‘চৌরঙ্গী’-র মোড়ে ৪১ বছর ঠায় দাঁড়িয়ে ‘ছদ্মবেশী’ ‘সন্ন্যাসী রাজা’। ‘ভ্রান্তিবিলাস’-এর পালা শেষ হয়ে গেছে কবেই ‘ব্রজবুলি’-তে। ‘জীবনতৃষ্ণা’-র ‘চাওয়া পাওয়া’-ও শেষ আজ। ‘জীবন জিজ্ঞাসা’-র ‘কখনো মেঘ’-এ আজ ‘বন্দী’ ‘নায়ক’। ‘সেই চোখ’ আজ আর ‘রাত ভোর’ ফোটায় না ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ বা ‘নিশিপদ্ম’। আজ ‘হারানো সুর’ আর খোঁজে না ‘নিধিরাম সর্দার’-রা। ‘চিড়িয়াখানা’ থেকে ‘আনন্দ আশ্রম’ আজ কেউ আর লেখেন না ‘বনপলাশীর পদাবলী’।
তাঁর জীবনটাই ছিল একটা সিনেমার গল্পর মতো। আজ তিনি নেই, পড়ে রয়েছে শুধু তাঁর অম্লান স্মৃতি। তবে যা কিছু তিনি দিয়ে গেছেন বাংলা ফিল্মজগৎকে, তার কোনও “দ্বিতীয়” আর হবে না, হওয়া সম্ভব না। বাংলা ছায়াছবির হৃৎপিন্ড উপড়ে নেওয়া সেই ২৪ জুলাই ১৯৮০-র পরে, দেখতে দেখতে কেটে গেল ৪১ বছর। এখনও তার জন্য ধুকপুক, বুকের ভিতরে। এখনও তার জন্য রুদ্ধবাক, অনুভূতি। এখনও তার জন্য আফশোষ, টালিগঞ্জে। এখনও কয়েকটা প্রজন্ম কিসের টানে বুঁদ হয়ে থাকে সিঙাড়া-চুলের ছাঁট আর পাশের-বাড়ির-ছেলে ইমেজের লোকটার মোহে? সময় জানে। আমজনতার দীর্ঘশ্বাস জানে। ইতিহাসের দলিল জানে।

আজ সেই ইতিহাস খুঁড়ে তুলে আনা কয়েকটি উত্তমকথা রইল সবার জন্য, কেননা আজ তাঁর পর্দা থেকে আর কখনও না ফেরার গ্রীনরুমে হারিয়ে যাওয়ার ৪১ বছর। উত্তম স্মরণেই আজ হোক উত্তম প্রণাম।
১) উত্তমকুমার অভিনীত ‘যদুবংশ’ ছবির শ্যুটিং চলছিল সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। পরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরী চিৎকার করছেন ‘‘অল লাইটস’’। পজিশন নিতে গিয়ে উত্তমকুমার খেয়াল করলেন, টপ থেকে কোনও একটা লাইট ঠিকমত তাঁর শরীরে এসে পড়েনি। তখন উপরে কাঠের পাটাতনে লাইটম্যানরা দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতেন, নির্দেশ মতো সুইচ অফ-অন করতেন। সে দিন তেমনই এক জন, নাম তার কালী।‘‘অল লাইটস’’ শোনার পরও ভুলে গেলেন আলো জ্বালতে। শট অবশ্য হয়ে গেল, তবে হয়ে যাওয়ার পর কালীকে ডেকে পাঠালেন উত্তমকুমার। শুনে কালী কাঁপতে কাঁপতে উত্তমকুমারের মেক-আপ রুমে এলেন। এমনিতে তার কাছ থেকে মাঝেমধ্যেই বিড়ি চেয়ে খেতেন উত্তমকুমার, কিন্তু কাজের ভুলের তো কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু উত্তমকুমার বকুনি না দিয়ে সস্নেহে প্রশ্ন করলেন,‘‘কী হয়েছে রে কালী? অন্যমনস্ক ছিলিস মনে হল, এনি প্রবলেম?’’ প্রশ্ন শুনে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন কালী, বলেন, ‘‘মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে দাদা, কিন্তু আমি কিছুতেই টাকা জোগাড় করে উঠতে পারছি না। তাই… এমনটা আর হবে না।’’
পরের দিন স্টুডিয়োতে বের হবার আগে উত্তমকুমারের বাড়িতে তাঁরই নির্দেশ মতো কালীকে নিয়ে হাজির পার্থপ্রতিমের সহকারী বিমল দে। তাঁদের দুজনকে নিয়ে স্টুডিয়ো যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে উত্তমকুমার কালীর হাতে হাজার পাঁচেক টাকার একটা খাম ধরিয়ে বললেন, ‘‘এটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখ।’’ এ ভাবে হরদম যাদের পাশে দাঁড়াতেন, তাঁরা কেউ আত্মীয় ছিলেন না উত্তমকুমারের।
২) মণি শ্রীমানির মতো অভিনেতার যেন অসম্মান না হয়, সে জন্য তাঁর মেয়ের বিয়ের টাকা নিজে না দিয়ে ফাংশন করে তুলে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার। রাসবিহারী সরকার বিনা ভাড়ায় ‘বিশ্বরূপা’ হলটি দিয়েছিলেন। গোটা অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিলেন উত্তমকুমারের ভাই তরুণকুমার আর সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। মূল আকর্ষণই ছিল উত্তমকুমারের গানের সঙ্গে অসিতবরনের তবলা। হইহই করে টিকিট বিক্রি হল, আর মণি শ্রীমানির মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেল।…
৩) সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাঝেমধ্যেই উত্তমকুমারকে নিয়ে স্মৃতিতে ফিরে যেতেন… তখন শিল্পী সংসদ আর অভিনেত্রী সংঘের ঝগড়াঝাঁটি বাক্যুদ্ধ চরমে, প্রথমটিতে উত্তম আর পরেরটিতে সৌমিত্র। বসুশ্রী সিনেমায় পয়লা বৈশাখ, সৌমিত্র গিয়ে দেখেন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বসে আছেন উত্তম। ওঁরা দু’জন তখন দুই শিবিরে। বাকি গল্প শুনিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ‘‘আমি গিয়ে ভানুদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আর যেহেতু দুই শিবিরে আমরা বিভক্ত, তাই উত্তমদাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম না করে, হাতটা ধরে ‘শুভ নববর্ষ’ বললাম। বলামাত্র উত্তমদার মুখটা লাল হয়ে গেল।রাগে দুঃখে। এবং এই হচ্ছে লোকটার মহত্ত্ব। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বড় ভাই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারিস না!’ আমার পরম সৌভাগ্য যে, এই মুহূর্তে আমি যে অন্যায় করেছি, সেই চেতনাটা হল।’’
সে দিন ক্ষমা চেয়ে নিয়ে যখন উত্তমকে প্রণাম করলেন সৌমিত্র, তখন তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন উত্তম।
৪) তাঁর সম্পর্কে সেরা উক্তি করেছিলেন রাজেশ খান্না – ‘‘আমার তো মনে হয় যে-ভাবে গোটা বাঙালি জাতির মুখ দেখা যেত উত্তমকুমারের মধ্যে, সে-ভাবে আর কেউ পারবে না নিজের জাতকে তুলে ধরতে। ওভাবে ধুতির কোঁচাই ধরতে পারবে না কেউ…।”.
৫) এই ঘটনাটা পড়েছিলাম কেয়া মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখার মধ্যে, লেখাটি ছিল ভালোবাসার রবীন্দ্রগান গায়ক দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে।
“বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের সঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাসের বিরোধের কথা সবাই জানি। শেষ কয়েক বছর অভিমানে গান রেকর্ড করেননি। বাইরের অনুষ্ঠান থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর ভালোবাসা, সে গান গাইতেন শুধু বাড়িতে, নিজের মতো করে। তবু তারই মধ্যে একবার একটি ব্যতিক্রম ঘটেছিল। একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন তিনি। সে ঘটনার কথা বলে গেছেন ৩০ শে জুলাই, ১৯৮০ সালে করা একটি টেপে, যেখানে অন্তরঙ্গ গল্পের মধ্যে দিয়ে নিজের সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে নানা কথা বলেছেন তাঁর গভীর রসবোধের মিশেল দিয়ে। “একদিন আমার এইখানে একজন আইস্যা উপস্থিত। আমি কই, আপনি কে? তা কয় ‘আমি উত্তম কুমার। সিনেমা করি’। আমি কই, মিথ্যা কথা! আপনে যদি সত্যই উত্তমকুমার হইতেন, তো আমার বাসার সামনে ভিড় ভাইঙ্গা পড়ত। তা যখন হয় নাই, আপনে উত্তম কুমার নন। তা সে প্রণাম কইর্যায় কইল, ‘আমি রুমালে মুখ ঢাইক্যা দৌড়ে আসছি। কেউ দ্যাখে নাই’। আমি কই, বসেন। কী বলবেন বলেন। কয়, ‘আমি একটা চ্যারিটি শো করত্যাছি শিল্পী সংসদের জন্য। দুঃস্থ শিল্পীদের সাহায্য করা হইব। আপনি যদি একটু গান গাইতেন’। আমি কই, আমি তো গান গাওয়া বন্ধ কইরা দিছি। কয়, ‘ওইজন্যই তো আমি নিজে এসেছি। যদি অনুগ্রহ করেন, আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়’। মানে টিকিট ফিকিট বিক্রি হইব আর কি! শ্যাষ পর্যন্ত রাজি হইলাম। তবে কইলাম, আমার একটা শর্ত আছে। কয়, ‘বলুন কী শর্ত?’ আমি কই, আমি গান গামু কিন্তু আমার নাম আপনারা বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারবেন না। তাঁর তো মাথায় বজ্রাঘাত। শ্যাষে কী করল জান?
বিজ্ঞাপন দিল, ‘…ও একজন প্রখ্যাত ও বিতর্কিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী’।’’
এটিই সম্ভবত দেবব্রত বিশ্বাসের শেষ অনুষ্ঠান ছিল আর উত্তমকুমারের আয়োজনে শিল্পী সংসদের শেষ অনুষ্ঠানও। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তমকুমার প্রয়াত হন। আর তার ২৫ দিন পরেই ১৮ আগস্ট ১৯৮০ তারিখে খুব জানা, অল্প জানা আর না জানা গানের বিপুল সম্ভার রেখে চলে গিয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস।
মৃত্যুদিনের প্রণাম, বাংলা ছায়াছবির “আজও ইন্ডাস্ট্রি”। আজ তাঁর না থেকেও থেকে যাবার ৪১ বছর শেষে।
(তথ্য কৃতজ্ঞতা – ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন উত্তমকুমার ফ্যানপেজ)
Comments are closed.