বিদ্যাসাগর কেবল সমাজ সংস্কারক ছিলেন না তিনি আক্ষরিক অর্থেই নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। বাংলা ভাষাকে সাবলীল করতে বর্ণপরিচয় এর মতো ব্যাকরণ বই যেমন লিখেছেন তেমনি বাংলা হরফ তাঁরই হাতে সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বাংলা পুস্তক প্রকাশের গ্রন্থ স্বত্বের অর্থ নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ব্যয় করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে সব ধরনের সাহায্য,মায়ের মাধ্যমে গ্রামের বিধবা সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বাল্য বিবাহ রদ প্রভৃতি সংস্কারিত ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও সেদিন তাঁর বিরুদ্ধে ৫০০০ মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহিত হয়েছিল। এতদ সত্ত্বেও দ্বিশতবর্ষের আলোকে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার মতো দেদীপ্যমান। তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, “কী পুণ্য দিবসে তব শুভ অভ্যুদয় বিকীরিল প্রদীপ্ত প্রতিভা, বঙ্গ ভারতীর ভালে পরাল প্রথম জয়টিকা।”
গীতার সারসত্য ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ ও কর্মযোগের মধ্যে বিদ্যাসাগর কর্মযোগকেই নির্বাচন করলেন। হিন্দু ধর্মের বাহ্যিক আড়ম্বর থেকে অন্তর্নিহিত সত্যকে উদভাষিত করলেন। ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ঘাটালের বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক সংস্কৃত শিক্ষালাভের পর ১৮২৬ সালে বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে হাটাপথে কলকাতা যাত্রা। পথে মাইল ফলক দেখে ইংরেজি সংখ্যা চেনা। ১৮৩২ কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের ‘ব্যকরণ’ শ্রেণীর ছাত্র। তিরিশের দশকের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মানসিক অবস্থান আজও অজানা। মনে রাখা প্রয়োজন, ১৮৩৫-এর ২ ফেব্রুয়ারী মেকলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে রিপোর্ট পেশ করেন তা ‘মেকলে মিনিটস’ নামে খ্যাত। ভারতে শিক্ষার হাল এবং ব্রিটিশদের ভবিষ্যৎ ক্রমপন্থার প্রতিচ্ছবি। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ। বিদ্যাসাগর উপাধিতেই অধিক সমাদৃত।
১৮৪১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে হেড পন্ডিত হিসেবে যোগদান। ১৮৪৬ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ত্যাগ করে সংস্কৃত কলেজে মাসিক ৫০টাকা বেতনে সহকারী সচিব হিসেবে যোগদান। একবছর সময়ের মধ্যে সংস্কৃত কলেজের সচিব রসময় দত্তের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ। পরের বছর ১৮৪৭ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে সংস্কৃতযন্ত্র নামে ছাপাখানা স্থাপন করেন। ১৮৪৯ সালে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষার প্রথমভাগ ও দ্বিতীয়ভাগ প্রকাশিত হয়। সংস্কৃতযন্ত্র ছাপাখানা থেকে ১৮৫৫ সালে ২৪ পৃষ্টার বর্ণ পরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয়ভাগ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের করনিক তৈরীর প্রয়োজনে কলকাতা, বম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি বছরে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের সপ্তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৬ সালে বিদ্যাসাগরের কথামালা প্রকাশিত হয় এবং ১৮৯০ সালের মধ্যে কথামালার ৫১টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৮৫ সালে বর্ণপরিচয়ের ১৩৩তম সংস্করণ এবং ১৮৮৯ সালে ১৫০তম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মদনমোহনের ‘শিশু শিক্ষা’ তেমন গুরুত্ব না পেলেও ‘বর্ণ পরিচয়’ সমস্ত হিসেব পাল্টে দিতে সমর্থ হয়েছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল- বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৮), বোধোদয় (১৮৫১), শকুন্তলা (১৮৫৪), সর্বদর্শন সংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬), শিশুপাল বধ (১৮৫৭), মহাভারতের উপক্রমিকা (১৮৬০), সীতার বনবাস (১৮৬০), আখ্যামঞ্জুরী (১৮৬৩), দ্বিতীয়ভাগ (১৮৬৮), তৃতীয়ভাগ (১৮৮৮) ও ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯)।
রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টায় ১৮২৯ সালে ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহপ্রথা নিবারণ আইন পাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবা পুর্ণবিবাহ আইন পাশ হয়। রামমোহন নবজাগরণের যে আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলন করেছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি বাঙালীর জন্য রেখে গেলেন চলমান বাংলাভাষা, প্রাথমিক ও নীতি শিক্ষার জনপ্রিয় গ্রন্থাবলী এবং সঙ্গে বাংলামাধ্যম স্কুল ও নারীশিক্ষার সুদৃঢ় বুনিয়াদ।
নারীশিক্ষা প্রসারে কলকাতা থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বারাসাতে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় তৎকালীন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ প্যারীচরণ সরকার এবং কালীকৃষ্ণ মিত্রের সহযোগীতায় ১৮৪৮ সালে বারাসাত কালীকৃষ্ণ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৭-১৮৮৫ সালের মধ্যে বীরসিংহ-উদয়রাজপুর-রসুলপুর-গোবিন্দপুর-রিষড়া-সহ প্রথম দফায় সাতটি পরবর্তী পর্যায়ে আরও ২৮টি, মোট ৩৫টি স্কুল স্থাপন করেন। ৭ই মে ১৮৪৯ Calcutta Female School স্থাপন করেন। ডিসেম্বর, ১৮৫০ বিদ্যাসাগর মহাশয় বিদ্যালয়ের বৈতনিক সচিব এবং পরবর্তীকালে সরকার দায়ভার বহন করলে বিদ্যাসাগর বিদ্যালয়ের সচিব হন। বেন্টিঙ্কের মৃত্যুর পর স্কুলটি বেন্টিঙ্ক নামে পরিচিতি লাভ করে। কলকাতাতে মেট্রোপলিটন স্কুল স্থাপনা করেন। স্কুলের পরিচালনা নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ১৮৭২ সালে স্কুল কলেজে উন্নীত হয়, যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ হিসেবে পরিচিত।
বাংলাভাষার ভগীরথ বঙ্কিম চন্দ্রের আগে বাংলাভাষার ভিত্তি রচনায় ব্যাকরণ সিদ্ধ মুদ্রণ অক্ষর ও বানান সংস্কারের মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তক রচনা, প্রকাশনা ও বিপননের ব্যবস্থা এক হাতে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা পাঠ্য ও সাহিত্যের বিপুল ব্যবসায় তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। সেই কষ্টার্জিত অর্থ নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ, দান ও সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। বিদ্যাসাগর প্রকৃত অর্থে গীতা বর্ণিত কর্মযোগী।
তাঁর দ্বিশতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে মূর্তিভাঙার কারিগরদের প্রবন্ধ লিখে বলতে হয়, ‘‘মূর্তিভাঙা অবশ্যই ভুল ছিল’’। অথচ, দ্বিশতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত কলেজে তাঁরই মূর্তি ভাঙাতে প্রমাণ করল রবীন্দ্রনাথের খেদ উক্তি, ‘‘রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করনি’’।
সব শেষে কবি শঙ্খ ঘোষের কথা ধার করে লিখতে হয়-
‘‘১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে, ২৯ জুলাই শেষ হল একটা জীবনের ইতিহাস। শেষ হয়ে এল একটা শতাব্দীর ইতিহাস। কিন্তু থেকে গেল উত্তরাধিকার। দায়িত্ব তো ফুরোয় না। সেই দায়িত্ব বয়ে নিয়ে চলবে না আর একটা শতাব্দী? কোথায় তাঁরা ভূল করেছিলেন কতটুকু, কেবলমাত্র তার হিসেব নিতে গিয়ে কি সময় বইয়ে দেব আমরা?
সারাজীবন তাঁর তপস্যা ছিল মানবতার, তপস্যা মুক্তির। কোথায় সে মুক্তি, জীবনের মুক্তি, মানুষের মুক্তি- যা চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর? কে তুলে নেবে সেই তাঁর অসমাপ্ত কাজের ভার?
সে ভার তোমাদের সবার, সে ভার আমাদের সবার।’’
Comments are closed.