রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ নাটকে ত্রিপুরারাজ গোবিন্দমাণিক্যের হাহাকার ছিল- ‘এত রক্ত কেন?’ পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তস্নাত পশ্চিমবঙ্গে এই হাহাকার শতগুণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সারাদেশে অনিবার্য হয়েছে এই প্রশ্ন- নির্বাচনের মতো এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কেন এই রক্তস্নান!
অস্বীকার করার উপায় নেই যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো এক গণতান্ত্রিক নির্বাচনে রক্তপাতের কোনও স্থান নেই। একথা ঠিক যে, অন্যান্য রাজ্যের বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক নিয়েই সব দল নির্বাচনে সামিল হয়। আর দল থাকলেই দলীয় কোন্দল অনিবার্য। কিন্তু সে কোন্দল তো দলীয় নীতি বা কর্মসূচী নিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে এই তাণ্ডব কিংবা সন্ত্রাস ও পরিণামে রক্তপাত কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর যাই হোক না কেন, ঘটনা হল পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠেলায় সারা রাজ্য এখন রক্তরঞ্জিত। বস্তুত নির্বিচারে হিংসা এবং সন্ত্রাসের তান্ডবলীলা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রতীক চিহ্ন হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের দিনে নিহতের সংখ্যা ১৫ ছাড়িয়েছে (যদিও সোমবার সন্ধ্যায় রাজ্য পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ছ’জনের, বাকি মৃত্যুর সঙ্গে নির্বাচনের কোনও যোগ নেই!)। মনোনয়ন পর্ব ধরলে নিহত হয়েছে অন্তত ৩৫জন। আহতের সংখ্যা আরও বহুগুণ বেশি (বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত আসনে জয় শাসকদল আগে থেকে ‘সুনিশ্চিত’ না করলে নির্বাচনের দিন হয়তো আরও রক্ত ঝড়তো!)। কিন্তু শুধু আহত নিহতের সংখ্যা দিয়ে সর্বব্যাপী এই সন্ত্রাসের আসল চেহারা উন্মোচিত হওয়ার নয়। মনোনয়ন দিতে বাধা, লাগাতার হুমকি, বাইকবাহিনীর দাপট, বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, শেষে হিসাব-নিকাশের ধমকি আর নির্বাচন কমিশন ও রাজ্যপুলিশের চরম নিষ্ক্রিয়তা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের বৈশিষ্ট। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কথা তুলে লাভ নেই, কারণ অইনের ফেরে এবং শাসকের কূটকৌশলে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োজিত হতে পারেনি। তাই গোটা নির্বাচন পর্ব জুড়ে প্রকাশ্যে ও চাপা সন্ত্রাস অব্যাহত থেকেছে। তারই জেরে রাজ্য জুড়ে বহমান রক্তস্রোত অনিবার্য হয়েছে।
সন্ত্রাস এতটা প্রবল যে ভোট পরবর্তী সময়েও গা-জোয়ারী, অপহরণ, খুনোখুনি সমানে চলবে তা অনুমান করাই যায়।
একথা বলার অর্থ এই নয় যে আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রকাশ্য ও চাপা সন্ত্রাসের কোনও কমতি ছিল। কিন্তু সেখানেও প্রকাশ্য জনসভায় বিরোধীদের ঘর ভেঙে দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ বা পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দিতে কোনও অনুব্রত মণ্ডল, আরাবুল ইসলামদের দেখা মেলেনি বা রাজ্যের কোনও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে প্রকাশ্য জনসভায় দাঁড়িয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার জন্য ‘পুরষ্কার’ ঘোষণা করতে শোনা যায়নি। এই সব ঘটনা এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘বেপরোয়া’ সন্ত্রাসের চেহারাকে উন্মোচিত করে রাজ্যব্যাপী রক্তস্নানের উৎসকে চিহ্নিত করে দিচ্ছে। আসলে এর ফলেই এবারের নির্বাচনী সন্ত্রাস নতুন মাত্রা অর্জন করেছে এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ক্ষেত্রেও রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নজির সৃষ্টি করেছে!
অনেকেই এই সন্ত্রাসের জন্য একদফা নির্বাচনকে দায়ী করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে গত পঞ্চায়েত নির্বাচন বহু তর্ক-বিতর্কর পর পাঁচ দফায় হয়েছিল (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময় খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন), সে সময়‍‍ও কিন্তু মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা যায়নি। আবার এর আগে ২০০৩ সালে এক দফায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিহতের সংখ্যা ছিল ৫৮।

panchayat poll

এক দফা, পাঁচ দফা বা পঁচিশ দফার প্রশ্ন নয়, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য দফার হিসেব প্রাসঙ্গিক নয়- পদ্ধতি কখনও নীতি, কখনও নয়। আসলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। এখানে প্রত্যাশিত থাকে যে পরস্পর দ্বন্দ্বরত দলগুলি নিজনিজ আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচী নিয়ে লড়বে। নীতির লড়াই এখানে প্রাসঙ্গিক, বাহুবল না। কিন্তু নীতির ক্ষেত্রে দেউলিয়াপনায় বাহুবল অনিবার্য হয়ে ওঠে। ঘটনা হল, অতীতে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অন্ধ সিপিআইএম বিরোধিতা তৃণমূল কংগ্রেসের মতাদর্শগত পুঁজি ছিল। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দ থেকে সিপিআইএম তথা বামফ্রন্টের অপসারণের পর এই পুঁজি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। ফলে তৃণমূল কংগ্রেস এক আদর্শহীন দলে পরিণত হয়েছে। ফলে এখন বলং বলং বাহুবলং, আশ্রয় করে ক্ষমতাসীন থাকা ছাড়া আর পথ নেই। আসলে ইতিহাসের শিক্ষা হল, নীতির সংগ্রামে প্রাধান্য থাকলে গা-জোয়ারী বাহুবলের প্রয়োজন থাকে না। নীতির কোনও ঘাটতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বল প্রয়োগ অনিবার্য হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: হোক না পঞ্চায়েত নির্বাচন, মমতা কিন্তু পাখির চোখ করেছেন প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটাকেই
ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের ইতিহাসেও একই কথা বলে। সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনের প্রথম পর্বে নীতি ও প্রাসঙ্গিক কর্মকৃতীর কারণে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ছিল না, জনসমর্থন স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নীতি ও কর্মসূচীর ঘাটতি ভোট মেশিনারির পথে বলপ্রয়োগকে অনিবার্য করে। আসলে ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একযোগে পাশাপাশি দুটি প্রক্রিয়া চলে। প্রথম প্রক্রিয়াটি ছিল ভূমি সংস্কার, বর্গা অপারেশন, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা পত্তন ইত্যাদি। কিছু ভালো কাজের প্রক্রিয়া আর দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি ছিল সমানে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া। যত দিন গেছে, ততই প্রথম প্রক্রিয়াটি দুর্বল হতে হতে ১৯৮৫ সাল নাগাদ পরিত্যক্ত হয়েছে। এর রেশ থেকেছে ১৯৮৭-৮৮ সাল অবধি। আর অন্যদিকে সমানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি প্রতিদিনের সাথে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে পরিশেষে সর্বগ্রাসী হয়েছে। তখন থেকেই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার কর্মসূচী প্রধান হয়ে ওঠে এবং ‘ভোট মেশিনারি’ পুজো শুরু হয়। আসলে একটি জীবন্ত সমাজে মানুষজনের সক্রিয়তা, উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার পথ সদা উন্মোচিত হয়ে সামাজিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্থ করে আর যখন নিয়ন্ত্রণের কারণে এই সক্রিয়তা, উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার পথ পাথরচাপা পড়ে যায়, তখন সমাজ তার প্রাণশক্তি হারায়। বাম শাসনের অন্তিম পর্বে নীতির এই দেউলিয়াপনা যত প্রকট হয়েছে, ততই বাহুবলের প্রয়োজন বেড়েছে। এর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে পাথেয় করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসা-সন্ত্রাস প্রসঙ্গে মমতা মিথ্যা বলছেন
কিন্তু দলতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রের আওয়াজ দিয়ে ক্ষমতাসীন হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানুষের সামনে কোনও আদর্শ, কর্মসূচী উপস্থাপনে এযাবৎ ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে গণতন্ত্রের বদলে কায়েম হয়েছে নৈরাজ্যবাদ। দুর্ভাগ্য আমাদের যে, এমন এক দল রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়েছে, যাদের কোনও নির্দিষ্ট আদর্শ নেই, কর্মসূচী নেই, গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি নেই। তাই এখানে নীতির লড়াইয়ের কোনও অবকাশ নেই। তাই রহস্য বাহুবলেই ভরসা। লক্ষ্যনীয় যে, স্বনামধন্য বাহুবলীরাই এখন দলকে আলোকিত করছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ঘটনা হল কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন পর্বে কংগ্রেসের সবচেয়ে অপসারিত, সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে লুম্পেন অংশই দলে দলে তৃণমূল কংগ্রেসে আসে। সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পদ। তৃণমূল কংগ্রেসের যেকোনও আন্দোলন বা কর্মসূচী হিংসাত্মক ও নৈরাজ্যের সম্মুখীন হওয়ার কারণ এখানেই নিহিত। যেকোনও নির্বাচনে জয় অর্জনে এদের ভূমিকাই নির্ণায়ক। নীতির লড়াইয়ে ভাষা এদের জানা নেই। এরা বোঝেন হিংসার ভাষা, বলপ্রয়োগের ভাষা, তাই নির্বাচন যে রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
এসবের অনিবার্য ফল হিসেবে অনুব্রত মণ্ডল, আরাবুল ইসলামদের মতো ‘রত্ন’রাই তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা হয়ে উঠেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব হল, এই সব অজস্র ‘রত্ন’দের থেকে ‘কহিনূর’ বেছে নিয়ে দল ও নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এর ফলে রাজ্যে কায়েম হয়েছে এক লুম্পেনরাজ, যেখানে ‘উন্নয়ন’ আগ্নেয়াস্ত্র, বোম, তীরধনুক, লাঠি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। আর এর ফলেই রাজ্যে বীরের রক্তশ্রোত ও জননীর অশ্রুধারা অনিবার্য হয়েছে। ‘এত রক্ত কেন’ ছত্রের উত্তর এখানেই নিহিত।