গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ অসমের অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা প্রতি লিটার পেট্রল এবং ডিজেলর দাম পাঁচ টাকা কমানোর ঘোষণা করেন। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ২২ ফেব্রুয়ারি পেট্রল আর ডিজেলেরে দাম কমান লিটার পিছু ১ টাকা। আজকের সকালে (২৩ ফেব্রুয়ারি) যেখানে অসমে পেট্রলের দাম ৮৭.২৪ টাকা, সেখানে বাংলায় ৯১.৭৮ টাকা। বাংলার সান্তনা মহারাষ্ট্রে তেলের দাম ৯৭.৩০ টাকা, রাজস্থানে ৯৭.১০ টাকা।

তেলের ভারতীয় বাজার দর কীভাবে নির্ধারিত হয়
বিশ্ব বাজারে নানান মানের তেল পাওয়া যায়I। আমাদের তেল শোধনাগারে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের (SOUR গ্রেড) ‘দুবাই ও ওমান’ গ্রেডের তেল এবং উচ্চ মানের (SWEET গ্রেড) ‘ব্রেন্ট’ গ্রেডের তেল মিশ্রিত হয়। এই মিশ্রণ আন্তর্জাতিক বাজারে “ইন্ডিয়া বাস্কেট” নামে পরিচিতI সময়ের সাথে সাথে এই অনুপাতেরও পরিবর্তন হয়েছে। ২০০১-০২ সালে মিশ্রণের অনুপাত ছিল দুবাই ও ওমান ৫৭ শতাংশ আর ব্রেনট ৪৩ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালে এই অনুপাত দাঁড়ায় ৭৫.৬২:২৪.৩৮I প্রতিদিনই তেলের দাম ওঠানামা করেI মাসিক গড়ের ভিত্তিতে আমরা নীচের টেবিলে ইন্ডিয়া বাস্কেট তেলের দাম রাখলাম। করোনা আবহে তেলের দাম বেশ কমে যায়, গত এপ্রিলে ইন্ডিয়া বাস্কেট তেলের দাম ছিল ব্যারেলে পিছু ১৯.৯০ ডলার। সেখান থেকে জানুয়ারিতে দাম ২৭৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪.৭৯ ডলার।
২০২০-২১ আর্থিক বছরে ইন্ডিয়া বাস্কেট তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ডলারে

গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি ইন্ডিয়া বাস্কেটের দাম ছিল ব্যারেল পিছু ৬৩.৬৫ মার্কিন ডলার I প্রতি ডলারের বর্তমান মূল্য ৭২.৭৩ টাকা ধরলে, ভারতে আনার পর এই অপরিশোধিত তেলের দাম দাঁড়ায় (৬৩.৬৫ x ৭২.৭৩)= ৪৬২৯.৪৭ টাকা I এক ব্যারেলে ১৫৯ লিটার তেল থাকেI অর্থাৎ প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলের খরচ ২৯.১২ টাকা। দেশে তেল আনা এবং তারপর পরিশোধন খরচ ধরে প্রতি লিটারের দাম দাঁড়ায় ৩১.৮২ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় প্রতি লিটারে ০.২৮ টাকা পরিবহন খরচ I পেট্রল পাম্প এক লিটার পেট্রলে ৩.৬৮ টাকা কমিশন পায়I পেট্রল পাম্প গুলিতে পেট্রল ৩৫.৭৮ টাকায় বিক্রি হওয়া উচিত ছিলI তা না হয়ে, পেট্রল কলকাতায় বিক্রি হচ্ছে ৯১.৭৮ টাকায়I বোঝাই যাচ্ছে, কি বিশাল অঙ্কের কর বসেছে পেট্রল ডিজেলের উপর, সেন্ট্রাল এক্সাইজের সাথে আছে রাজ্যের ভ্যাটI এখনও পেট্রল, ডিজেলে জিএসটি লাগু হয় নি I কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি লিটার পেট্রলে বেসিক শুল্ক ১.৪০ টাকা, স্পেশাল বাড়তি শুল্ক ১১ টাকা, বাড়তি রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার শুল্ক ১৮ টাকা, কৃষি ও পরিকাঠামো সেস ২.৫০ টাকা অর্থাৎ লিটার পিছু ৩২.৯০ টাকা কর আদায় করেI এই পুরো টাকা কেন্দ্রীয় সরকার নিজের কাছে রাখতে পারে না। চতুর্দশ অর্থ কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শুল্কের ৪২ শতাংশ রাজ্যকে ফিরিয়ে দিতে হয়, যদিও সেস বিভাজনের কোনও নিয়ম নেই। কৃষি পরিকাঠামো সেস বাবদ ২.৫০ টাকা বাদ দিলে ৩০.৪০ টাকার ৪২% অর্থাৎ ১২.৭৭ টাকা রাজ্য ফেরত পায়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পেট্রলের উপর ভ্যাটের হার বিভিন্ন রকমেরI পশ্চিমবঙ্গে পেট্রলের ওপর ২৫% ভ্যাট, সাথে প্রতি লিটারে ১ টাকা সেসI আরেকটু অংক কষে আমরা প্রতি লিটারে রাজ্যের প্রাপ্তি দেখে নেব। বেসিক দাম, কমিশন, কেন্দ্রের শুল্ক নিয়ে প্রতি লিটার পেট্রলের খরচ দাঁড়ায় ৬৮.৬৮ টাকা, বাংলায় প্রতি লিটারের বাজার দর ৯১.৭৮ টাকা, অর্থাৎ রাজ্য আদায় করে ২৩.১০ টাকা, শুল্ক বিভাজনের মাধ্যমে ফেরত পায় ১২.৭৭ টাকা। প্রতি লিটারে রাজ্যের আয় ৩৫ টাকা ৮৭ পয়সা, আর কেন্দ্রে আয় (৩২.৯০ টাকা – ১২.৭৭ টাকা)= ২০.১৩ টাকা।

কেন্দ্র ও রাজ্যের শুল্ক এবং শুল্ক বিভাজন ধরে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম, টাকায়

তেল থেকে রাজস্ব
পেট্রল ও পেট্রলিয়ামজাত দ্রব্য থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ রাজস্ব প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালের বাজেট অনুযায়ী ভারত সরকারের মোট আয় সাড়ে বাইশ লক্ষ কোটি টাকা, সেই বছরে তেল থেকে ভারত সরকারের নিট আয় ছিল ২ লক্ষ ৪০ কোটি টাকা, অর্থাৎ সরকারি আয়ের ১০ শতাংশ। অনেকের ধারণা কেন্দ্র বুঝি রাজ্য থেকে অনেক বেশি টাকা আয় করে তেল থেকে। ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। টেবিল ৭ এ আমরা দেখিয়েছে ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০১৯-২০ পর্যন্ত প্রতি বছর কেন্দ্রের আয়ের থেকে বেশি ছিল রাজ্যের আয় । ২০১৪-১৫ সালে ছিল ৭০ শতাংশ বেশি।
পেট্রল ও পেট্রলিয়ামজাত দ্রব্যের থেকে কেন্দ্রের রাজস্ব আদায় ( কোটি টাকা )

পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের থেকে রাজ্যের রাজস্ব আদায়( কোটি টাকা )

তেল থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যের আয় ( কোটি টাকা )

এবার দেখব তেল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয় কত?
পেট্রল ও ডিজেল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিন ভাবে আয় করে-
(১) পেট্রল ও ডিজেল থেকে ভ্যাট।
(২) বহু পেট্রলিয়ামজাত দ্রব্যের ওপর জিএসটি আছে, রাজ্য সেখান থেকেও আয় করে।
(৩) পেট্রল থেকে কেন্দ্রীয় শুল্কের ভাগ।
তেল থেকে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের আয় ( কোটি টাকা )

পেট্রলে উপর কেন্দ্রীয় শুল্ক থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কত টাকা পায়, তার চটজলদি হিসেব নেই। তবে একটা ছোট অংক করা যেতে পারে, ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভ্যাট বাবদ আদায় করেছিল ৭,৫৩৪ কোটি টাকা। আমরা উপরের আলোচনায় দেখিয়েছি, প্রতি লিটারে রাজ্যের আয় হয় ২৩.১০ টাকা। ৭,৫৩৪ কোটি টাকা ভ্যাট এসেছে মানে ৩২৬ কোটি লিটার তেল বিক্রি হয়েছে রাজ্যে। কেন্দ্রীয় শুল্ক বিভাজনে রাজ্য পায় প্রতি লিটারে ১২.৭৭ টাকা, অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালে আরও ৪,১৬৫ কোটি টাকা তেল থেকে পেয়েছে এই রাজ্য। সব মিলয়ে রাজ্যের তেল থেকে আয় হয় প্রায় বারো হাজার কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেট ছিল ১১,২৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেটের সবটাই এসেছে তেলের রাজস্ব থেকে। এত সুবিধা নিয়ে, এখন তেলের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কথা বলে কী লাভ! পশ্চিমবঙ্গ সরকার তেলের উপর জিএসটি’র দাবি করুক না, সে সাহস হবে না।
Comments are closed.