বিদ্যা ভিনসেন্ট যখন বেড়ালটাকে প্রশ্রয় ও আশ্রয় দিচ্ছে টেবিলের নীচে তখন আপনার গা শিউরে উঠতে বাধ্য শেরনির কথা ভেবে। তাকে বাঁচানোর জন্য লড়ে যাচ্ছেন বিদ্যা। সেও শেরনির মতো অসহায় কারণ জঙ্গল বাঁচাতে তৎপর কর্তৃপক্ষ, তাঁর মতো গুটিকয় মানুষ আছে যারা জঙ্গলকে ভালোবাসে সত্যিই, আগলে রাখতে চায় বুক দিয়ে। দাঁত চিপে থাকতে থাকতে বেড়ে যায় জেদ, সাহস, লড়ে যাওয়ার ইচ্ছে। ওই বাঘিনীর মতোই। বাঘ বাঁচানোর লড়াই বনাম বাঘ মারার লড়াই চলতে থাকে একই সঙ্গে। না, চোরা শিকারীর সঙ্গে নয়। নিজের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সহকর্মীদের সঙ্গে, সিস্টেমের সঙ্গে, সরকারের দায়সারা মনোভাব, রাজনীতির বোড়ে হয়ে যাওয়া মানসিকতার সঙ্গে।
‘শেরনি’ ছবি জুড়ে রূপকের ব্যবহার। নিউটনের পরিচালক অমিত মাসুরকরের কাছে তো এসবই প্রত্যাশিত ছিল। প্রান্তিক মানুষের ওপর টান আছে এই পরিচালকের। আমাদের দেশের যেসব রাজ্যের প্রান্তসীমা জঙ্গলের মধ্যে পড়েছে, আমরা কতটুকু জানি সেইসব সীমান্তপ্রদেশের মানুষগুলো সম্পর্কে? আমরা তো বাঘ দেখতে যাই, সাফারি করি, সেলফি তুলি, ট্রাইবাল স্মারক কিনি আর ফিরে এসে গল্প করি বাঘ দেখার। ওই সব মানুষগুলোকে জঙ্গল নিয়ে ঘর করতে হয়। বন্য জন্তু, ভয়, ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার লড়াই তাদের রোজের ব্যাপার। ছাগল চড়াতে গিয়ে, শুকনো কাঠ কুড়োতে গিয়ে, তাদের প্রাণ দিতে হয়। বাঘ টেনে নিয়ে যায়, ভাল্লুক তাড়া করে, মৃত্যু নিয়ে তারাও শোক করে কিন্তু এ যেন মেনে নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ঘটনা। জঙ্গল ছোটো করে শিল্পাঞ্চল হয়, তামার সন্ধান পাওয়া গেছে তাই শিল্পপতিরা জঙ্গল ছেঁটে ফেলার ফরমান দেয়, আদিবাসিন্দারা ঠাঁইনাড়া হয়, নদীর ওপরে বাঁধ হয়ে যায়, সরকারের ভুল নীতির মাশুল দেয় ওরা। কমতে থাকা জঙ্গলের পশু গ্রামে ঢুকে পড়ে খাবারের আশায়। তারপর বাঘ শিকার আসলে ভোট পাবার রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড হয়ে যায়। একদল বাঘ মারতে চায় আর একদল আদিবাসীদের স্বাধিকার চায়। গ্রামও বিভক্ত হয়ে যায় নানা দলে।
শেরনি দেখে তো আমরা বুঝতেই পারি যে ভোট, রাজনীতি, মানুষখেকো বলে প্রচার করার কৌশলে কীভাবে উস্কে দেওয়া হয়েছিল মানুষের আবেগ। আর আসল ক্ষেত্রেও তেমনি রাজনীতির অনেক ঘোরপ্যাঁচ তাই তো অবনিকে মারার পুরো বিষয়টি বিচারাধীন এখনও।
টি ১২, টি ১, বিদ্যা ভিনসেন্ট, প্রফেসর হাসান নুরানি এই বিরাট চক্রবুহ্যের মধ্যে খাবি খায়। সে এক অদ্ভুত জটিল পাকচক্র। বিশেষজ্ঞ, দায়িত্ববান কর্মী, ব্যাঘ্র সম্পদ এসব মূল্যহীন হয়ে যায় ইগো, মুদ্দা ও দায়সারা তাৎক্ষনিক সমাধানের কাছে। এখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ, মূলধারা ও প্রান্তিক মানুষের মানসিকতা, চিন্তাভাবনা ও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে তফাত তৈরি হয় তা হিমালয় সমান। তাই এই দেশে মানুষ ও অ্ন্যান্য প্রাণীর মধ্যের সম্পর্কও বেশ জটিল ও সুবিধাজনক নয় একেবারেই। সেখান থেকেই বিরোধ এবং সরকারি বিভাগগুলোর সম্যক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব সেই বিভেদ এবং বিভেদজনিত বিপদকে আরও জটিল করে তুলেছে। যে সত্য ঘটনার ওপর নির্ভর করে ‘শেরনি’র প্লট নির্মাণ করা হয়েছে সেই ঘটনার কথাই ধরুন- মহারাষ্ট্রের পান্ধারকাওয়াড়ার জঙ্গল সীমান্তের বাঘিনী, টি ১, অবনি ১৩টি মানুষকে মেরেছিল বলে রটনা। যদিও এই পরিসংখ্যানও পরে প্রমাণিত হয়েছে ভুল হিসেবে। ডিএনএ রিপোর্ট বলছিল অবনি মেরেছে মাত্র তিনজনকে। মানুষখেকো বাঘের বিভীষিকায় জর্জরিত গ্রামের মানুষ। সরকার চেয়েছিল শিকারী নিয়োগ করে অবনিকে মেরে ফেলতে। হলও তাই। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত আন্দোলনকারীরা মামলা করেছিল সুপ্রিম কোর্টে। কোর্টের রায় তাদের বিপক্ষে যায়। ছবির মতোই জ্যান্ত বাঘিনীকে না ধরে তাকে মেরে ফেলা হয়। ঘুমপাড়ানি গুলি ছুঁড়ে ঘুম পাড়িয়ে এবং পরে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম মানা হল না। শিকার না শেখা, দুগ্ধপোষ্য, অভুক্ত দুটি শাবককে অবনির মৃত্যুর পর গ্রামের কিছু সহৃদয় মানুষের সাহায্যে বাঁচানোর চেষ্টা করে বিদ্যা ভিনসেন্ট, সিনেমায় দেখেছি আমরা। আর বাস্তবে সমালোচনার ঝড় ওঠে, মিছিল হয় সরকারি মদতে শিকারের ঘটনার বিরুদ্ধে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের শিকারী দিয়ে বাঘ মারার ঘটনাকে “পরকল্পিত খুন”-এর আখ্যা দেয় আন্দোলনকারীরা। কিছু গ্রামবাসী আবার উদযাপন করে নরখাদকের মৃত্যু। এই দেশে প্রাণী সংরক্ষণ কী ভীষণ কঠিন তা বুঝতে পারবেন দর্শক ছবিটা দেখে।

বাস্তবের বিদ্যা অর্থাৎ ওই জঙ্গলের সত্যিকারের ডেপুটি কনজারভেটর ছিলেন কে এম অবর্ণা এবং তিনি মনে করেন অনেক ফারাক রয়েছে গল্পে আর ছবিতে। তাঁর ডাকাবুকো চরিত্রের আদলেই বিদ্যার চরিত্রটি নির্মিত হয়েছে। অবর্ণা মুখ্য বনপালকে লেখা চিঠিতে জানিয়েছিলেন দু দুবার সুযোগ ছিল ঘুম পাড়ানো গুলি মেরে অবনিকে বাগে আনার, সেই সুযোগ নষ্ট করা হয়েছে। শেরনি দেখে তো আমরা বুঝতেই পারি যে ভোট, রাজনীতি, মানুষখেকো বলে প্রচার করার কৌশলে কীভাবে উস্কে দেওয়া হয়েছিল মানুষের আবেগ। আর আসল ক্ষেত্রেও তেমনি রাজনীতির অনেক ঘোরপ্যাঁচ তাই তো অবনিকে মারার পুরো বিষয়টি বিচারাধীন এখনও।
২৯শে জুলাই সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্র দিবস, বাঘ সংরক্ষণের দিন। ২০১০ সালে রাশিয়ার সম্মলনে এমন চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছিল। এই দিনে ক্রমশ ফুরিয়ে যাওয়া বাঘেদের রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা পালন করে সমগ্র বিশ্ব। তাইতো এই সংক্রান্ত খবরের মাঝে মনে পড়ে গেল ‘শেরনি’ ছবিটার কথা। বিদ্যা ভিনসেন্টের কাজ বদলে যায়! শেষ দৃশ্যে বুঝতে পারি তাকে দেওয়া হয়েছে রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্ব। অন্যরকম সংরক্ষণ। প্রাণীদের অপার্থিব খোলসের মাঝে, জাদুঘরে তাকে আবারও অসহায় লাগে। তবে তাঁর আগের রূপই জ্বলজ্বল করে ওঠে বারবার মনের মধ্যে, ছবির প্রথমভাগে লড়াইয়ের মাটি না ছেড়ে সে চেষ্টা করছিল সমস্ত নেতিবাচক মানসিকতার বিপক্ষে গিয়ে রুখে দাঁড়াবার… জঙ্গলকে ভালোবেসে, বন্য প্রাণকে ভালোবেসে।