এবারের বিধানসভা ভোটের প্রথম ছয় দফায় ভোটগ্রহণ চলাকালীন পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে চারজন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে, একজন বিপক্ষ দলের দুষ্কৃতীদের গুলিতে। এই নিয়ে তরজা অব্যাহত। কিন্তু বাংলার শিক্ষিত, সুশীল সমাজে প্রশ্ন ওঠে না, অন্যান্য সব প্রদেশে ভোটে রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ হয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গে কেন আজও তা জাঁকিয়ে বসে আছে। প্রত্যেকটা ভোটে, পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পৌরসভা, বিধানসভা, লোকসভা কোনও ভোটে অশান্তি নেই, মৃত্যু নেই এমন অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গবাসীর নেই। সপ্তদশ লোকসভা্র চতুর্থ দফার ভোটের পরদিন(৩০ এপ্রিল ২০১৯)‘এই সময়’ সংবাদপত্রের হেডলাইন ছিল -‘যত গরম বাংলায়’।
টিভিতে রাজ্যে রাজ্যে ভোট গ্রহণের ছবির সঙ্গে যখন পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা মিলিয়ে দেখি তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। একমাত্র জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া দেশের আর কোথাও বোধহয় এত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয় না। এতগুলো পর্বে ভোটও হয় না। পর্যবেক্ষক হিসাবে একাধিক রাজ্যের ভোট প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। পাঠকের সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতাটা ভাগ করে নিতে চাই। তার আগে কীভাবে ভারতবর্ষে নির্বিঘ্নে প্রক্রিয়াটা চালু হল তার ইতিহাসটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
১৯৯০ সালে টি এন শেষন ভারতের নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বভার গ্রহণের আগে কমিশনকে সাধারণ মানুষ কাগুজে বাঘ হিসাবেই জানত। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা আর ভোট প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে বিজয়ী প্রার্থীদের লিস্ট বের করা। ভোটে ব্যাপক রিগিং আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিলাম ১৯৭২ সালে, রাজ্যের বর্তমান প্রজন্মের কাছে যা অনেকটাই অজানা। সেবার বিধানসভা নির্বাচনে আমার মা ভোট দিতে পারেননি। তারপর ১৯৭৭ সাল থেকে বছর দশেক মোটামুটি একটা সুস্থ অবস্থা চললেও, আশির দশকের শেষ থেকেই পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি আবার খারাপ হতে শুরু করে। বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ভোটারকে ভয় দেখানো এটা শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, ভারতের বহু রাজ্যেই নির্বাচনের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
শেষন গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অন্য রাজ্য থেকে অফিসার এনে ভোটের তদারকি (পোশাকি নাম ‘পর্যবেক্ষক’, যা ১৯৯৬ সালে জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ সংশোধনের মাধ্যমে আইনি মান্যতা পায়),ভোটে কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর সার্থক ব্যবহার, উপযুক্তভাবে মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট প্রয়োগ এবং সর্বোপরি রাজ্যস্তরের প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া যে নির্বাচন ঘোষণার পর মুহূর্ত থেকে তারা প্রকৃত অর্থেই কমিশনের আজ্ঞাবহ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নন। এই কাজে কমিশনের চোখ এবং কান হিসাবে কাজ করে কমিশন নিযুক্ত পর্যবেক্ষকগণ। তাই তারা এত গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বদা রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং সর্বোপরি জনসাধারণের স্ক্রুটিনির মধ্যে থাকেন।
প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশী সম্পাদিত ‘দি গ্রেট মার্চ অফ ডেমোক্রেসিঃ সেভেন ডিকেডস অফ ইন্ডিয়া’স ইলেকশন’ গ্রন্থে রাজনৈতিক ভাষ্যকার ক্রিস্তফ জাখলু (Christophe Jaffrelot) তাঁর লেখা ‘টি এন শেষন এন্ড দি ইলেকশন কমিশন’ প্রবন্ধে লিখেছেন উত্তরপ্রদেশে শেষন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩- মাত্র এই দুই বছরে বুথ দখলের সংখ্যা ৮৭৩ থেকে কমিয়ে ২৫৫ এবং নির্বাচনের দিন মারামারিতে প্রাণহানির ঘটনা ৩৬ থেকে মাত্র ৩ নামিয়ে এনেছিলেন।১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোট প্রক্রিয়া শুরুর পর ৩ লক্ষ গুন্ডা-মাস্তানকে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশনে নেওয়া হয়, যার মধ্যে শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে ছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার এবং ৫৯ হাজার। শেষন আসার আগে,ভোট প্রক্রিয়া যে মাঝপথে স্থগিত রাখা যায় বা উপযুক্ত নিরাপত্তার কারণে ভোটগ্রহণ পিছিয়ে দেওয়া যায়, এমন কথা কেউ শোনেনি। কিন্তু শেষন এইসব অর্ডার চোখের পলক ফেলার আগে বের করে দিতেন। ফলে দেশের অধিকাংশ রাজ্যে আজ ভোট ঘটনাবিহীন।
শেষন গৃহীত পদক্ষেপগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অন্য রাজ্য থেকে অফিসার এনে ভোটের তদারকি (পোশাকি নাম ‘পর্যবেক্ষক’, যা ১৯৯৬ সালে জনপ্রতিনিধি আইন, ১৯৫১ সংশোধনের মাধ্যমে আইনি মান্যতা পায়),ভোটে কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনীর সার্থক ব্যবহার, উপযুক্তভাবে মডেল কোড অফ কন্ডাক্ট প্রয়োগ এবং সর্বোপরি রাজ্যস্তরের প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া যে নির্বাচন ঘোষণার পর মুহূর্ত থেকে তারা প্রকৃত অর্থেই কমিশনের আজ্ঞাবহ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নন। এই কাজে কমিশনের চোখ এবং কান হিসাবে কাজ করে কমিশন নিযুক্ত পর্যবেক্ষকগণ। তাই তারা এত গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বদা রাজনৈতিক দল, মিডিয়া এবং সর্বোপরি জনসাধারণের স্ক্রুটিনির মধ্যে থাকেন।
এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়া উচিত নয় যে সুষ্ঠু ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একেক রাজ্যে একেক রকম সমস্যা পর্যবেক্ষকদের সামাল দিতে হয়। যেমন, ভারতের বহু রাজ্যের স্থান বিশেষে উচ্চ বা মধ্য বর্ণের লোকেরা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষজনকে ভোট দিতে বাধা দেয় । এখানে যে রকম শাসক দলের লোকেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা বিরোধী দলের সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দিচ্ছেন, তেমনই যেখানে জাতপাতের দ্বন্দ্ব প্রকট, সেখানে উচ্চ বা মধ্যবর্ণের লোকেরা দলিত সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা সৃষ্টি করেন।সুতরাং,পশ্চিমবঙ্গে যেখানে সকলে যাতে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন সেটা পর্যবেক্ষককে দেখতে হয়, অন্যখানে হয়তো নিম্নবর্গের মানুষদের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করাটা চ্যালেঞ্জ। আবার উত্তর পূর্বাঞ্চলে সামলাতে হয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে হাঙ্গামা। জম্মু-কাশ্মীরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে ভোটদাতা, ভোটকর্মী এবং নিজের প্রাণরক্ষা করাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
জম্মু-কাশ্মীরের পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ আলাদা করে ব্রিফিং করে। জেড ক্যাটেগরি সিকিউরিটি নিয়ে সেখানে পর্যবেক্ষকদের কাজ করতে হয়। আমি কাঠুয়া পৌঁছে টিভিতে দেখলাম মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে জঙ্গি হামলা হয়েছে(২৬ নভেম্বর ২০০৮)। উপদ্রুত অঞ্চলে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হয়, তা জেনেছিলাম সেখানকার তরুণ এসপির কাছে। আমার দায়িত্ব ছিল কাঠুয়া জেলার অন্তর্গত বানি বিধানসভা কেন্দ্র। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বানি কোনওদিনই জঙ্গি উপদ্রুত অঞ্চল ছিল না কিন্তু পাশে উধমপুর আর মাথার উপরে ডোডা জেলা দুটি এক সময় ছিল জঙ্গিদের মুক্তাঞ্চল। মাঝ রাস্তায় একবার আমার সিকিউরিটি হিসাবে থাকা সিআরপিএফদের জিপের চাকা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেটা সারানোর সময় আমার লিয়াজঁ অফিসারের কপালে ডিসেম্বর মাসেও ঘাম দেখা যাচ্ছিল। বারবার বলছিলেন, স্যার ইহা পর আতঙ্কবাদীওনে পাহাড় সে পুলিশকা উপর গ্রেনেড অ্যাটাক কিয়া।
পর্যবেক্ষক হিসাবে সেখানে আমাদের কাজ ছিল ভোটারদের সঙ্গে দেখা করে বোঝা ভোট দিতে তারা আগ্রহী না অনাগ্রহী। আগ্রহী ভোটারদের ভয় থাকলে সেটা জেলা প্রশাসনকে জানানো যাতে তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন।অনাগ্রহী হলে কোনরকম জোর করা চলবে না, এটা নির্বাচন কমিশন আমাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন। অনাগ্রহী ভোটারের দেখাও কম গ্রামেই পেয়েছি। এরকম গ্রামে সাধারণতঃ ভোটাররা উদাসীনভাবেই জবাব দেন। তবে, শেষ পর্যন্ত বানিতে সেবার ভোট পড়েছিল ৭৬.১৫ শতাংশ।
উত্তরপ্রদেশের ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটে সিকান্দ্রাবাদ কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সিকান্দ্রাবাদে ২০ শতাংশের উপর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। মুসলিম ধর্মাবলম্বীও ২০ শতাংশের উপরে। জেলার ‘ভালনারেবিলিটি ম্যাপিং’ রিপোর্ট অনুসারে বেশ কিছু সংখ্যক পোলিং বুথ ভালনারেবল, অর্থাৎ, সংবেদনশীল ছিল। গত কয়েক বছরে সেখানে বেশ কিছু মানুষ খুন হয়েছেন। কিন্তু ভোট নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি, যেহেতু খুনোখুনির মূল কারণটা ছিল জমিজমা বা আত্মাভিমান সংক্রান্ত ব্যাপার ঘটিত।
২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর সরকার ছিল, তাই দলিত মহল্লায় শঙ্কা ছিল না। তবে গুজ্জর সম্প্রদায়ের সঙ্গে দলিতদের একটা টক্কর চলত। জেলা প্রশাসন সেটা জানত এবং যাতে কোনও গন্ডগোল না হয় তার ব্যবস্থাও করেছিলেন। ফলে ভোট হয়েছিল নির্বিঘ্নে। তবে শেষমেশ এই কেন্দ্রে লড়াইটা হয়েছিল হাড্ডাহাড্ডি। বিজেপি প্রার্থী মাত্র ১২৩ ভোটে বিএসপি প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর জন্য রিটার্নিং অফিসার বা গণনা কর্মীদের বিরুদ্ধে কেউ পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ জানায়নি। বিএসপি প্রার্থী পুনর্গণনার জন্য আবেদন করেননি। হৃদ্যতার সঙ্গে ভোটের পর সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। একেই বলা যায় আদর্শ গণতন্ত্রের নির্মল প্রকাশ।
২০১১ সালে অসম বিধানসভার ভোটে আমার দায়িত্ব ছিল জোনাই কেন্দ্রে। ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে একেবারে অরুণাচল সীমান্তে ধেমাজি জেলার একটি মহকুমা জোনাই। এই নির্বাচন কেন্দ্রের প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোটার মিসিং সম্প্রদায়ভুক্ত আর বাকি ৩৫ শতাংশের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিল বোড়ো সম্প্রদায়ের মানুষ। বাকিদের মধ্যে রয়েছে অন্যান্য জনজাতি যেমন হাজং, দেউরি এবং বাঙলা ভাষাভাষী মানুষ (হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্মের)। এখানে লড়ছিলেন মিসিং সম্প্রদায়ের পার্টি (অসম গণশক্তি পার্টি) তাই তারা চাইছিলেন তাদের প্রার্থীই জিতুন। অন্যদিকে বোড়োরা এখানে মোটামুটিভাবে কংগ্রেসের সমর্থক। সে কারণে মিসিং ও বোড়োদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা রয়েছে তা জোনাইয়ে পা দিয়ে এক-দুদিনেই মালুম হয়ে গেছিল। ফলে আমার কাজ ছিল এসডিও-র সঙ্গে বসে যেসব অঞ্চলে বোড়ো এবং মিসিং উভয় সম্প্রদায়ের বাস, সেইসব ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে সেখানকার বুথে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। ভোট শেষে, দু-তরফেই ভোট গ্রহণে সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কোথাও রিপোল করতে হয়নি।
সবচেয়ে আরামে পর্যবেক্ষকের কাজ করেছি ২০০৯ সালে কর্ণাটকের হাভেরি লোকসভা কেন্দ্রে। হাভেরি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে গদগ জেলার খানিকটা অংশ পড়ে। দুটি জেলাতেই ব্যবস্থা এতটাই নিঁখুত ছিল যে কোনও ব্যাপারেই আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার পড়েনি। হাভেরি শহরে বা গ্রামাঞ্চলে ভোটের প্রচার সামান্যই চোখে পড়েছিল। মারামারি, অভিযোগ, পালটা অভিযোগের কোনও বালাই নেই। কত শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের উৎসব হতে পারে, তার মাপকাঠি বোধহয় ভোটকর্মীদের মধ্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ। এক-দেড় বছরের শিশুকে নিয়ে মহিলারা দূর-দূরান্তে নির্ভয়ে ভোট করতে যাচ্ছেন, বাচ্চাকে দেখার জন্য সঙ্গে শাশুড়ি বা ননদ। ভোটের সরঞ্জাম বিতরণ কেন্দ্রে এই দৃশ্য দেখে কি আনন্দ যে হয়েছিল বলার নয়।
টিভি দেখি আর দুঃখ হয়, কবে আমাদের রাজ্যে গণতন্ত্রের এমন উৎসব হবে।
( লেখক বিভিন্ন লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে একাধিক রাজ্যে সাধারণ পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন।)
Comments are closed.