খোয়াব মানে স্বপ্ন। তবে বাংলা ভাষার ব্যবহারে খোয়াব বলতে অবাস্তব স্বপ্ন দেখাকেই বোঝায়। আশাতীত সাফল্য স্বপ্নকে খোয়াবে পরিণত করে। তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও হয়ত ভাবতে পারেনি ২ মে ২০২১ তারিখে তাদের জন্য এত বড় জয় অপেক্ষা করে আছে। যে ২৯২টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল তার মধ্যে ২১৩টি আসন জিতে নিয়ে, প্রদত্ত ভোটের ৪৭.৯৪ শতাংশ পেয়ে বিজয়ী তৃণমূলের এক স্বপ্নউড়ান শুরু হয়েছে। সেই স্বপ্নই হয়ত পরিণত হয়েছে ভারত বিজয়ের খোয়াবে। এবার দাবি উঠছে বাঙালী প্রধানমন্ত্রী চাই, বাংলাই ঠিক করবে ভারতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। এই স্বপ্নেই কিংবা খোয়াবে সাধারণ সমর্থকরা উদ্বেলিত, উদ্বেলিত বাংলা সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ। খোয়াব বাড়ছে, উদ্দীপনাও বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। কিংবা নানা কৌশলে তা বাড়ানো হচ্ছে।
পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি সফরকে ঘিরে যে অপ্রত্যাশিত (পশ্চিমবাংলায় হয়ত প্রত্যাশিত)উন্মাদনা তৈরি করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে খুব সুন্দরভাবে রচিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী এই উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাকে পরিচালনা করা হচ্ছে। একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর সাথে, বিভিন্ন দলের নেতাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এক অতি সাধারণ ঘটনা। ২০১৮ সালে অপ্রত্যাশিতভাবে জেতা ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল কিংবা মধ্যপ্রদেশের আগের মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ, ২০১৯ সালে অনেক তিক্ততার পর মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসা উদ্ভব ঠাকরে তাঁদের দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন, নিজের দলের অনেক কর্মসূচীতে অংশও নিয়েছেন, কিন্তু কোথাও কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এমন সব নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আসলে রাজনীতির প্রক্রিয়া বাস্তবের মাটিতে পরিচালিত হলেও এখানে নাটকীয় উপাদান কম থাকে না। অনেক ভাবনাচিন্তা করে নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করা যায় এবং তার দ্বারা মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলার চেষ্টা চালানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি সফরটিও যেন অতি নিপুনভাবে লিখিত চিত্রনাট্য অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। দিল্লি সফরের আগেই ২৬ জুলাই কংগ্রেস দলের সরকারি ট্যুইটার হ্যান্ডেলে তৃণমূল কংগ্রেসের যুবনেতা তথা সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ডের পূর্ণায়ব ছবি আর তার সাথে পেগাসাস নিয়ে মন্তব্য- “Modi Govt’s Insecurities are endless”। তথাকথিত Pegasus Snoopgate নিজেই একটি সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্যের অংশ এটা প্রচলিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। পর পর দুবার লোকসভায় প্রধান বিরোধী দল হতে ব্যর্থ হওয়া এবং গোটা দেশে ১৯ শতাংশ ভোট পাওয়া ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ক্ষমতা সর্বস্ব আঞ্চলিক দলগুলি ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-এর কাছে আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনা ভারতীয় রাজনীতিতে এখনও দৃশ্যমান নয়। যেটি দৃশ্যমান তা হল দিল্লিতে চিত্রনাট্য অনুযায়ী পরিচালিত একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম। বাংলার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের বিশেষ প্রতিনিধিদের দ্বারা মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপের ‘রানিং কমেন্ট্রি’, জাতীয় রাজনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার লক্ষ্য একটাই বাংলার মানুষদের সামনে বিজেপি বিরোধিতার একটি অবয়ব দাঁড় করানোর প্রাণপণ প্রচেষ্টা। কমলনাথ বা আনন্দ শর্মার মতো কংগ্রেস নেতাদের সাথে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকও সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্ব পায়। যদিও গান্ধী পরিবার বা সেই পরিবারের আশীর্বাদধন্য না হলে কংগ্রেস দলেই গুরুত্ব মেলে না, বাইরের রাজনীতি তো দূর অস্ত। তবুও এই নেতাদের সাথে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকও প্রচার পায় কেবল প্রচারের স্বার্থে, পশ্চিমবাংলার শাসকদল এবং কর্তাভাজন সংবাদমাধ্যম এই কাজই করে চলে অক্লান্তভাবে।
২০২১-এর নির্বাচনের ভোট গণনা পরবর্তী সময়ে এ রাজ্যে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর হিংসা সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত করে যে রিপোর্ট পেশ করেছে এবং কিছু রাজনৈতিক নেতা (যারা সকলেই শাসকদলের বা তাদের মদতপুষ্ট) সম্পর্কে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনা হয়েছে, তা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো যাবে। জাতীয় স্তরে বিজেপি’র বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান নিলে এরাজ্যের কোর ভোট ব্যাঙ্ক দলের সাথেই থাকবে। তাই লোকসভা নির্বাচনের প্রায় পৌনে তিন বছর বাকি থাকলেও এই প্রচেষ্টা চলবে, অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারও চলবে। কারণ, পুরোটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাজনীতির লাভক্ষতির অঙ্ক।
পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীর দিল্লি যাত্রার ঘোষিত উদ্দেশ্য হল জাতীয় পর্যায়ে বিজেপি বিরোধী জোটের ভিত বানানো। সেই ভিত বানানোর কাজটা ঠিক কতটা সম্পন্ন হল? এই নিবন্ধটি লেখা পর্যন্ত সময়ে কংগ্রেসের দু-একজন নেতা ছাড়াও সনিয়া গান্ধীর চা-চক্রে উপস্থিত হয়েছিলেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে রাহুল গান্ধীও উপস্থিত ছিলেন। এতে ভিত তৈরির প্রাথমিক কাজটুকুও কতটা হয়েছে তা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই কিছু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পরপর দুটি লোকসভার নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা অর্জনে ব্যর্থ হওয়া ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এখন লড়াই চালাচ্ছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। যদি বিরোধী জোট তৈরি হয়েও যায় (যা প্রায় অসম্ভব) তার নেতৃত্ব কংগ্রেস তথা গান্ধী পরিবার ছেড়ে দেবে অন্যের হাতে এমন আশা বাতুলতা মাত্র। কারণ, তাতে কংগ্রেস দলটাই উঠে যাবে আর ভারত সত্যিকারের অর্থেই কংগ্রেস মুক্ত হবে। কংগ্রেস এবং তার উপর নির্ভরশীল শক্তিগুলি কখনোই সেটা হতে দিতে চাইবে না। অথচ পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচন জেতার পর এরাজ্যের শাসকদলের লক্ষ্য হল যে ভাবেই হোক বিজেপি বিরোধী জোটে নেতৃত্বের জায়গাটা নেওয়া যাতে এ রাজ্যের দলের কোর ভোট ব্যাঙ্কের সামনে বিজেপি বিরোধিতার ধ্বজা উড়িয়ে রাখা যায়। এ কারণেই একদিকে সনিয়া গান্ধীর চা চক্রে উপস্থিত হওয়া অন্যদিকে পেগাসাস নিয়ে রাহুল গান্ধী বৈঠক ডাকলে সেখানে অনুপস্থিত থাকা। আগামী দিনে কোনও জোট হলে সেখানে রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসের নেতৃত্ব মানা হবে না সেই বার্তা একেবারেই স্পষ্ট। দলের সংসদ সদস্যরাও একসুরে বিজেপি বিরোধী জোটে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রীকেই নেতা হিসেবে তুলে ধরছেন। এ জাতীয় জট নিয়ে আদৌ কোনও জোট সম্ভব কি?

ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে জোট রাজনীতির আবির্ভাব ঘটেছে তখনই যখন কেন্দ্রের শাসকদলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বৈরাচার কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে মানুষ কোনও জাতীয় দলকে না পেয়ে আঞ্চলিক দলকেই আঁকড়ে ধরেছে। ১৯৭৭ সালে ভয়ঙ্কর স্বৈরাচার এবং দুর্নীতির কারণে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস হেরে যায়। ক্ষমতায় আসে জনতা পার্টি। নামে একটি দল হলেও জনতা পার্টি আসলে ছিল বিভিন্ন দলের একটি প্ল্যাটফর্ম, ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পরাজয়ের কারণ ছিল রাজনৈতিক অপদার্থতা এবং ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ। এর ঠিক ২৫ বছর পরে ভারতে এক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে আজ পর্যন্ত সময়ে মানুষ একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামোতে বেশী অভ্যস্ত। জোট সরকারকে স্বাভাবিকভাবেই সব সময় পতনের আশঙ্কা নিয়ে বাঁচতে হয়, যা ভারতের মতো দেশে জনমানসে ভাল প্রভাব ফেলে না। ২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি এক স্বভাব-দুর্বল কোয়ালিশন সরকারের বদলে দেশকে স্থায়ী সরকার দিয়েছে। ২০১৯ সালে সেই সরকার আরও মজবুত হয়েছে, দেশকে মজবুত করেছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই। গত ২০১৪ থেকে দেশের সরকারকে বিশ্বব্যাঙ্ক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের কাছে ঋণের জন্য হাত পাততে হয়নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত এখন একটি সমীহ জাগানো নাম। এই সরকারকে বদলে এক স্বভাব দুর্বল, নড়বড়ে জোট সরকারকে মানুষ বেছে নেবে এটা কখনোই হবে না, একবিংশ শতকে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এখন অনেক উন্নত এবং মানুষ এখন অনেক বাস্তববাদী।
কিন্তু তৃণমূলের মতো দলের কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী তৃণমূল একটি সর্বভারতীয় দল হলেও দলটি মূলত আঞ্চলিক দল। সাড়ে তিন দশকের সর্বনাশা বাম শাসন (যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্যে দিয়ে) একটা শিল্প এবং অর্থনীতির সমস্ত মানদণ্ড অনুযায়ী সমৃদ্ধ পশ্চিমবাংলাকে একটি অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া রাজ্যে পরিণত করে। গত দশ বছরেও রাজ্যের অধোগতি চলছেই। এই রাজ্যে ডোল রাজনীতির এক স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতা আছে। এছাড়া জনগণের একটা বিশেষ অংশের মধ্যে বিজেপি’র ভয় ঢুকিয়ে নিজেদের ভোট বাক্স ভরানোর একটা পুরনো কৌশলও আছে। কিন্তু এই ধরনের রাজনীতিতে তাৎক্ষনিক লাভ পাওয়া যেতে পারে, দু-তিনটে নির্বাচন জেতা যেতে পারে। কিন্তু চিরদিন এখান থেকে লাভের ফসল তোলা সম্ভব নয়। তাই এক্ষেত্রে শাসকদলকে কিছু চটকদারি সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে হয়। এমনিতে পেগাসাস নিয়ে গোটা দেশে যে বিতর্ক চলছে তা পুরোটাই বায়বীয়। তীব্র বিজেপি বিরোধী যে ওয়েব পোর্টাল এই খবর দিয়ে গোটা দেশে হৈচৈ বাধিয়েছে তারা এর স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ দেয়নি। তারা আবার উদ্ধৃত করেছে কিছু বিদেশী পত্রিকার। এই বিষয়ে কেন্দ্র এবং কোনও অন্যরাজ্য (এমন কি প্রতিবাদী বিরোধী দলগুলি শাসিত রাজ্যগুলিও) তদন্তের পথে হাঁটেনি সেখানে পশ্চিমবাংলা রাজ্য সরকার দু’জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির একটি কমিশন গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে ফেলেছে। এই দু’জন বিচারপতি একজন সুপ্রিম কোর্টের মদন বি লোকুর এবং অন্যজন হাইকোর্টের শ্রী জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য, যে তদন্তে কেন্দ্র থেকে এমন কি দেশের বাইরে থেকে তথ্য আনার প্রয়োজন হতে পারে সেখানে একটি রাজ্য সরকার প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিশন কতটা কার্যকরী তদন্ত করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এখানে তদন্তের বদলে তদন্তের প্রচারটাই রাজ্য সরকারের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাতে ২০২১-এর নির্বাচনের ভোট গণনা পরবর্তী সময়ে এ রাজ্যে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর হিংসা সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত করে যে রিপোর্ট পেশ করেছে এবং কিছু রাজনৈতিক নেতা (যারা সকলেই শাসকদলের বা তাদের মদতপুষ্ট) সম্পর্কে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনা হয়েছে, তা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো যাবে। জাতীয় স্তরে বিজেপি’র বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান নিলে এরাজ্যের কোর ভোট ব্যাঙ্ক দলের সাথেই থাকবে। তাই লোকসভা নির্বাচনের প্রায় পৌনে তিন বছর বাকি থাকলেও এই প্রচেষ্টা চলবে, অনুগত মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারও চলবে। কারণ, পুরোটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে রাজনীতির লাভক্ষতির অঙ্ক।
Comments are closed.