শুরু করা।

রাজনীতিতে আরেকটা ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন আসতে চলেছে। ওই শিল্প, চাকরি, কৃষির দাবিতে আর ভোট হবে না। ভোট হবে কোন দল গরীব জনগণের কাছে চাল, ডাল থেকে স্বাস্থ্য পৌঁছে দিচ্ছে- এই ইস্যুতে। কিন্ত বাজেট লিমিটেড। সুতরাং সরকারি চাকরির স্কোপ কমবে।

যাই হোক, বিজেপি বাংলায় এখন অফিশিয়ালি বিরোধী দল। কংগ্রেস, সিপিএমের অস্তিত্ব থাকল না। যেটা বাংলার জন্য ভাল। কারণ, দুটো দলই পচে গেছে।

কিন্ত বাংলায় একটা ভাল নতুন ধারার বামদল দরকার। কোনও সিপিএম, সিপিয়াই, সিপিয়াইএমল, সুসিদের দিয়ে হবে না। এদের না আছে আইডিয়া, না আছে নেতা। বাংলার লিব্যারাল বামেদের একটা নতুন পার্টি দরকার। যা ওই খুনী লেনিন স্টালিনের আদর্শ না, বাংলার মাটির বামপন্থার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য- যে ঐতিহ্য শ্রী চৈতন্য- বিবেকানন্দ- লালন ফকির-এম এন রায়- নজরুলরা তৈরী করে গেছেন-তার ভিত্তিতে তৈরী হবে। যদি এরকম কোনও নতুন বামদল তৈরী হয়, তবেই বাংলায় নতুন বামেদের ভবিষ্যত আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের খুনীদের মূর্তি তৈরী করে বাংলার বামপন্থা আর চলবে না। কারণ, ওইসব ঐতিহাসিক ঢপবাজি বহুদিন আগেই এক্সপোজড। পরিবেশ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ, কমিউনিটি শিক্ষা, কমিউনিটি স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন ধারার বামপন্থী দল না এলে, ২০-৩০% স্বাভাবিক বামভোট কোনও বাম দলই পাবে না।

কেন এই নতুন ধরনের বাংলা বাম দরকার? কারণ, এটা না হলে বিজেপি বাংলায় প্রধান বিরোধী দল থেকে যাবে। বামেদের যদি বিরোধীদের আসনে আবার আসতে হয়, তাদের পরিবেশ, বিজ্ঞান, কমিউনিটি শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন একবিংশ শতাব্দীর বাম আন্দোলন শুরু করতে হবে।

ভারতের রাজনীতিও নতুন মোড় নিতে চলেছে। এটা পরিষ্কার, বিজেপির সবচাইতে বড় সম্পদ কংগ্রেস। বিরোধী রাজনীতিতে কংগ্রেস পরিষ্কারভাবেই লায়াবিলিটি। খুব সম্ভবত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সব রিজিওনাল নেতারা একজোট হবেন। সিপিএম’ও হবে। কারণ, বঙ্গের সিপিএম-এর আর কিছু নেই। কংগ্রেস মমতার নেতৃত্ব মেনে যদি লোকসভা নির্বাচনে যায় তবেই ভাল। রিজিওনাল নেতারা একজোট হতে বাধ্য। কারণ, তা না হলে ভারতে ফেডারালিজমের বারোটা আরও বাজবে। এবং বিজেপিকে কেন্দ্রে না থামাতে পারলে কেউ রাজ্যে বেশীদিন সুরক্ষিত না। তবে সব বিরোধী নেতাদের রাজী হতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ করেই তারা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে যাবেন। কারণ, কোভিড সেই সুযোগ দিয়েছে। এটা ঐতিহাসিক চাপ। যে দল শুনবে না, তারা লোকসভায় উড়ে যাবে।

রাজনীতিতে আরেকটা ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন আসতে চলেছে। ওই শিল্প, চাকরি, কৃষির দাবিতে আর ভোট হবে না। ভোট হবে কোন দল গরীব জনগণের কাছে চাল, ডাল থেকে স্বাস্থ্য পৌঁছে দিচ্ছে- এই ইস্যুতে। কিন্ত বাজেট লিমিটেড। সুতরাং সরকারি চাকরির স্কোপ কমবে।