পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন মানেই তুই বেড়াল না মুই বেড়াল। গলার শির ফুলিয়ে চিৎকার। আর সে চিৎকারের বেশিরভাগটাই অপরপক্ষ কতটা খারাপ তা প্রমাণ করার তাগিদ। কলতলার কোন্দল যাকে বলে। টিভি ডিবেটে, ব্রিগেডে, বক্তৃতায় কেবল কর্কশ শব্দ। কান ঝালাপালা। ‘ মানুষের জন্য’ই তারা নিবেদিত প্রাণ কিন্তু সাধারণ মানুষের ভালোলাগা মন্দলাগা নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই। উপরন্তু রয়েছে ভয়। মানুষের মৃত্যু দেখার ভয়। রাজনৈতিক হিংসা। এইসব আশঙ্কা এবং চিরকেলে একঘেয়েমির বাইরে যা ভালো লাগছে তা হল সৃজনশীলতা। তাও আবার ওই সাত পার্সেন্টের, যাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছিল না মানুষ, মিডিয়া, মাতব্বরেরা। সৃজনশীলতায় বামেরা চিরিকালই মেধা তালিকার উপরেই থাকে কিন্তু এবার নতুন কচি মুখের প্রার্থীর সঙ্গে মানানসই অনেক কিছু করছে যা বেশ আকর্ষণীয়। সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর প্রচারের চিত্রটাই আমূল বদলে গেছে। গান, ভিডিও তৈরি করে সেগুলো প্রচারের অস্ত্র কিংবা ব্রিগেডে লোক টানার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা এখন রাজনৈতিকদলগুলোর কৌশলের মধ্যে পড়ে। বিজেপি’র থিম মিউজিক ‘বেলা চাও’ আর সিপিএমের ‘টুম্পা সোনা’ অবাক করে দিয়েছে আমার মতো অনেককেই। ফ্যাসি বিরোধী ‘বেলা চাও’ বামেদের অত্যন্ত প্রিয় গান, বিভিন্ন ভার্সান ব্যবহার করেছে ওরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে, মিটিং-এ, মিছিলে। সেই গানের প্যারোডি করছে বিজেপি! এ তো কল্পনার অতীত! বিজেপি’র বিরুদ্ধে এই সেদিনও এই গান ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার জনপ্রিয়তাও কম হয়নি। আর অনুশাসন, সংস্কৃতি নিয়ে নানা মতামত দেওয়া, বিশুদ্ধ যাপনে বিশ্বাসী বাম দল তাদের ব্রিগেড সভার প্রাককালে টুম্পা সোনার প্যারোডি করে চমকে দিয়েছে বঙ্গবাসীকে। যদিও গানটির কথা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং সুরের চলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। রাজনীতির দাপটে, কুকথার জোয়ারে বঙ্গ সংস্কৃতির অবস্থা খুবই সঙ্গীন, তবুও বাম সংস্কতি এবং টুম্পা সোনাকে মেনে নিতে যথেষ্ট কুন্ঠিত মধ্যবিত্ত মানসিকতা। শ্লীল-অশ্লীল, চটুল-গম্ভীর নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই এ রাজ্যে। ঝুমা, মুন্নি, ফুলকলি, আনারকলি, টুনি এসব এতদিন ব্রাত্য ছিল মধ্যবিত্ত বাম-মতাদর্শী মানুষের কাছে। টুম্পা এতদিনে কল্কে পেল। ওদিকে মদন মিত্রের কুমড়ো নিয়ে গান “ওহ লাভলি” কিন্তু একটু পিছিয়ে পড়েছে এই দৌড়ে। হাতে কুমড়ো নিয়ে তাঁর গানে তিনি বিজেপি এবং দলত্যাগী তৃণমূলীদের আক্রমণ করেছেন। নিজের গানে তিনি নিজেই লিপ সিঙ্ক করেছেন কিন্তু তার উপস্থাপনা বাকি দুই থিম মিউজিকের ভিডিওর মতো ঝকঝকে হয়নি। কথাও তেমন আকর্ষণীয় নয়। তবে চমক কিন্তু ছিল। আর তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান ও গান ‘খেলা হবে’ কিন্তু যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। এইসব স্লোগান, গান গরম করছে ভোটের আবহাওয়া, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং চায়ের দোকান থেকে হোয়াটস গ্রুপ সব চত্ত্বরে হট টপিক এখন এই সবই।
গানগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, হয়েছে যথেষ্ট। শুদ্ধবাদীরা নাক সিঁটকেছেন। ছ্যা ছ্যা গোল্লায় গেল বলে চোখ কান বন্ধ করেছেন তবুও টুম্পা প্যারোডি সুপারহিট হয়েছে ইউ টিউবে এবং টুম্পা ২ এসে গেছে। বাম বিশুদ্ধ তাত্ত্বিকরা মনে করেন স্খলন যেন না হয় সংস্কৃতিতে। হোপ ৮৬ থেকে উষা উত্থুপ সব কিছুতেই তারা মুখ গোঁজ করে বলেছে, এই করেই বাম উচ্ছন্নে গেল। এসব না করেও ভরাডুবি হয়েছে, স্খলন আটকানো যায়নি, সুকান্ত ভট্টাচার্য, মায়াকোভস্কি আওড়ানোর পরেও বেনো জল ঢুকেছে এবং পরবর্তী ফলাফল তো সবার জানা। টুম্পা, লুঙ্গি ড্যান্স মানুষ শোনে বলেই তো আজ গানগুলো হিট। সেই মানুষগুলো কারা? ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে সেলিব্রিটি থেকে আম জনতাকে নাচতে দেখলাম এই গানগুলোয়। হামেশা এই দ্বিচারিতা মানুষ করে, উন্নাসিক থাকার দ্বিচারিতা। আমরা-ওরা করার ভুল করে ফেলি বোধহয় আমরা অজান্তেই। আমার মনে হয় টুম্পা সোনা নিয়ে হৈ চৈ হলেও হেমাঙ্গ বিশ্বাস, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীর শাশ্বত সৃষ্টিগুলো নেই হয়ে যায় না। বরং আরও বেশি করে জ্বলজ্বল করেন ওঁরা। বলতে দ্বিধা নেই আমারও নাক কুঁচকে ছিল কিন্তু তারপর দেখলাম মানুষ ওই সুরের সঙ্গে নতুন গানের যে শব্দ তা গেয়ে আনন্দ পাচ্ছে, নাচতে নাচতে ব্রিগেডে যাচ্ছে! গানের কথাগুলো হেলা করার নয়। উন্নাসিকতা মুলতুবি রাখলাম। এর আগে কৃষকদের নিয়ে বেলা ফন্টের জামাইকা ফেয়ারওয়েলের প্যারোডি তো অপূর্ব হয়েছিল।
বামেদের বাকি গান, স্লোগান, পোস্টার, দেওয়াল লিখন, মিম প্রভৃতিতে অভিনবত্ব চোখে পড়ার মতো। দল বদলের হিড়িক, তারকা প্রার্থীদের মেকি জৌলুস, হাস্যকর কথাবার্তা নিয়ে যতই মজা করি আসলে তো মন খারাপ হয়, হতাশ হই। কিন্ত প্রচারে সৃজনশীল মগজাস্ত্রের প্রয়োগ অনেকটা রিলিফ দেয়। ট্রেনে, বাসে, লাইটপোস্টের গায়ে যেমন হলুদ, কমলা বেগুনি ঝলসানো রঙের কাগজে মদ ছাড়ানোর, বশীকরণের, জ্যোতিষীর, তন্ত্রসাধকের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে আমাদের যাতায়াতের সময়, তেমন ছাঁদে তৈরি বামেদের বিজ্ঞাপনগুলি নিশ্চই চোখে পড়েছে! মজাদার বেশ।
তারপর ফ্ল্যাশ মব? আগে দেখিনি। এইবার প্রথমবার চোখে পড়ল। মিডিয়াও এসব দেখাতে বাধ্য হল। সাউথ সিটি মল থেকে বাইপাস, ভিক্টোরিয়া থেকে লেক মল ব্রিগেডের আগে ও পরে বিভিন্ন মোড়ে ফ্ল্যাশ মব নজর কেড়েছে মানুষের। আগে পথ নাটিকা হত, এখনও হয় বামেদের উদ্যোগে, ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নেয়। এবার নিজেরা গেয়ে, নেচে, পোস্টার, স্লোগান রঙিন পোশাকে চমকে দিয়েছে ফ্ল্যাশ মব। জেলে পাড়ার সঙের গানের আধুনিক রূপ বলা যায় কি একে? বিদেশে তো বেশ জনপ্রিয় এই আঙ্গিক।
গত কয়েকদিন হল শহরের পথে পথে ছুটছে ‘হাল্লা গাড়ি’। ১৯/২০ জনের দল নিয়ে শুরু হয়েছে পথ নাটক। শারীরিক কসরত ও নাচের ভঙ্গিমা, সঙ্গে জনপ্রিয় গানের প্যারোডি গেয়ে বিভিন্ন নাট্যদলের বাম মনোভাবাপন্ন নাট্যকর্মীরা তুলে ধরছেন বিজেপি, তৃণমূলের দুর্নীতির কথা। সংযুক্ত মোর্চার সমর্থনে চলছে জোর প্রচার। সফদর হাশমির ‘হাল্লা বোল’ স্লোগান থেকে প্রাণিত হয়ে এই গাড়ির নাম দেওয়া হয়েছে হাল্লা গাড়ি। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে এই গাড়ি প্রচার চালাবে। এছাড়াও পোস্টকার্ড, লিফলেট এবং সামাজিক মাধ্যমে জোরদার প্রচার চালাচ্ছেন বাম কর্মীরা নানা সৃষ্টিশীল উপায়ে।
বাকি দুটি দল পিছিয়ে রয়েছে সৃষ্টিশীলতার বহুমাত্রিকতা এবং জনপ্রিয়তায়। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে তারকাকে দলে টেনে এবং টিকিট না পাওয়া বিক্ষুব্ধদের হাজির করে। আর এসব নিয়ে একের পর এক গান বেঁধে, পোস্টার এঁকে, পোস্টকার্ড বানিয়ে, দেওয়াল লিখে চমকে দিচ্ছে বাম যুব সংগঠন।
Comments are closed.