বাংলার পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহের স্ফুলিংগ থেকে ‘বন্দোমাতরম ওঁ’ আহরণ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আনন্দমঠে বন্দেমাতরম স্তোত্র সংযোজিত করলেন, যা আমাদের স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে পর্যবসিত হল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করলেন, ‘‘বন্দেমাতারম বাংলা দেশের বন্দনার মন্ত্র নয়- এ হচ্ছে বিশ্বমাতার বন্দনা।’’ সেই পবিত্র মন্ত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত করার অপচেষ্টা চলে।
বাংলায় সকলের প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ ভারত ভাগ্য বিধাতার ভাগ্য নির্ধারণে এত হিংসা কেন? বাংলার মাটিতে কাজী নজরুল ইসলামকে বলতে শুনি, ‘‘আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীনা, পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তাঁর চোখে চোখ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে ক্ষুধাদীর্ন মূর্তিকে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি।’’ (যদি আর বাঁশি না বাজে)।
বাংলা থেকে বিশ্ব বিজয় করে শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামীজী উচ্চারণ করতে পারেন, ‘‘সর্ব ধর্মের যিনি প্রসূতি স্বরূপ, তাঁহার নামে আমি আপনা দিগকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।’’ (স্বামীজীর শিকাগো ভাষণ)। বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে পূত আধ্যাত্মিকতায় বিলীন ঋষি অরবিন্দ স্মরণ করিয়ে দেন, ধর্মের অর্থ Religion থেকে অনেক ব্যাপক। পুরুষোত্তম রাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘‘গলিত অহংয়ের ফলিত প্রকাশ’’, সেই রামচন্দ্রের নামে জয়ধ্বনি বাংলায় নিষিদ্ধ, এমন কি কারাবাস ঘটে।
জাতীয় কংগ্রেসের শেষ বাঙালি সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসু পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সতর্কবাণী স্মরণ করি ‘‘আমরা যদি সত্যিই ভারতকে মহান করে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক সমাজের বেদীর উপর এক রাজনৈতিক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে।’’ বাংলার গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: লোকসভা নির্বাচন: পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে একটি পর্যালোচনা
দেশভাগের যন্ত্রণার মধ্যেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সৃষ্ট ‘‘হিন্দু হোমল্যান্ড’’ (পশ্চিমবঙ্গ) বামপন্থার গোলক ধাধায় দিকভ্রান্ত এবং আজ তুষ্টি করণের রাজনীতিতে পুষ্ট। দেশভাগের ক্ষত আর ইতিহাস ভোলাতে বারবার পশ্চিমবঙ্গকে বাংলা করার কুটিল প্রয়াস চলে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাংলার ইতিহাস ভুলে। সারাক্ষণ বাংলার নীড়ে ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি’ থেকে ‘দুর্বৃত্তের বাংলা’ তৈরি করতে প্রশাসনিক প্রধানের মুখনিসৃত শব্দবন্ধই যথেষ্ট।
এ বাংলার লজ্জা। এ বাঙালির লজ্জা!
মহামতি গোখেল বর্নিত বাংলা আর ভারতকে পথ দেখায় না। বরং রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী মনে করায় ‘‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।’’ রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে বলি, ‘‘মুক্ত করো ভয়, দুরুহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়।’’ পরিশেষে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর রবীন্দ্রনাথের প্রিয় কবিতার শেষ অংশ দিয়ে শেষ করি- ‘‘তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতের সেই স্বর্গে করো জাগরিত।’’