Sometimes it’s difficult to accept, to recognise one’s own mistakes, but one must do it. I was guilty of overconfidence and arrogance, and I was punished for that.
-Mikhail Gorbachev
১৯৭৭ সাল থেকে এই নিয়ে দশবার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হল, তার আগে অবশ্য সাতবার নির্বাচন হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেই তৈরি হয় পরিবর্তন বা প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা। কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে হাতেগোনা কয়েকবার- ১৯৬৭, ১৯৬৯, ১৯৭৭ এবং ২০১১ সালে। এর মধ্যে প্রথম দুটি পরিবর্তন স্থায়ী হয়নি, যদিও উন্মাদনা ছিল ব্যাপক। ১৯৭৭ আর ২০১১ সালের নির্বাচন তো ইতিহাস হয়ে রয়েছে। ২০১৬ সালেও পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল, অনেকে ভেবেছিল বামেরা আবার ফিরে আসছে, সে আশা পূরণ হয়নি। এই বছর বিজেপির পক্ষে ঝড়ো হাওয়া ছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও পরিবর্তন হয়নি। কেন পরিবর্তন হল না, তার বিশ্লেষণে যাবার আগে, এই নির্বাচনের কয়েকটি বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করব।
এক, স্বাধীনতা পরবর্তী কালে এই প্রথমবার এই রাজ্যে বিধানসভায় কংগ্রেস ও বামেরা কোনও প্রতিনিধি পাঠাতে পারল না। ১৯৫১ সালের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ১৫০ বিধায়কের সাথে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির ২৮ জন বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন।১৯৬৪ সালের ৭ই নভেম্বর তৈরি হওয়া সিপিআইএম ১৯৬৭ সালে প্রথমবার বিধানসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৪৩টি আসন পেয়েছিল, সিপিআই পেয়েছিল ১৬টি আসন। বামেরা ও কংগ্রেস এক সঙ্গে লড়ে ২০১৬ সালে ৩৮.৬ শতাংশ ভোট আর ৭১ টি আসন পায়। এবার তাদের যৌথ সংগ্রহ সাকুল্যে ৮.৬ শতাংশ ভোট। সরকারের বাইরে থেকে ‘বাম রক্তক্ষয়’ অব্যাহত। ২০১৬ সালে কিছুটা মুখ তুললেও, সাড়ে সতেরো লক্ষ ভোট নিয়ে কংগ্রেস এবার আর লড়াই এর জায়গায় নেই। অন্যদিকে, তৃণমূলের জয়রথ দ্রুত গতিতে চলছে। তাদের ভোট শেয়ার এবং আসন সংখ্যা দুই বেড়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা কিছুটা ব্যতিক্রম মাত্র। অন্যদিকে ৭৭টি আসন জিতে বিজেপি রাজ্য রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
দুই, পশ্চিমবঙ্গে এর আগে কোনও বিধানসভা নির্বাচনে এত কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী প্রচারে আসেননি। ২০১৯-এর লোকসভায় ১৮টি আসনে এবং ১২১টি বিধানসভায় এগিয়ে থাকার সুবাদে, বিজেপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আশা করেছিল বাংলার শাসন তাদের হাতের মুঠোয়! ক্ষমতার এত কাছাকাছি বিজেপি বা পূর্বে জনসংঘ কখনওই আসেনি। ১৯৫১ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে জনসংঘ ৫.৫৬% ভোট পেয়ে ৯টি আসন জিতেছিল– অবিভক্ত ২৪ পরগনার কুলপি এবং মেদিনীপুরের মোহনপুর, পটাশপুর, দাঁতন, পিঙ্গলা, নারায়ণগড়, ঝাড়গ্রাম, বিনপুর ও ভগবানপুর। এর পরে ফের জনসঙ্গের আসন প্রাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালে, জলঙ্গি বিধানসভা। ভারতীয় জনতা পার্টি আত্মপরিচয়ে এ রাজ্যে প্রথম আসন প্রাপ্তি ঘটে ১৯৯৯ সালে, অশোকনগর বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল সমর্থনে। তার পনেরো বছর পর বসিরহাট দক্ষিণে উপনির্বাচনে বিজেপি’র শমীক ভট্টাচার্য জয়ী হন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি তিনটি আসন জেতে, অন্য ৭ টি আসনে তারা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। এবার তাই বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। ছিল মুহুর্মুহু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘কার্পেট বোমা’ ছোড়ার ঢঙে প্রচার। উদ্দেশ্য, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া ও অপ্রস্তুত রাখা। বলা বাহুল্য, তাদের সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ হোল না, কিন্তু কেন?
১) জীবন, জীবিকার নানান স্বার্থে বাংলার এক বৃহৎ অংশের মানুষ সরকার পন্থী। বামফ্রন্ট চলে যাওয়ার বছরেও (২০১১) ৪১.১% ভোট পেয়েছিল । বোঝাই যাচ্ছে, সরকারে থাকা দলকে সরানো কতটা দুরূহ। তৃণমূল সরকার তার সমর্থন মজবুত করেছিল বিধবা ভাতা, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি সরাসরি ভাতামূলক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে। শহরের ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে থাকে, বস্তির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে আমোদ প্রমোদের জন্য সরকারি অনুদান তারা পেয়েছে। ভয় ছিল বিজেপি আসলে তাদের সেই অনুদান বন্ধ হবে কিনা। বিজেপি তাদের নির্বাচনী সংকল্প বার্তায় অনেক প্রতিশ্রুতির কথা বললেও, স্থানীয় প্রচারে সেগুলির তেমন উল্লেখ ছিল না। সুবিধাভোগী মানুষ এতদিন ধরে পেয়ে থাকা সুবিধা হারানোর ভয়ে বিজেপির দিকে আর ঝোঁকেনি।
২) বিজেপির ভোট কমেছে মূল ভোটের ২.৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৯ সালে যারা বিজেপি মুখো হয়েছিল তাদের প্রায় ১৫-১৬ লাখ দলের প্রতি হতাশ। এরা যদি নোটায় ভোট দিতেন বা ভোট দানে বিরত থাকতেন, বোঝা যেত দলের প্রতি তাদের অভিমান রয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র পক্ষে ৭৮.৬% ভোট পড়েছিল, এবার সেটা ৭৮.৩২%। নোটায় ভোট পড়েছে ১.০৮%, এটাই স্বাভাবিক ট্রেন্ড। ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিজেপি’র কমা ভোট তৃণমূলের ঘরে জমা পড়েছে। এই ভোটাররা নিশ্চয়ই বিজেপিকে শাস্তি দিতে চেয়েছেন, না হলে এরকমটা করতেন না। দলের মধ্যে দুর্নীতি, স্বজন পোষণ, একটু ‘নামকরা’ হলেই তার অহংকার, মাটিতে পা-না-পড়া ভাব, সাধারণ কর্মীদের উপেক্ষা, অন্য দল থেকে আশা নতুন নেতা কর্মীদের তাচ্ছিল্য, এসব হলেই দলের সমর্থক অন্য বিরোধী দলে ভোট দিতে পারেন। দলের প্রার্থী চয়নে অস্বচ্ছতা, পুরনো কর্মী সৈনিকদের উপেক্ষা করে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা নেতা আর টিভি সিরিয়াল করা নায়ক-নায়িকাদের প্রার্থী করার বেদনা অনেকে ভুলতে পারেননি। একই সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের হিন্দী ভাষণের বাংলা অনুবাদের ব্যবস্থা না রাখা এবং হিন্দী ভাষী প্রচারক/পর্যবেক্ষকদের হিন্দিতে জনসংযোগ চালানো বাঙালি ভোটারকে বিজেপি থেকে দূরে রেখেছে।
৩) বাংলায় সংখ্যালঘু ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূল কংগ্রেস ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এবং ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জোট সঙ্গী ছিল। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে রাজিন্দর সাচার কমিটি পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের সরকারি চাকুরিতে উপেক্ষার ছবি তুলে ধরতেই, তৃণমূল কংগ্রেস সংখ্যালঘু মন পেতে আগ্রহী হয়। ধীরে ধীরে বিজেপি সখ্য ত্যাগ করে। ইতিমধ্যে বাম সরকার ২০১০ সালে রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের ওবিসি কোঠায় ১০% সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিছু করার আগেই তাদের বিদায় ঘণ্টা বাজে। তৃণমূল ক্ষমতায় এসে ওবিসি’দের সংরক্ষণে প্রাধান্য দেয়, খুব দ্রুত সংখ্যালঘু বান্ধব ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলে। বাম ও কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়ায় তাদের সব সংখ্যালঘু ভোট চলে আসে তৃণমূলের দিকে। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের সংখ্যালঘু গড়– মালদহ, মুর্শিদাবাদ ভেঙে চুরমার হয় গেছে। মালদহের সুজাপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ১ লক্ষ ৫২ হাজার ভোট পায়, আর বাকি সবার জামানত জব্দ হয়। এবার তৃণমূলের ৪৩ জন সংখ্যালঘু বিধায়ক নির্বাচিত হলেন। সিপিআইএম-এর পলিটব্যুরো সদস্য, ‘ডাকসাইটে’ নেতা মহম্মদ সেলিম হুগলীর চণ্ডিতলায় মাত্র ১৮% ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থেকেছেন। চম্পাদানিতে বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নানও ১২% ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে থেকেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, সংখ্যালঘু ভোট পুরোপুরি গেছে তৃণমূলের দিকে।
৪) বাংলায় যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা দীর্ঘ দিন প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিলেন। জ্যোতি বসু ১৯৫১ সালের বিধানসভায় বরাহনগর থেকে সিপিআই-এর টিকিটে প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন, হারিয়েছিলেন বিখ্যাত জমিদার হরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীকে। তার আগে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভাতেও তিনি জেতেন। উপ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন ১৯৭৭ সালে। মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রথম সাংসদ হন ১৯৮৪ সালে, হারান হেভিওয়েট প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। তারপর দীর্ঘ আন্দোলন এবং আটবার সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকার পর ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন। বঙ্গ বিজেপিতে এই গোত্রের কোনও নেতা নেই। বাংলায় তেমন বড় আন্দোলন সংঘটিত করার ইতিহাসও নেই বিজেপির। ছোটো খাটো আন্দোলন হয়েছে, তার কোনও ফলো আপ ছিল না, ফলে সেই আন্দোলন জন মানসে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বহু কর্মী, দরদী শহীদ হবার পরও কোনও বাংলা বনধ হয়নি। বনধ ডেকে প্রতিবাদ, শক্তি প্রদর্শন বাংলা রাজনীতির বড় অঙ্গ।
বিজেপি জোরালোভাবে একটা ধারণা তৈরি করেছিল তারা ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসতে চলেছে। কিন্তু বাস্তবে বিজেপি কিন্তু সেভাবে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে পারেনি। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে জেরবার ছিল রাজ্য বিজেপি। সাধারণ মানুষের ইস্যুগুলোর থেকে দলের নেতৃত্বর কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত ইস্যুগুলি! দলে কে কত গুরুত্বপূর্ণ সর্বক্ষণ তা প্রমাণ করতেই বেশী ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের সেরকম প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। অথচ এ রাজ্যের রাজনীতিতে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা বিজেপি’র নেতাদের নিজেদের লোক বলে যে ভাবতেই পারেনি তা নির্বাচনের ফলাফলেই প্রমাণিত। কেবলমাত্র প্রচারমাধ্যমে ঝড় তুলে এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসা সম্ভব নয়। যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন নেত্রী বিপরীত দিকে রয়েছেন। এখন আর একথা বলতে দ্বিধা নেই ‘বাংলার নিজের ঘরের মেয়ে’র মোকাবিলা করার মতো এরাজ্যে বিজেপি’র কেউ ছিল না। যেটা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
টেবিল ১ : বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কে কত শতাংশ ভোট পেয়েছিল , ১৯৭৭-২০২১

- এখানে বৃহৎ বাম দলের তথ্য দেওয়া আছে -সিপিআই, সিপিআইএম, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লক অন্তর্ভুক্ত, সিপিআই ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের অংশ ছিল না।
- $ লোকসভা নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত বিধানসভা
টেবিল ২:বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা , ১৯৭৭-২০২১

# বিধানসভা এলাকায় আনুমানিক লিড।
Comments are closed.