আমাদের ছোটবেলায় স্কুলে মৌখিক পরীক্ষা হত। সব বিষয়ের। স্যার নাকি এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নেপাল কোথায়?

উত্তর কলকাতার, সরকারি স্কুলের একটু পাকা কোনও ছাত্র নাকি উত্তর দিয়েছিল, এতক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল, এখন বাথরুমে। ভূগোলের মৌখিক পরীক্ষায় নেপালকে বাথরুমে পাওয়া যাবে জেনে স্যার কতটা পুলকিত হয়েছিলেন, জানা নেই। কিন্তু এই সপ্রতিভ উত্তর পল্লবিত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছাত্রদের, নাকি হিন্দু হেয়ার ছাড়িয়ে বেথুন, বাগবাজার মাল্টিপারপাসের ছাত্রীদেরও উদ্বুদ্ধ করত বলে মনে হয়। আজকের যুগে মিম যেভাবে ভাইরাল হয় আর কি!

যদি উত্তরপ্রদেশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের ওই অফিসার বা কম্যান্ডোদের কোনও মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়, এবং একইভাবে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তারা কি উত্তর দেবে ভাবছিলাম।

বিকাশ এতক্ষণ আমার সঙ্গে ছিল, এখন গুলি খেয়ে মর্গে শুয়ে আছে।

কিন্তু নেপালকে হিন্দু স্কুলের বাথরুমে পাওয়া যাওয়াটা ভৌগোলিক দিক থেকে যতটা চিত্তাকর্ষক ছিল, বিকাশকে মর্গে পাওয়া যাওয়াটাও গণতন্ত্রের দিক থেকে ততটাই আইকনিক হতে পারে, এটা কি সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন?  কারণ, নেপাল-এর মতোই বিকাশও তো এখানে অনেক অর্থবহন করে। এবং সেই জন্যই বিকাশকে মর্গে আবিষ্কার করাটা অনেক বেশি মিম-এর জন্ম দেয়। ভাইরালও হয়।

এমনিতে উত্তরপ্রদেশের দাগী অপরাধী, গ্যাঙস্টার বিকাশ দুবেকে নিয়ে বিশেষ কারও খুব সহানুভূতি আছে বলে মনে হয় না। তাঁর মৃত্যুতে কেউ খুব চোখের জল ফেলেছেন বলেও মনে হয় না। এই ধরনের দাগী অপরাধীদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার নিয়েও হয়তো কেউ খুব সরব নয়। তা হলে? আসলে প্রশ্নটা বোধহয় গোটা এনকাউন্টার-এর পিছনে যে হেন অপটু হাতের চিত্রনাট্য দেখা যাচ্ছে, তাকে নিয়ে। যে আগের দিন মধ্যপ্রদেশের মহাকাল মন্দিরের সামনে ধরা দেবে, সে পরের দিন গাড়ি উল্টে গেলে পালাতে যাবে কেন? আর শুধুই তারই গাড়ি ওল্টাল কেন?

Vikas-Dubey-encounter
এনকাউন্টারে বিকাশ দুবের মৃত্যুর পর কানপুরের লালা লাজপত রায় হাসপাতালের সামনে পুলিশ কর্মীদের সম্বর্ধনা। ছবি- পিটিআই

হায়দরাবাদের তরুণীকে ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় অভিযুক্ত চার জনের যখন এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছিল, তখন কিন্তু এত প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ, নাগরিক সমাজ ওই ধর্ষণের ঘটনায় এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল, মনে করেছিল এটাই ন্যায় বিচার। ভারতবর্ষের আদালত যদি নির্ভয়ার ধর্ষকদের শাস্তি দিতে এত বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়, তাহলে এই ঘৃণ্য ধর্ষকদের জন্য এনকাউন্টার’ই ঠিক দাওয়াই। বৃহত্তর নাগরিক সমাজ হায়দরাবাদের পুলিশি সক্রিয়তাকে দোষেনি। বরং অনেকেই মনে করেছিলেন, মেয়েদের বিরুদ্ধে বেড়ে চলা অপরাধে লাগাম পরাতে এই ধরনের পুলিশি সক্রিয়তা ভালই।

বিকাশ দুবেকে নিয়ে ক্ষোভটা কিন্তু মূলত পুলিশমহলের, তাও তার ডেরায় অভিযান চালাতে গিয়ে আটজন পুলিশকর্মীর মৃত্যুর পর থেকে। তার আগে পর্যন্ত কিন্তু পুলিশের’ই ছত্রছায়ায়, এক শ্রেণীর পুলিশ কর্মীর মদতে বিকাশের উত্থান এবং রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া। এমনকি বিকাশ দুবের ডেরায় অভিযান চালাতে গিয়ে যে দিন আটজন পুলিশকর্মী মারা যান, সেদিনও বিকাশকে ফোনে সতর্ক করে দিয়েছিলেন একটি থানার ইনচার্জই। এই টিপ বা সতর্কবার্তা পাওয়ার পরই বিকাশ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা গুলি চালিয়ে আটজন পুলিশকর্মীকে মেরে ফেলে। এবং তারপর থেকেই বিকাশ দুবেকে নিয়ে এত শোরগোল, এত আলোচনা।

সবাই কৌতূহলের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল, বিকাশ দুবে ধরা পড়লে তার নেক্সাসের উপর থেকে কতটা পর্দা ওঠে, তার জন্য। পুলিশ অপরাধী যোগসাজশের কি কি বিষয় সামনে আসে তার জন্য। এই নেক্সাসের সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ কতটা নিবিড়,তাও সবাই জানতে চাইছিল। এবং সেই জন্যই বিকাশ দুবের এনকাউন্টার নিযে এত চর্চা হচ্ছে বা চারপাশে এত শোরগোল।

অতএব বিকাশ দুবে জীবিতাবস্থায় নাগরিক সমাজের কাছে সেইরকম আলোচনার বিষয় ছিল না, বা বৃহত্তর সমাজ তার শাস্তির দাবিতে সোচ্চারও ছিল না। বরং সে আমাদের রাডারের বাইরেই ছিল। তার বিরুদ্ধে রোষ বা তার মৃত্যুতে শান্তি, সেইজন্য এইরকম কোনও নাগরিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া মুশকিল।

বিকাশ দুবে রাজনীতিক পুলিশ যে সমীকরণ বা নেক্সাসের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছিল, একমাত্র সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং সেই কারণেই আট পুলিশকর্মীর মৃত্যুর পরে যেখানে টানাপোড়েন শুরু হয়, সেটা এই পুলিশ এবং ক্ষমতার নেক্সাসের ভিতরেই। এবং সেই টানাপোড়েন’ই শেষ পর্যন্ত বিকাশ দুবেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে গেছে হয়তো।

আমরা যারা ক্ষমতার বৃত্তের বাইরের সমাজ, তারা বিকাশের নাম জেনেছি আটজন পুলিশকর্মীর মৃত্যুর পর। এবং হতচকিত হয়েছি সাতসকালে এনকাউন্টার এর খবরে। পুলিশের একাংশের বা হয়তো বড় অংশের মদতে বিকাশের উত্থানের কাহিনী যেমন আমরা জানতাম না, তেমনই উত্তরপ্রদেশের এই গ্যাঙস্টারকে একেবারে বুলেটের ভাষায় জবাব দিতে হবে, এমন কোনও নাগরিক দাবিও ছিল না। কারণ, বিকাশ দুবে বৃহত্তর ভারতবর্ষের কাছে কোনও দাউদ ইব্রাহিম ছিল না, যে সবাই তার শাস্তি বা মৃত্যুর দাবিতে সোচ্চার ছিল।

বরং সবাই কৌতূহলের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল, বিকাশ দুবে ধরা পড়লে তার নেক্সাসের উপর থেকে কতটা পর্দা ওঠে, তার জন্য। পুলিশ অপরাধী যোগসাজশের কি কি বিষয় সামনে আসে তার জন্য। এই নেক্সাসের সঙ্গে রাজনীতির যোগাযোগ কতটা নিবিড়,তাও সবাই জানতে চাইছিল। এবং সেই জন্যই বিকাশ দুবের এনকাউন্টার নিযে এত চর্চা হচ্ছে বা চারপাশে এত শোরগোল। সেখানেই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে, ট্যুইটার আর ইনস্টাগ্রামের ইনস্ট্যান্ট ফেম বা তাৎক্ষণিক খ্যাতির জগতে থাকতে থাকতে আমাদের জীবনটাও তাৎক্ষণিক হয়ে যাচ্ছে না তো? কুইক সেক্স-এর মতো কুইক জাস্টিস? ওয়েব সিরিজের পৃথিবী আমাদের যেমন বাসস্ট্যান্ডে বা রেস্টুরেন্টের বাথরুমে যৌনতার সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছে, তেমনি কুইক সলিউশন এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে না তো? কুইক জাস্টিস?

ইনস্ট্যান্ট নুডলস তো এসে গেছিলই, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুইক মানি এবং কুইক ফেম। এবার কি তাহলে কুইক জাস্টিসেরও যুগ? এই বৃহত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক প্রতর্ক বা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার হয়তো সময় এসে গেছে।