এই একটি দিন ঘিরেই যত উন্মাদনা। দেবী পুজোর মতোই। উদযাপন। উৎসব। আর সারা বছর জুড়ে নারীদের ওপর নির্যাতন, অসম্মান, শবরীমালা। এযাবৎকালে নারীর ওপর অত্যাচারের, নৃশংসতার সব সীমা পার হয়ে গেছে। একদিন কিংবা পাঁচদিনের স্তুতিগানে, সেলিব্রেশনে, সেমিনার, ওয়েবিনার, আরাধনায় আমরা মেয়েরা কতটুকু সম্মান অর্জন করি? কতটুকু বন্দনা আমাদের নিয়ে হয়? তা দিয়ে কি রোজের অসম্মান, বৈষম্য, নির্যাতন সয়ে নেওয়া যায়? কোটিখানেক দেবীমূর্তির জয়গান, আরতি, জয় মাতা দি… বছর জুড়ে… বছর জুড়েই হাতরাস, পার্ক স্ট্রিট, উন্নাও, কামদুনি, কাঠুয়া। কি প্রয়োজন আমাদের এমন দিনের? যে সমাজে এতখানি বৈপরীত্য সে সমাজে একটি দিনকে মহিমান্বিত করার প্রয়োজন আছে নাকি?
দরকার ছিল আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস পালনের। যে দিবসের ইতিহাস মেয়েরা অর্জন করেছিল। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যে ইতিহাস স্বীকৃতি দিয়েছিল নারীর শ্রমের। কিন্তু শ্রমজীবী শব্দটিই তো বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেতনে বৈষম্য, আচরণে বৈষম্য, ওই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিককে কিছু একটা পাইয়ে দেওয়ার মতোই যেন নারী দিবস। অর্জন করে পাওয়া দিনটির গুরুত্ব কমিয়ে উৎসব পালনের আয়োজন বজায় রাখা।
স্বামীর থেকে বেশি বেতন পেলে আমাদের লজ্জা করে। মেজো জায়ের ছেলে আর আমার মেয়ে হলে মনটা সামান্য হলেও বিষণ্ণ হয়, বিয়ের পর মেয়ের বাড়ি মানেই পরের বাড়ি হয়ে যায় অচিরেই। তাই তো সরকারকে রোজ ক্যাম্পেন চালাতে হয়। বেটিকে বাঁচাতে হবে, পড়াতে হবে। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি থেকে বাদ পড়ে না কেউই। বেটি হলে টাকা পাবে, সাইকেল পাবে স্কুলে যাওয়ার জন্য… এইসব টোপ দিতে হয় রাজনীতিতে। হাত পেতে এসব ভেট নিতে নিতে পিছিয়ে পড়ি আসলে আমরা। স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা মরে যায়।
আমরা মেয়েরাই বা কতটা দায়িত্ব নিই এই বৈষম্য ঘোচাবার? সাঁলো, মল, অনলাইন বাজারে স্পেশাল গিফট কুপন নিয়ে আমরা মেতে থাকি ফাঁপা উৎসবে। কাগজে পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন, ফরসা হওয়ার ক্রিম, বিয়েতে ভাত-কাপড়- সম্প্রদানের রেওয়াজ, কালো-ফরসা, পাত্রী দেখতে আসা, এমনকি কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, বেটি বাঁচাও- বেটি পড়াও সব কিছুতেই প্রভুত্ব আর নয়তো পাইয়ে দেওয়া। করুণা। ‘থাপ্পড়’ ছবিটার কথা মনে পড়ে? মেয়েটির নিজের ভালোলাগা সরিয়ে রেখে সংসারে আত্মনিবেদনের মধ্যেও ভালোবাসা ছিল ভরপুর কিন্তু স্বামীর রাগের মাথায় তাকে চড় মারার মতো প্রভুত্ব কোন যুক্তিতে সয়ে নেবে মেয়েটি? শান্ত, সুশীলা ঘরের বউটি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। গর্জে ওঠে। শেষ দেখে ছাড়তে চায়।
দুর্বল, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক তুমি। তাই তোমার স্তুতি গাওয়া চলে, মহিমা-বন্দন দিনভর হতেই পারে কিন্তু প্রয়োজন মনে হলে কখনো সখনো বুঝিয়ে দিতে হয় প্রভুত্ব। দেবী আর মানবীর ফারাক করে দেয় এই সমাজ। এই দেশ। দেবী মানেই সে শক্তির আধার আর রোজের মানবী তো অবলা, দুর্বল, পুরুষের চেয়ে খাটো। তাই সমান অধিকার? অল্প কুঁচকে যায় ভ্রু। আমরাও বাদ পড়ি না, এই দুই দুই আচরণ আমরা মেয়েরাও মনে মনে লালন করি। স্বামীর থেকে বেশি বেতন পেলে আমাদের লজ্জা করে। মেজো জায়ের ছেলে আর আমার মেয়ে হলে মনটা সামান্য হলেও বিষণ্ণ হয়, বিয়ের পর মেয়ের বাড়ি মানেই পরের বাড়ি হয়ে যায় অচিরেই। তাই তো সরকারকে রোজ ক্যাম্পেন চালাতে হয়। বেটিকে বাঁচাতে হবে, পড়াতে হবে। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি থেকে বাদ পড়ে না কেউই। বেটি হলে টাকা পাবে, সাইকেল পাবে স্কুলে যাওয়ার জন্য… এইসব টোপ দিতে হয় রাজনীতিতে। হাত পেতে এসব ভেট নিতে নিতে পিছিয়ে পড়ি আসলে আমরা। স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা মরে যায়।
এসবের পরেও আমাদের উত্থান সর্বত্র। পড়াশোনা, খেলা, বিজ্ঞান, কর্মক্ষেত্র, শিল্প, সাহিত্যে সব ক্ষেত্রেই নতুন নতুন দিগন্তে উড়ান দিচ্ছে মেয়েরা নিজের যোগ্যতায়, নিজের অধ্যাবসায়ে ভর করে। তাই বেড়া ভাঙছে, খসে পড়ছে কালজীর্ণ চিন্তাধারা, কূপমন্ডূকতা।
Comments are closed.