পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক মহিলা অ্যাসিড আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। তারকেশ্বরে, কালনায়, তেহট্ট‍ে…। গোটা দেশ-রাজ্য আজ এই ধরণের একাধিক সামাজিক- ক্ষয়িষ্ণু ব্যাধির শিকার, সমাজের উচ্চ থেকে নিম্ন সব পরিবারেই এই ব্যাধি ছিদ্র পেলেই প্রবেশ করছে, কোনও কিছুই একে আটকাতে পারছে না, যা সমাজকে ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।  শিক্ষা মানুষকে আর মূল্যবোধ-সংযম শেখাচ্ছে না, মেহনতি মানুষ অন্য মেহনতি মানুষের দুঃখগুলো আর অনুভব করছে না, সবাই যেন প্রাণহীন শরীরে পরিণত। ভারতবর্ষের অন্য অনেক দুর্ভাগ্যজনক অপরাধের সঙ্গে মেয়েদের উপর অ্যাসিড বাল্ব ছোঁড়া/ অ্যাসিড আক্রমণ ক্রমবর্ধমান প্রতিহিংসা প্রসূত অপরাধ হিসেবে বিশ্ব দরবারে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে! ভারতে ২০১১ তে অ্যাসিড –আক্রমণের সংখ্যা ছিল ৮৩, সেখানে ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ৩৪৯ এ গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কিছু মাস যাবৎ রাজস্থান, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, বিহার, অসম, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্য থেকে যে হারে, একের পর এক অ্যাসিড-আক্রমণের খবর আসছে তাতে দ্রুত এই সংখ্যা আগের সব পরিসংখ্যানকে ছাপিয়ে যাবে, কোনও সন্দেহ নেই।
টানা ১৩ দিন যুদ্ধ করে শেষ হল অ্যাসিড আক্রান্ত তারকেশ্বরের জ্যোৎস্না দাসের জীবন। তেহট্টে প্রাণ দিলেন মুক-বধির মহিলা, ধর্ষণের দোষ ঢাকতে ধর্ষকের অ্যাসিড আক্রমণে ও পুড়িয়ে মারার চেষ্টায় প্রাণ হারালেন শিখা ঘোষ। কালনায় অ্যাসিড আক্রান্তকে গ্রাম ছাড়ার হুমকি। এমন আর কত ঘটনা হয়ত চাপা পড়ে গেছে ভিন্ন উপায়ে।

অ্যাসিড আক্রমণের পর সেই মহিলার চেনা জগতটাই বদলে যায়, বেঁচে থাকা না থাকার মাঝের দূরত্বের অনুভূতিটাও হারিয়ে যায়। আমরা শিক্ষিত হই বা না হই, সহানুভূতি বা তাচ্ছিল্য দিয়ে এই সমস্ত আক্রান্ত মানুষদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করি এবং আক্রমণকারীর উদ্দেশ্যকে সফল করতে সাহায্য করি।

সাধারণত ১৪ থেকে ৩৫ বছরের মহিলাদের উপর এই আক্রমণ বেশি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, প্রেমে ব্যর্থতা বা অসংযত যৌন লালসা ও অন্যান্য কু-প্রস্তাব এই ধরণের অপরাধের কারণ হয়ে থাকে। অ্যাসিড আক্রমণ সাধারণত শরীরের বিভিন্ন অংশকে পুড়িয়ে দেয়, নানা রকম নির্মম ক্ষত সৃষ্টি করে, মুখের শ্রী চলে যায় শুধু নয়, কারও দৃষ্টি শক্তি, কারও বাচন শক্তি, কারও হাত, এমন কি জীবন চলে যায়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এই অপরাধকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, কিন্তু এই অপরাধ হত্যার থেকে কোনও অংশেই কম নৃশংস নয়। অ্যাসিড আক্রান্তদের বেশিরভাগ হাসপাতাল, নার্সিংহোম ভর্তি নিতে চায় না। গ্রামে আক্রান্তদের চিকিৎসার অভাব – আক্রান্তের ক্ষতকে আরও গভীর করে। সঙ্গে মানসিক বিপর্যয়ও মাত্রা ছাড়ায়। এক্ষেত্রে অ্যাসিড আক্রমণের পর সেই মহিলার চেনা জগতটাই বদলে যায়, বেঁচে থাকা না থাকার মাঝের দূরত্বের অনুভূতিটাও হারিয়ে যায়। আমরা শিক্ষিত হই বা না হই, সহানুভূতি বা তাচ্ছিল্য দিয়ে এই সমস্ত আক্রান্ত মানুষদের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করি এবং আক্রমণকারীর উদ্দেশ্যকে সফল করতে সাহায্য করি।
    ২০১৩ সালে জ্যোতি সিং-এর গনধর্ষণ ও হত্যার পর ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৩২৬এ এবং ৩২৬বি ধারায় অ্যাসিড আক্রমণকারীর ১০ বছরের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়। সরকারি নিয়মানুসারে, যে সব দোকানে অ্যাসিড বিক্রির লাইসেন্স থাকে তারাই একমাত্র এর বিক্রি করতে পারে, অন্যথায় ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে তৎপর হয়ে রাজ্য গত বছরই কিছু নিয়ম-নির্দেশিকা প্রকাশ করে।  কিন্তু  তা সত্ত্বেও অ্যাসিড আক্রমণের সংখ্যা কমার বদলে বেড়ে চলেছে। কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ্যাসিড আক্রমণের কথা, থানায় যাওয়ার আগেই চেপে দেওয়ার চেষ্টা হয়, নানা রকম হুমকির সঙ্গে প্রাণনাশের চেষ্টাও বাকি থাকে না,  অনেক জায়গায় পুলিশের অসহযোগিতা থাকে, কোনও এফআইআর নেওয়া হয় না। আর যে সার্বিক ক্ষতি আক্রান্তদের হয়, সেখানে আক্রমণকারীর মাত্র দশ বছর কারাদণ্ড- খুবই সরল সমাধান। হয়ত, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট অ্যাসিড-আক্রমণের মামলাগুলিকে দ্রুত বিচারের জন্য বলছেন। কিন্তু বেঁচে থাকা আক্রান্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তেমন কোনও ব্যবস্থা সরকার করে উঠতে পারছে কি? পারছে কি আইনের প্রয়োগকে কঠোর করতে? যে অসৎ মানুষরা আক্রমণকারীদের সহযোগিতা করছে, তাদের জন্য কি শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে? আর কত বলিদানের অপেক্ষা করতে হবে? এই নির্মম অপরাধ বন্ধ করতে শুধু সরকার নয়, আমাদেরও সব সঙ্কোচ দূরে ঠেলে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনও কি আসেনি?