এবার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ‘হাইভোল্টেজ’ কেন্দ্র নন্দীগ্রামে বৃহস্পতিবার যখন ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে তখন রাজ্যে প্রচারে এলেন নরেন্দ্র মোদী। গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল নন্দীগ্রামের উপর। যত বেলা গড়িয়েছে ততো দিনের তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বেড়েছে নন্দীগ্রামের উত্তেজনার পারদ। দুপুরে যখন বয়ালের বুথে মুখ্যমন্ত্রী তথা নন্দীগ্রামের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একের পর এক ফোন করছেন, বুথের বাইরে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বেজেপি’র কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তখন দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরে জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই জনসভা থেকে মোদী বলেন, ‘‘দিদিকে দেখুন। তা হলেই বুঝে যাবেন। দিদিই ওপিনিয়ন পোল, দিদিই এক্সিট পোল। ওঁর চোখ-মুখ, হাব-ভাবেই সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।’’ প্রধানমন্ত্রী হালকা চালে বললেও, কথাটি কিন্তু যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব বলছে, নন্দীগ্রামে ভোট পড়েছে ৮৮.০১ শতাংশ। পরিবর্তনকালে অর্থাৎ ২০১১ সালের নির্বাচনে এই ভোট পড়ার হার ছিল ৮৭.৯ শতাংশ এবং পরিবর্তনের পাঁচ বছর পরে অর্থাৎ ২০১৬ সালে এই ভোট পড়ার হার ছিল ৮৬.৯ শতাংশর বেশি। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝাই যাচ্ছে পরিবর্তনের পরিবর্তন আসন্ন। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দীর শারীরিক ভাষা বলে দিচ্ছে, ভোটে কী হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন অন্য দিনের থেকে যথেষ্ট বেশি আত্মপ্রত্যয়ী, অন্য দিকে মমতাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি বিষণ্ন, হতাশ। উনি নিজে সংবাদমাধ্যকে জানালেন, গণতন্ত্র বিপন্ন, উনি কোর্টে যাবেন। যে মানুষটির সাংবিধানিক ক্ষমতা তিনি স্বীকার করেননি কোনও দিন, সেই ‘পদ্মপাল’কেই ফোন করে বসলেন। ওনার দল অবশ্য ট্যুইট করে দিদির ‘ভি’ সংকেতকেই গুরুত্ব দিয়েছে। রাজ্যপাল অবশ্যই জানিয়েছেন, দিদির ফোন পেয়েছেন, গণতন্ত্র রক্ষায় যথাযত ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তাঁর ট্যুইট-এ ।
এখন প্রশ্ন, দিদি কেন নন্দীগ্রামে দাঁড়াতে গেলেন? এখানে ওনার কয়েকটা ধারণা কাজ করেছে, যে ধারনা থেকে উনি বেরতে পারলেন না-
১) ওনার ধারণা উনি পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি কেন্দ্রের যে কোনও জায়গায় দাঁড়ালে জিতবেন। ২০২১ সালে এই ধারণা যে বাস্তবসম্মত নয়, তা কেউ তাঁকে বোঝায়নি বা বোঝানোর ঝুঁকি নেয়নি।
২) উনি নন্দীগ্রাম ১ নম্বর ব্লকের ৩৪ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট দেখে আপ্লুত ছিলেন, ২ নম্বর ব্লকের সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা যে ১২ শতাংশ তা খেয়াল করেননি! সংখ্যাগরিষ্ঠরা বিপন্ন বোধ করতে শুরু করলে তুষ্টিকরনের রাজনীতি আর সুখকর হয় নয়। সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ালে এই জিনিস ঘটত না।
৩) উনি ভেবেছিলেন, নন্দীগ্রামে অধিকারীরা ‘কাগুজে বাঘ’। নির্বাচনে হারিয়ে অধিকারীদের জনবিছিন্ন করতে পারবেন। এই ধারণায় তিনি অত্যন্ত বেশি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
৪) ওঁনার ধারণা ছিল, নন্দীগ্রামে বিজেপি’র নিজস্ব কোনও শক্তি নেই, ২০১৯ সালে বিজেপি যে শুভেন্দুর সমর্থন ছাড়াই ৬২,২৬৮ ভোট পেয়েছিল তা বোধহয় তাঁর নজরে আনা হয়নি।
৫) উনি বামেদের হিন্দু প্রার্থী দেখে এতটাই উল্লসিত ছিলেন, ভেবেছিলেন সব হিন্দু ভোট বুঝি পেয়ে যাবেন! উনি খেয়াল করেননি ২০১৯ সালে বামেরা নন্দীগ্রামে মাত্র ৯,৩৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। মীনাক্ষী মুখার্জী যতই লড়াই করুন না কেন কোনও যাদুবলেই তা দ্বিগুণের বেশি বাড়তে পারে না।
৬) ২০১৯ সালে তৃণমূল নন্দীগ্রামে ১,৩০,৬৫৯টি ভোট পেয়েছিল, এর অর্ধেক শুভেন্দু নিয়ন্ত্রণ করলে কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা ভেবে দেখেননি একবারও।
৭) বামেদের প্রতি এতই ভরসা করেছিলেন, নন্দীগ্রামের মানুষের কাছেই চোদ্দ বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার ইতিহাসটাই পাল্টানোর চেষ্টা করলেন! জনগণের স্মৃতি খুবই স্বল্প, দিদি ভাবলেন ওটা ক্ষণিকের, বামেদের ঢালাও সার্টিফিকেট দিতে গিয়ে মানুষকে বুঝিয়ে দিলেন তৃণমূল-বাম সংযোগের তত্ত্ব ।
আর এতেই বিপদে পড়েছেন মমতা! তাঁর হারার আতঙ্ক এখন সর্বব্যাপী, আর এই আতঙ্ককে সঙ্গী করে বাকি ছয়টা পর্যায়ের নির্বাচন সামলানো তৃণমূলের পক্ষে মুশকিল। সে এখন যতই ‘ভি’ সংকেত দেখান এবং ‘‘আমিই জিতছি’’ বলুন না কেন।