রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র মানেই জানে, ‘রাজনীতি হল রক্তপাতহীন যুদ্ধ। যুদ্ধ হল রক্তপাতময় রাজনীতি।’ পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-এর নির্বাচনে যুদ্ধ ও রাজনীতির মধ্যে কোনও পার্থক্য লক্ষ্য করা গেল না। ভোট গণতন্ত্রের উৎসব না হয়ে গণতন্ত্রের যুদ্ধে পরিণত হল। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অসমে বিজেপি ক্ষমতা ধরে রেখেছে, কেরলে এলডিএফ পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছে, তামিলনাড়ুতে এআইডিএমকে থেকে ডিএমকে’র ক্ষমতার বদল হয়েছে, পুদুচেরিতে কংগ্রেসের কাছ থেকে বিজেপি’র কাছে নীরবে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। আর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার আস্ফালনে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
যারা শীতলকুচির পুনরাবৃত্তি চাইছিলেন কিংবা চারটির পরিবর্তে আটটি লাশের বিধান দিচ্ছিলেন কিংবা সোজা বুকে গুলি করার বিধান দিয়ে বাংলার বাঘ হতে চাইছিলেন সেই নির্বোধ, অপদার্থ, কাপুরুষ নিজেদের নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। আর্ত মানুষের ফোন হয় ধরেননি, না হয় পরিষেবা উপলব্ধ নয় শুনিয়ে ক্ষান্ত করেছেন।
ভাষা সন্ত্রাসে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত। দশ কোটির জনসংখ্যার ৭ কোটি ভোটার ভোটের উত্তাপ নিল বিহ্বল চিত্তে, প্রত্যক্ষ করল খারাপ কথার প্রতিযোগিতা। কেউ বললেন, ক্ষমতায় এসে ভোটের পর দেখে নেবেন, ইনিই একসময় বলেছিলেন ‘বদলা নয় বদল চাই’, কিন্তু ২০১১-র পর থেকে রজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করছে কীভাবে বদল আর বদলা সমার্থক হয়ে উঠেছে। আবার কেউ বললেন বদলও চাই বদলাও চাই। ভোটপর্বের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকাতে উত্তাপ ততটা গায়ে লাগেনি। কিন্তু মঞ্চ থেকে ছোড়া অশ্রাব্য, উত্তেজক বাক্যবাণ হাওয়ায় মিলে যায়নি, থেকেছে হিংস্র শ্বাপদের অন্তরে ক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ও কেন্দ্রীয় বাহিনী সরতেই বাহিনী’র জায়গা দখল করেছে উন্মাদ ও লুঙ্গি বাহিনী। ২ মে, ২০২১ নির্বাচনের ফলফাল আসতে না আসতেই বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোচবিহার থেকে গোসাবা, নন্দীগ্রাম থেকে খানাকুল, বেলগাছিয়া থেকে সোনারপুর, চাকদাহ থেকে বসিরহাট জল্লাদবাহিনীর দাপাদাপিতে দশটির বেশি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। মহিলাদের শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করল। পার্টি অফিস থেকে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, দোকান, বাড়ি লুঠ করায় মধ্যে দিয়ে বাংলার গণতন্ত্রের উৎসব পূর্ণতা পেল!

সংবিধান প্রদত্ত অধিকার পদদলিত করে রাজভবনে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান হল। বাহিনীর সরে যাওয়া এবং নতুন সরকার গঠনের অন্তর্বর্তী সময়কে বেছে নেওয়া হল গণতন্ত্রের হত্যালীলা সংগঠিত করতে। যারা শীতলকুচির পুনরাবৃত্তি চাইছিলেন কিংবা চারটির পরিবর্তে আটটি লাশের বিধান দিচ্ছিলেন কিংবা সোজা বুকে গুলি করার বিধান দিয়ে বাংলার বাঘ হতে চাইছিলেন সেই নির্বোধ, অপদার্থ, কাপুরুষ নিজেদের নিরাপত্তা বেষ্টনি থাকা সত্ত্বেও আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। আর্ত মানুষের ফোন হয় ধরেননি, না হয় পরিষেবা উপলব্ধ নয় শুনিয়ে ক্ষান্ত করেছেন। এই বীরপুঙ্গব বাঘ সিংহরা সংবাদমাধ্যম, পুলিশ প্রশাসন বা অন্যভাবে সহায়তার বার্তা দিতে অক্ষম ছিলেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলের সর্বভারতীয় সভাপতির আগমনের আগ পর্যন্ত অপদার্থ কাপুরুষরা রাস্তায় বেরতে সাহস করেনি। একদিকে যেমন সরকার পক্ষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় বাংলায় রক্তপাত ঘটেছে তেমনি গঠনমূলক বিরোধী রাজনীতির পরিসর তৈরির অভাবে নিরীহ মানুষের রক্ত ঝড়েছে। সেই রক্ত লেগেছে মাননীয়ার হাতে, যা ভাগিরথী নদীতে ধুলে ভাগিরথীর জল রাঙা হবে কিন্তু হাতের রক্তের দাগ যাবে না। সত্যিই তো কাটা হাত থেকে ঘাসফুলের সৃষ্টি। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে কেন? এ যেন রোম পুড়ছে নিরো বেহালা বাজাচ্ছে। এই জল্লাদের ভূমি আমার বাংলা নয়। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলি, হে, ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো।
Comments are closed.