হুগলি ও বর্ধমান জেলার ৪৩টি আসনে নির্বাচন হচ্ছে চার পর্যায়ে ১০, ১৭, ২২ ও ২৬শে এপ্রিল। দুই জেলাই সিপিআইএম-এর জমানায় কট্টর বামপন্থী আবার তৃণমূল জমানায় তৃণমূলী। ২০০৪ সালে হুগলির আরামবাগে সিপিআইএম প্রার্থী অনিল বসু পাঁচ লক্ষ সাড়ে বিরানব্বই হাজার ভোটে জিতেছিলেন, সেই বছরে হুগলি, বর্ধমানের সব লোকসভা সিট বামেরা জিতেছিল। ২০০৬ সালের বিধানসভায় শ্রীরামপুর, সিঙ্গুর, কাটোয়া, নাদনঘাট ছাড়া অন্য সব আসন জেতে বামেরা। নিজেদের মধ্যগগনে- ২০১৪ সালের লোকসভায় আসানসোল বাদে সব আসন আর ২০১৬ সালের বিধান সভায় হুগলির ১৮টির মধ্যে ১৬টি এবং পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের মোট ২৫টির মধ্যে ১৯ টি আসন পায় তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৬ সালে বিজেপি হুগলি জেলায় ভোট পায় মাত্র ৩,২২,৩৪০ যা  প্রদত্ত ভোটের ৯.৩ শতাংশ,  তারা বর্ধমানে পায় ৫,৬০,৪০৫ যা ছিল মোট প্রদত্ত ভোটের ১২.২৫ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য ভাবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দুই জেলার ছয়টি আসনের তিনটিতে জেতে এবং আরামবাগে হারে মাত্র ১,১৪২ ভোটে। তৃণমূলের ৬,৪৯,৯২৯টি ভোটের বিপক্ষে বিজেপি পায় ৬,৪৮,৭৮৭টি ভোট। সিপিআইএমের ভাগ্যে জোটে মাত্র এক লক্ষ ভোট, অদৃষ্টের কি পরিহাস!

হুগলি

হুগলি জেলার তিনটি লোকসভা তৈরি হয়েছে জেলার ১৮ টি বিধানসভা আসন নিয়ে। সঙ্গে হাওড়ার ডোমজুর এবং জগৎবল্লভপুর বিধানসভা কেন্দ্র দুটিকে শ্রীরামপুর লোকসভার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা বিধানসভা আসনটিকে যুক্ত করা হয়েছে আরামবাগ লোকসভা কেন্দ্রের সঙ্গে। উল্লেখ্য-পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি লোকসভায় আছে ৭ টি বিধানসভা। নীচে টেবিল ১ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে বিজেপি হুগলিতে সব চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে, ১৫ লক্ষ ৯৩ হাজার, তৃণমূল ১৫ লক্ষ ৫১ হাজার, বাম কংগ্রেস চার লক্ষের কিছু কম।  নীচে টেবিল ২ তে দেখা যাচ্ছে, ১৮ আসনের মধ্যে ১৬ টি আসন পাওয়া তৃণমূল কীভাবে ২০১৯ সালে বিজেপির বশ্যতা স্বীকার করেছে। খানাকুল, আরামবাগ, ধনেখালি, গোঘাট, তারকেশ্বর, সপ্তগ্রাম, হরিপালে তাদের মার্জিন কমেছে ব্যাপকভাবে। বিজেপি এগিয়ে ছিল আটটিতে, তৃণমূল দশটিতে। হুগলির গেরুয়া করণ মোটামুটি সম্পূর্ণ। তৃণমূল ভাঙার দরকার ছিল না, তবু সিঙ্গুরের মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং উত্তরপাড়ার সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল বিজেপি’তে আসায় তৃণমূল আরও দুর্বল হবে। অবশ্য এতে আবার বিজেপির ভেতরের অসন্তোষ বেড়েছে।

টেবিল ১: হুগলির তিন  লোকসভার  জেলার বিধানসভায় চার প্রধান দলের প্রাপ্ত ভোট  ২০১৯

টেবিল ২: হুগলি ২০১৬ আর ২০১৯ সালের তুলনা

বর্ধমান

বর্ধমানের তিনটি লোকসভা-  বর্ধমান পূর্ব, বর্ধমান দুর্গাপুর এবং আসানসোল। জেলার খণ্ডগোষ পড়েছে বিষ্ণুপুর লোকসভায়, আউশগ্রাম, কেতুগ্রাম এবং মঙ্গলকোট মিশেছে বোলপুর লোকসভায়। টেবিল ৩ থেকে স্পষ্ট ২০১৯ সালের নির্বাচনে বর্ধমানে সব চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল বিজেপি কুড়ি লক্ষ চুরাশি হাজার মতো, তারপর তৃণমূল- কুড়ি লক্ষ সাতাত্তর হাজার, সিপিএম পাঁচ এবং কংগ্রেস সোয়া লক্ষ ভোট পেয়েছিল।

টেবিল ৩: বর্ধমান জেলার ২৫ টি আসনে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে দলগত অবস্থান

টেবিল ৪ থেকে পরিষ্কার যে বিজেপি ২০১৬ সালে কোনও দাগ কাটতে পারেনি, তারা ২০১৯ সালে ২৫টির মধ্যে ১১টি আসনে এগিয়ে ছিল, বাকি সব আসনে এগিয়ে থাকে তৃণমূল। এই টেবিলে দেখা যাচ্ছে, পূর্ব বর্ধমানে তৃণমূল আধিপত্য বাড়িয়েছে, সেখানে পালের হাওয়া বাড়াতে বিজেপি পূর্ব বর্ধমানের তৃণমূলের লোকসভার সদস্য সুনীল মণ্ডলকে নিজেদের ঘরে তুলেছে। তৃণমূলের যে কোনও বিধায়ক ‘স্বাগত’ বিজেপি এই নীতি গ্রহণ করে। পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক এবং আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তেওয়ারীর বিজেপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ করায় অনেক তাবড়তাবড় বিজেপি নেতা-নেত্রীকে শোকজের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই দুই জেলার ৪৩টি আসনের মধ্যে থেকে ৩০-৩৫টি নিজেদের ঘরে তুলতে চান, আগের প্রতিবেদনে (হাওড়া, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া নিয়ে সমীক্ষায়) লিখেছিলাম বিজেপি ওই জেলাগুলির ৭২ টি আসনের ৫৫-৬৫ আসন পেতে চায়। পূর্বতন এই ছয় জেলা ( বর্তমানে নয় ) থেকে ৯০-১০০ টি আসনের টার্গেট রেখেছে। এই টার্গেট পূরণ করতে পারলে বিজেপির বঙ্গ বিজয় চূড়ান্ত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা সুকৌশলে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে মেদিনীপুরে ব্যস্ত রেখেছিল। তৃণমূলের সব এনার্জি চলে গেছে মেদিনীপুরে। কারণ, নন্দীগ্রামে দিদির বিপর্যয় হলে দলের হালহকিকত পাল্টে যেতে পারে ।

টেবিল ৪: ২০১৬ আর ২০১৯ নির্বাচনে প্রথম দল আর এগিয়ে থাকার ব্যবধান

সূত্র: নির্বাচন কমিশন

বামেদের কী হবে ?

২০১৬ সালে সিপিএম ৫ টি আসন আর কংগ্রেস ১ টি আসনে এগিয়ে থাকলেও ২০১৯ সালে তাদের বিজয় রথ আর দেখা যায়নি। চলতি বিধানসভা নির্বাচনে তারা বেশ কিছু সুশিক্ষিত মার্জিত রুচির তাজা ছেলে মেয়েদের নামিয়েছে। মানুষ এখন চায় চাকুরী, ভালো মজুরি, যা নতুন  শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। কেন্দ্রের সঙ্গে ইগোর লড়াইতে জড়িয়ে থাকা দলগুলি নতুন বিনিয়োগ টানতে পারবে না। যে সমস্ত বামপন্থী বিজেপির দিকে এগিয়েছিল, তারা কেউ কেউ ফিরলেও, হিন্দু কমরেডরা আব্বাসের অন্তর্ভুক্তিতে বীতশ্রদ্ধ।  নন্দীগ্রামে মুসলিম ভোট যাতে ভাগ না হয় তার জন্য ব্রাহ্মণ প্রার্থী দেওয়াতে বামপন্থীদের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ।

দুই  জেলার সংখ্যালঘু ভোট

হুগলি জেলায় সংখ্যালঘু মুসলিম ভোট মাত্র ১৫.৭৭ শতাংশ। ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া, পোলবাদাদপুর, হরিপাল, জাঙ্গিপাড়া, চণ্ডিতলা ১, চণ্ডিতলা ২ ও আরামবাগের ব্লকগুলিতে এই শতাংশের সামান্য কিছু বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মালম্বী। সংখ্যালঘু ভোট বা  মেরুকরণ কোনওটাই এই নির্বাচনে হুগলি জেলায় তেমন প্রভাব ফেলবে না। বর্ধমানে মুসলিম ভোটের প্রভাব আছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বর্ধমান জেলায় মুসলিম ভোটার ২০.৭৩% । ২০০১ সালের সেনসাস অনুযায়ী কেতুগ্রাম ১ (৪৪.৫%), মনতেশ্বরে (৩৯.০৩%),মঙ্গলকোট (৩৩.২%),খন্ডগোষ (৩২.১ %), পূর্বস্থলী ২ (২৯.৬%), কাটোয়া (২৭.৮ %), কালনা ১ (২৭.৪%) ব্লকগুলি মুসলিম অধ্যুষিত। আব্বাসের দল মুসলিম জাতিসত্ত্বা জাগিয়ে তোলার সেই চেষ্টা করেনি, ফলে তাদের ভোট তৃণমূলেই যাচ্ছে, অল্প বিস্তর এদিক ওদিক হতে পারে ।

বিজেপির বিজয় পথের অন্তরায়

এই নির্বাচনে বিজেপির প্রধান শত্রু বিজেপি নিজেই। বিজেপির প্রার্থী তালিকা চয়ন নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ বিক্ষোভ আছে। দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া কর্মী দরদীরা স্থান পেল না, যারা কিছু দিন আগেও বিজেপি বিরোধী কথা বলেছে, এমনকি কর্মীদের মারধরে জড়িত তারা বিজেপির টিকিট পেল। নির্বাচিত প্রার্থীরা বিজেপির মতাদর্শ নিয়ে কতটা সচেতন তাতেও সন্দেহ আছে। ক্ষমতা পেলে কে কী করে বসবেন তাও অজানা। বিজেপির ঘোষিত তালিকায় এমন অনেক ব্যক্তির নাম রয়েছে যাদের কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই, অন্য কৃতিত্বের পরিচয়ও অজ্ঞাত। কী জাদুবলে তারা টিকিট পেয়েছেন তা নিয়ে জল্পনার অবকাশ নেই। এসব ভবিষ্যতে বিজেপিকে ভোগাতে পারে, তবে এই মুহূর্তে মানুষ তৃণমূলের বিকল্পের সন্ধানে, ২০১৯ সাল থেকে তারা বিজেপিকে বিকল্প হিসাবে দেখতে শুরু করেছে, প্রার্থী নিয়ে দুঃখ যন্ত্রণা থাকলেও এই মুহূর্তে মানুষের বিকল্প নেই।