রহস্যে ঘেরা দেশ, যার আনাচে কানাচে কান পাতলে আজও শুনতে পাওয়া যায় সাংগ্রিলা বা ড্রাগনের গল্প, যেখানে সারা দেশ জুড়েই জঙ্গলের আর বন্যপ্রাণের প্রাচুর্য, শীতে শ্বেতশুভ্র তুষারাবৃত পর্বতমালা, গ্রীষ্মকালে উপত্যকাগুলোয় নানা রঙের রডোড্রেনড্রন, পপি, চেরি ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্যপট, প্রকৃতির শান্ত-সমাহিত পরিবেশে Lakhang বা বৌদ্ধ মন্দিরের সুন্দর স্থাপত্যশৈলী, ছবির মতো সুন্দর আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তায় মধ্যে মধ্যে Chorten বা বৌদ্ধ স্তূপ, পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে তৈরি Dzong/জোং (যেগুলো আসলে বর্তমানে ভুটানের এক একটি সরকারি দপ্তর) যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে টাইম মেশিনে আপনি পৌছে যাবেন আজ থেকে প্রায় কয়েকশো বছর আগে।কাজের সূত্রে এ দেশে বসবাস করেছি বেশ কিছু বছর আর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে প্রেমে পড়ে গেছি ভুটানের নিজেই জানি না। আজ লিখতে বসে শব্দ, স্মৃতি, ছবি ভিড় করছে মাথায়।
ভুটানের মূল প্রবেশদ্বার তিনটি- ফুন্টসেলিং, গেলেফু এবং সমদ্রূপ ঝংখার। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার জয়গাঁ সন্নিহিত ফুন্টসেলিং আসলে পশ্চিম ভুটানের প্রবেশদ্বার, ভারতের বেশিরভাগ পর্যটক এই রাস্তায় ভুটানে প্রবেশ করে। ফুন্টসেলিং-এর অভিবাসন দপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে পর্যটকরা শুধুমাত্র ‘থিম্পু’, ‘পারো’ ও ‘হা’ শহরের ‘tourist permit’  পাবেন। ভুটানের আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য প্রয়োজনীয় ‘tourist permit’ থিম্পুর অভিবাসন দপ্তরের মূল কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করতে হবে। আপনাকে শুধু ভারত সরকার অনুমোদিত যে কোনও একটি সচিত্র পরিচয়পত্র ও দুটি পাসপোর্ট-ছবি সঙ্গে রাখতে হবে। এসব কাজ অনায়াসেই হয়ে যায় পৃথিবীর এই সুখীতম দেশে, হাঙ্গামা পোয়াতে হয় না অহেতুক আর এসব ঝটপট সেরে ফেলার পরই শুরু হয় ভুটান সফর।
থিম্পু (Thimphu): 
ভুটানের রাজধানী। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ভুটানে রাজতন্ত্র কায়েম ছিল। রাজার প্রাসাদ এই থিম্পু শহরেই অবস্থিত যদিও সেখানে সাধারণ পর্যটকের প্রবেশাধিকার নেই। এখানকার উল্লেখযোগ্য পর্যটক স্থানগুলো হল- Changangkha Lhakhang, National Memorial Chorten, Zangthoperi Lhakhang,  National Folk Heritage Museum, Textile Museum, National Library, Trashi Chhoe Dzong, Simtokha Dzong, Takin (ভুটানের জাতীয় পশু) Preserve Park-Motithang এবং অবশ্যই Jigme Dorji National Park.
পারো (Paro):

Paro

পারো শহরের বিস্তৃতি Chujom Check Post-এ পারোচু ও ওয়াংচু-র সঙ্গম থেকে উত্তরে তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত মাউন্ট জোমোলহরির পাদদেশ পর্যন্ত। মাউন্ট জোমোলহরি ভুটানের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। ছবির মতো সুন্দর সাজানো এই উপত্যকা শহরেই ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত। এই প্রশস্ত উপত্যকার একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে পারোচু (চু-নদী), যার দুই ধারে চেরি ফুলের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে হলে এখানে আসতে হবে বসন্তকালে। এখানকার মূল আকর্ষণ Takshang Monastry বা Tiger’s Nest। শহরের একপ্রান্তে পাহাড়ের গায়ে প্রায় ঝুলতে দেখা যায় এই বৌদ্ধ-মঠটিকে। সম্পূর্ণ গাড়ি-রাস্তা না থাকায় বেশ কিছুটা রাস্তা আপনাকে ট্রেক করে যেতে হবে। ট্রেক যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য। মঠের উপর থেকে সমগ্র পারো উপত্যকাকে দেখার পর সব কায়িক পরিশ্রম লাঘব হয়ে যায়। ট্রেক পথে উপরি পাওনা নানারকম রডোড্রেনড্রন ফুল।
alpine cherry এখানকার অন্যতম আকর্ষণ Drugyel Dzong। তিব্বতি সেনা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ১৬৪৬ সালে নির্মিত হয় এই Dzong। ১৯৫১ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পুরো Dzong ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এই ধ্বংসাবশেষ যেন ‘বহু যুগের ওপার হতে’ প্রাচীন ভুটানকে হাতছানি দেয়। পারোর অন্যান্য আকর্ষণ National Museum, Kyichu Dzong, Rinpung Dzong, Drakhapo, Jangsarbu Lhakhang, Kila Gompa ইত্যাদি।
পারো থেকে ‘হা’ যাওয়ার পথেই ‘চেলেলা পাস’ -ভুটানের উচ্চতম সড়কপথ। উচ্চতার কারণেই ঠান্ডা বেশি এখানে। প্রায় ১৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চেলেলা পাস থেকে দেখা নৈসর্গিক দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমার সীমিত। সূর্যদেব সদয় থাকলে মাউন্ট জোমোলহরি দৃশ্যমান এখান থেকে। পারো থেকে চেলেলা পাসের রাস্তা জুড়েই সবুজ উপত্যকা, নানা রং-এর ফুল, কমলালেবু আর আপেল বাগান।
গ্রীষ্মকালে সমগ্র পারো উপত্যকা সেজে ওঠে রডোড্রেনড্রন, চেরি আর পপি (ভুটানের জাতীয় ফুল ‘নীল পপি’)ফুলে।
পুনাখা (Punakha)
 থিম্পু থেকে ৭৭ কিমি দূরে অবস্থিত পুনাখা ভুটানের পুরনো রাজধানী শহর (১৬৩৭-১৯০৭ অবধি)। থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার পথে ১০,৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত দোচুলা পাস অতিক্রম করতে হয়। দোচুলা পাসে অবস্থিত দোচুলা ছোড়তেন (Dochula Chorten) এখানকার এক অতি পবিত্র ধর্মস্থান। এখানে মোট ১০৮টি স্তূপ আছে। এদেশের প্রথানুযায়ী ছোরতেনগুলোর (Chorten) বাঁদিক দিয়ে ওগুলোকে অতিক্রম করতে হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় দোচুলা মেঘে ঢাকা থাকে। কিন্তু ভাগ্য অতীব প্রসন্ন থাকলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের অন্যান্য বরফাবৃত পাহাড়চূড়ার ১৮০ ডিগ্রি দৃশ্য অবিস্মরণীয়।
পুনাখায় ভুটানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দ্বিতীয় প্রাচীনতম Dzong অবস্থিত। ফোচু এবং মোচু-র সঙ্গমস্থলে অবস্থিত পুনাখা Dzong-এর নৈসর্গিক দৃশ্য অসামান্য, গ্রীষ্মকালে এই নদীর পাড় বরাবরও চেরি ফুলের সমারোহ। নদীর জলে প্রতিফলিত অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী দ্বারা নির্মিত এই Dzong-এর প্রতিবিম্বের মায়াবি ম্যাজিক মনকে বশ করে রাখবেই। ননারকম পাখির ডাক এবং নদীর বয়ে চলার শব্দ ছাড়া কোনও অকৃত্রিম শব্দ নেই এই উপত্যকায়। ইচ্ছে এবং পর্যাপ্ত সময় থাকলে ঘুরে আসা যায় Guru Rinpoche Caves এবং Koma Hot Springs।
ওয়াংদি ফোদরং (Wangdue Phodrang) :
থিম্পু থেকে ৭০ কিমি এবং পুনাখা থেকে ১৩ কিমি দূরে অবস্থিত Wangdue Phodrang-এর বিশেষত্ব এর Dzong। দূর থেকে দেখলে মনে হয় Dzong টি নদীর উপর ঝুলে আছে।
ট্রোংসা (Trongsa) :- Wangdue Phodrang থেকে Trongsa র দূরত্ব মোটামুটি ১২৯ কিমি। এই পথে অতিক্রম করতে হয় ভুটানের দ্বিতীয় উচ্চতম সড়কপথ পেলেলা পাস (Pelela Pass)। ঐতিহাসিক কারণে ট্রোংসা্র গুরুত্ব যথেষ্ট। ১৬৪৮ সালে তৈরী হওয়া ট্রোংসা জোং থেকে এ দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় রাজা দেশ শাসন করতেন। জোঙটি একটি ছোট পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছিল এবং ধাপে ধাপে তা নেমে এসেছে বেশ কিছুটা নীচ পর্যন্ত। অবস্থানগত কারণেই শহরের সব জায়গা থেকেই এটি দৃশ্যমান।
Ta Dzong Watchtower-টি নির্মিত হয় ১৬৫২ সালে। এখানে চারটি Observation Point আছে যার স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে বাঘ, সিংহ, গরুড় এবং ড্রাগনের অবয়বের আভাস দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার আর দুটি উল্লেখযোগ্য স্থান Thruepang Palace এবং Chendebji Chorten.
বুমথাং (Bumthang) :
Trongsa থেকে ৭৯ কিমি দূরে অবস্থিত বুমথাং হল ভুটানের ধর্মীয় পীঠস্থান। ২৬০০-৪৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত বুমথাং উপত্যকা প্রচুর প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ ও মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। আধুনিকতার ছোঁয়া বাঁচিয়ে আজও এই উপত্যকা ভুটানের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। উপত্যকা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গুরু পদ্মসম্ভবের নানা কাহিনী। কৃষিকাজ ও বস্ত্রশিল্পের কারণেও বুমথাং-এর প্রসিদ্ধি অনস্বীকার্য। সাম্প্রতিক অতীতে ভুটানবাসীর জীবনযাত্রার বারমাস্যা বুঝতে হলে আপনাকে একবার আসতেই হবে এখানে। শীতকালে সমগ্র উপত্যকা ঢাকা পড়ে যায় বরফের চাদরে।
এখানে Jambey Lhakhang নামক প্রাচীনতম বৌদ্ধ মন্দিরটি নির্মিত হয় ৬৫৯ AD তে। এখানকার স্থানীয় দ্রষ্টব্যস্থানের মধ্যে Jakar Dzong, Kurjey Lhakhang, Tamsing Lhakhang, Tang Mebar Tsho প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ফোবঝিখা (Phobjikha) :
প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। Jigme Singey Wangchuk National Park –এ নানা পাখি ও বন্যজন্তুর দেখা মেলে। পুনাখা থেকে বুমথাং যাওয়ার রাস্তায় পেলেলা অতিক্রম করার পরই একটা রাস্তা জঙ্গলপথে ডানদিকে বাঁক নিয়ে এসে পৌছয় চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গলেঘেরা এই উপত্যকায়।
পরিশেষে বলি ভুটান সফর সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে উঠবে যদি সময় এবং সুযোগ মেলে মুখোশ-নাচ দেখার, মুখোশের মধ্যে ড্রাগনের প্রাধান্যই বেশিস্থানীয় উৎসব ‘ছেচু’ (Tshechu)-তে অনুষ্ঠিত হয় এই নাচ। এক একটা জেলার ‘ছেচু’ আবার এক এক মাসে হয় তাই অবকাশ মিলতেই পারে এই উৎসবের সাক্ষী থাকার।