পয়লা জুলাই ঘটা করে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ডাক্তারপুজো দেখে কেন জানি না সত্যজিৎ রায়ের দেবী-দয়াময়ীর করুণ মুখটাই ভেসে আসছিল।

বাবার চিকিৎসার কারণে, বহুদিন বাদে পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল এবং চিকিৎসকরা কেমন আছেন, তার কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত পেলাম। আশার কথা এই যে এখনও বহু চিকিৎসক আছেন, যাঁরা চিকিৎসক হিসেবে সৎ এবং মানবসেবাকে জীবনের আদর্শ করেছেন।

দুর্ভাগ্য এই যে, এই সব ভাল চিকিৎসকরা যেভাবে সরকারি এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্টের হাতে, রোগীর আত্মীয়দের হাতে নানান ভাবে হেনস্থার শিকার হন পশ্চিমবঙ্গে বা গোটা দেশেই, তাতে পয়লা জুলাই-এর ডাক্তারপুজো অনেকটা সতীদাহের আগে জনগণের ঢাকবাদ্যি-সহ সতীপুজোর সামিল। মানে ধূপধুনো দিয়ে চিকিৎসকদের চিতায় তোলা হচ্ছে- এটাই ‘কুইক সামারি’।

আরও সোজা বাংলায় বললে, যারা সরকারি চিকিৎসক, তাঁদের যদি শাসক দলের সাথে ‘সেটিং’ না থাকে, যতই ভাল চিকিৎসক হোন, আপনাকে যেকোনও ভাগারে পাঠানো হতে পারে! সিপিএমের আমলে সেই সেটিং ছিল পার্টি আনুগত্য- বর্তমানে শুধুই টাকার খেলা। শুনলাম কলকাতায় ফিরতে আজকাল ১৫-২৫ লাখ অব্দি দিতে হচ্ছে! কলকাতা থেকে ট্রান্সফার ঠেকাতেও আজকাল নিলাম হচ্ছে! যদিও এগুলো শোনা কথা-কিন্ত অনেকেই যেহেতু ফিসফাস করে বলছেন, নিশ্চয়ই কিছু না কিছু তো হচ্ছে!

আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক মানে, ম্যানেজমেন্টের সাথে ‘সাথ’ না দিলেই ছুটি! ১১০% ইয়েসম্যান! অন্তরাত্মা বেচে রথে চেপে সেখানে তিনি বেচুবাবু। ডাক্তারবাবুর আত্মার খোলস ছেড়ে যিনি নিজের সেলসম্যান অবতারের সাথেই সারাদিন যুদ্ধরত!

সোজা কথা বর্তমান বাংলায় ডাক্তারবাবু মানে যিনি ওপরতলার চাপ (ম্যানেজমেন্ট) এবং নীচের তলার বাঁশ( পড়ুন- রোগীর আত্মীয়) এবং তার সাথে দিনে অসম্ভব বেশী সংখ্যায় রোগী দেখার চাপে সারাদিনে বাস্পীভূত অবস্থায় থাকেন! অধিকাংশ চিকিৎসকেরা নিজেদের খাওয়া দাওয়া সময় মতন করে উঠতে পারেন না, শরীরের যত্নের জন্য শরীর চর্চা ইত্যাদি তো তাঁদের কাছে অলীক স্বপ্ন!

আর তার মধ্যে নিধিরাম সর্দার হয়ে কোভিড যুদ্ধে টসকে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনাকে না হয় বাদই দিলাম!

এইভাবে চললে কেন ভাল ছেলেমেয়েরা চিকিৎসক হতে আসবে?

আমি দুটো সমাধান অবশ্যই বলব, যা সবার ভালর জন্য দ্রুত চালু করা উচিত- আমেরিকার ধাঁচে ‘সার্জন জেনারেল’ পদ চালু করা, যেখানে চিকিৎসকদের ভোটে একজন চিকিৎসক নেতা নির্বাচিত হবেন, যিনি হবেন রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হর্তাকর্তা। কারন, বর্তমানে যারা রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার শীর্ষে বসেন, তাঁদের একটাই কোয়ালিফিকেশন- তাঁরা শাসক দলের অনুগত! এটা সিপিএমের আমল থেকেই চলছে। এসব বন্ধ করে রাজ্যে চিকিৎসকদের ভোটেই এই নির্বাচন হওয়া উচিত। দরকার হলে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের একজন এবং একজন সার্জন জেনারেল মিলে রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শীর্ষে বসতে পারেন।

রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থার শীর্ষে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা থাকা কাম্য না। এক্কেবারেই না।

বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজমেন্টে এবং ৫১% মালিকানা শুধু চিকিৎসকদের হাতেই থাকা উচিত। ৫১% মালিকানা চিকিৎসকদের হাতে না থাকলে, বেসরকারি হাসপাতালের অনুমতি দেওয়া উচিত না। হাসপাতাল গড়তে ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটাল দরকার। তাদের হাতে ৪৯% থাকুক। কিন্ত ডিসিশন মেকিং-এর বিষয়টি যেন চিকিৎসকদের হাতে থাকে।

আমি বাংলা এবং ভারত ছেড়েছি দুই দশক। আপনাদের ভাল আপনারাই বুঝবেন। তবে যেভাবে চলছে, এভাবে চললে কিন্ত ভাল ছেলেমেয়েরা চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। হয়ত সেটা হচ্ছেও। তাতে আপনাদের সবার ক্ষতি।