১১ জুন, ২০২১

২০১৮’র সেপ্টেম্বরে আমাদের শেষবার হারিয়েছিল রোনাল্ডোর পর্তুগাল। তারপরে টানা ২৭টা ম্যাচ অপরাজিত থেকে আমাদের ইউরো অভিযান শুরু হল আজ, তুরস্কর বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলে। তুরস্ককে ৩-০ হারিয়ে দিলাম আজ প্রথম ম্যাচে। প্রথমার্ধে গোলশূন্য ছিল। তখন মেপে খেলছিল ইটালী। ২য় অর্ধে খোলস ছেড়ে বেরোতেই তিন গোল। ৫৩ মিনিটে ডেমিরালের আত্মঘাতী গোল, ৬৬ মিনিটে ইম্মোবিলের গোল আর ৭৯ মিনিটে ইনসিগ্নের গোল পার্থক্যটা গড়ে দেয়। অফেন্সিভ ইটালীকে বড় ভালো লাগল আজ।

৩-০ গোল। ১টা ম্যাচ খেলে ৩। শুরু হিসেবে মন্দ না।

১৬ জুন, ২০২১

গ্রুপে ২য় খেলা ছিল আজ রজার ফেডেরারের দেশের বিরুদ্ধে। শক্তিশালী দল ছিল সুইসরা। কিন্তু ১ম অর্ধে ১ গোল আর ২য় অর্ধে ২ গোল দিয়ে আরামেই ম্যাচটা বের করল ইটালী। লোকাতেলির ২ গোল (২৬ এবং ৫২ মিনিট) আর ইম্মোবিলের ১ গোলের (৮৯ মিনিট) সূত্রে এ ম্যাচটাও বেরিয়ে গেল ৩-০ গোলে।

আবার ৩-০ গোল। ২টো খেলে ৬। চলো আজুরি।

২০ জুন, ২০২১

গ্রুপে ৩য় তথা শেষ খেলা ছিল আজ, ওয়েলশের বিরুদ্ধে। বাজে খেলেও ১-০ গোলে জিতলাম আমরা ম্যাচটা। গোলদাতা পেসিনা, ৩৯ মিনিটে হল গোলটা। আজ আত্মসন্তুষ্টি ছিল আমাদের খেলাতে।

তিনটে খেলাই খেললাম রোমে। ৩টে খেলে ৯ পয়েন্ট পয়ে আমরা প্রথম টিম হিসেবে চলে গেলাম “রাউন্ড অফ ১৬”য়ে। গোলের হিসাব ৭-০।

২৬ জুন ২০২১

লন্ডনে আজ অতিরিক্ত সময়ে হারালাম অস্ট্রিয়াকে, ২-১ গোলে, চলে গেলাম কোয়ার্টার ফাইনালে। আশানুরূপ খেলা আজও খেলেনি আজুরিরা, নির্দিষ্ট ৯০ মিনিটে গোলও পায়নি, খেলা দেখে জেতার তাগিদ খুঁজে পাইনি। অতিরিক্ত সময়ে মরিয়া ছিল টিম, অনেক বেশী আক্রমণও হল। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটেই ২-০ লিডও এল। ৯৫ মিনিটে চিয়েসা আর ১০৫ মিনিটে পেসিনা গোল দিলেন। অতিরিক্ত সময়ের ২য় অর্ধে আবার সেই কুখ্যাত আত্মবিশ্বাস ঘিরে ফেলল টিমকে, অস্ট্রিয়ার কালাডিক একটি গোল শোধ করলেন ১১৪ মিনিটে,  টুর্নামেন্টে ৩৮৩ মিনিট আমাদের গোল অক্ষত থাকার পরে প্রথম গোল খেলাম আমরা।

এবার কোয়ার্টার ফাইনাল, মিউনিখে। প্রতিপক্ষ আগামীকালের বেলজিয়াম-পর্তুগাল ম্যাচের বিজয়ী দল।

২ জুলাই, ২০২১

২৭ জুন টি হ্যাজার্ডের গোলে রোনাল্ডোর পর্তুগালকে হারিয়ে দিয়েছিল বেলজিয়াম। তাই আজ মিউনিখে আমরা কোয়ার্টার ফাইনালে খেললাম বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে। আজ অন্য ইটালীকে দেখলাম। এতটা আক্রমণাত্মক এই ইতালীকে অনেকদিন পরে দেখলাম। চাপের ফলে ফাটল দেখা দিল লুকাকু-হ্যাজার্ডদের মাঝমাঠ ও রক্ষণে। ফলশ্রুতিতে আমাদের হয়ে গোল করলেন ৩১ মিনিটে বারেলা আর ৪৪ মিনিটে ইনসিগ্নে। কিন্তু তারপরেই একটা ঝটকা দিল বেলজিয়াম। প্রথমার্ধের ইনজুরি টাইমে পেনাল্টি পেল বেলজিয়াম আর গোল করে দিলেন লুকাকু। ২-১য়ে হাফটাইম হল।

তীব্র লড়াই হল ২য় অর্ধে, যাতে সব হল, গোল ছাড়া। ২-১ গোলেই জিতে মাঠ ছাড়ল ইটালী। ১১ গোল দিয়ে ২টো গোল খেয়েছি আমরা এবারের ইউরোতে, এবারে, এখনও। এই নিয়ে টানা ৩২টা ম্যাচ আমরা অপরাজিত রইলাম। ওদিকে আজই স্পেন টাইব্রেকারে হারিয়ে দিল সুইসদের, আমাদের বিরুদ্ধে লন্ডনে সেমিফাইনাল খেলবে ওরাই।

৬ জুলাই, ২০২১

স্পেনের নিজেদের মধ্যে পাস খেলার বিপরীতে স্ট্র্যাটেজিকালি আজ কোচ মানচিনি দুর্গরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলেন লন্ডনে। আর দ্রুত কাউন্টার অ্যাটাকে তুললেন দলকে। গোলশূন্য ১ম অর্ধের পরে চিয়েসা কাউন্টার অ্যাটাক থেকেই গোল দিলেন ৬০ মিনিটে। তারপর মরিয়া হল স্পেন। ২০ মিনিট পরে সেই গোল শোধ করলেন মোরাতা। ১-১ অবস্থায় শেষ হল খেলা।

টাইব্রেকারে ১ম শট মিস করল দু’দলই (লোকাতেলি আর ওলমো)। ২য় শটে বেলোত্তি আর জেরার্ড দু’জনেই গোল করে ১-১ করলেন। ৩য় শটেও দু’দলই গোল করে ২-২ করল, গোল দিলেন বোনুচি আর থিয়াগো। ৪র্থ শটে আমাদের বেমারদেচি গোল করলেও গোল করতে ব্যর্থ হলেন স্পেনের মোরাতা। ফলে ৪র্থ শটের শেষে ফল দাঁড়ায় ৩-২। ৫ম শটে জরজিনহো গোল দিতেই ৪-২ হয়ে গেল স্কোর, স্পেনের ৫ম শট নেওয়ার প্রয়োজনই হল না আর।

টানা ৩৩ ম্যাচ অপরাজিত থেকে ইউরো ফাইনালে চলে গেলাম আমরা। স্বপ্নের মতো ঘটে গেল সবকিছু, ঘোরের মতনও।

১০ জুলাই, ২০২১

আমাদের সঙ্গে তুরস্কর ম্যাচ দিয়ে ১১ জুন ২০২১ তারিখে রোমের ‘অলিম্পিক স্টেডিয়াম’-এ হয়েছিল করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া ২০২০র ইউরোর বোধন। একমাস ব্যাপী ফুটবল উৎসবের ৩০ দিন আজ। একদিন পরেই ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফাইনালে খেলবে আমার ইটালী আর আয়োজক ইংল্যান্ড।

আমি তো শুনেছি, ইউরোপের যেকোনও দেশের থেকেও এই টুর্নামেন্টের ভিউয়ারশিপ সবচেয়ে বেশি হয় এশিয়ার একটা দেশের একটা রাজ্যে। এবারও শুনলাম তার ব্যতিক্রম হয়নি। এটাই এই টুর্নামেন্টের আসল জয়। পৃথিবী ছাড়া কোথাও ফুটবল খেলাটা নেই আর ফুটবল ছাড়া কোনও খেলার জন্য রাখা নেই সাধারণ মানুষের এত ভালবাসা। জয় ফুটবল।

আজও আমার হাতে একটা নতুন ডায়েরী, যা লেখা শুরু করেছিলাম ওই ১১ জুন ২০২১ তারিখে। হুইলচেয়ারে বসে বসে ইউরোর ডায়েরী লেখাটা শেষ হয়ে যাবে ১১র ফাইনালের পরে। তারপরে হয়ত আর লিখব না এই ডায়েরী। তবে ফেলে দেব না কোথাও যদি ফাইনালে জিতি আমরা। আর নইলে…জানি না। 

যদিও ইংল্যান্ডও শক্তিশালী দল। স্টার্লিং-কেন-ম্যাগুইরিরা সেমিফাইনালের আগে কোনও গোল খায়নি এবার ইউরো-তে, “রাউন্ড অফ ১৬”তে হারিয়েছে জার্মানীর মতো শক্তিশালী দলকে। মোট গোলের গড় ওদের এখন ১০-১। তবে ওই সেমিফাইনালেই ডেনমার্কের বিরুদ্ধে তিন বিতর্কে জড়িয়েছে ইংল্যান্ড – ভুল পেনাল্টি দেওয়া, গোলকিপারের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে লেজার রশ্মি ব্যবহার এবং জোড়া বল। 

সেদিন ৭ জুলাই ডেনমার্কের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সময়ে জোয়াকিম মাহেলের চ্যালেঞ্জ সামলাতে না পেরেই বক্সে পড়ে যান রহিম স্টার্লিং, তারপরেই পেনাল্টি দেওয়া হয় ইংল্যান্ডকে। কিন্তু ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, রাহিম স্টার্লিং প্লে এক্টিং করে পেনাল্টি আদায় করেছেন। 

হ্যারি কেন পেনাল্টি নিতে যাওয়ার সময় দেখা যায় ড্যানিশ গোলকিপারের মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য লেজার রশ্মি প্রয়োগ করছেন বেশ কিছু দর্শক। তা সত্ত্বেও ১০৪ মিনিটে হ্যারি কেনের পেনাল্টি বাঁচিয়েও দেন ড্যানিশ গোলকিপার ক্যাস্পার স্কিমিচেল। যদিও  রিবাউন্ড থেকে গোল করে যান কেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেজার বিম কান্ড নিয়ে ইংল্যান্ডকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হচ্ছে।

এছাড়াও মাঠে জোড়া ফুটবল দেখেও অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। স্টার্লিং যখন ফাউলের জন্য পেনাল্টি আদায় করে নিলেন সেই সময়েই রিপ্লেতে দেখা গেল মাঠে একই সঙ্গে দুটো বল। নিয়ম অনুযায়ী, জোড়া বল কোনওভাবে মাঠে একইসঙ্গে খেলা চলাকালীন থাকলে সঙ্গেসঙ্গেই খেলা বন্ধ করে দিতে হয়।

এখনও একবারের জন্যও ইউরো কাপ জেতেনি ইংল্যান্ড। তাই কালকের ফাইনাল ইংল্যান্ডের কাছে স্বপ্নপূরণের, প্রথমবার ইউরো কাপের স্বাদ নেওয়ার। এছাড়া ইংল্যান্ড চাইবে সেমিফাইনালের সব বিতর্কর জবাব ফিরিয়ে দিতে।

১৯৫৮র বিশ্বকাপের পরে ২০১৮ই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ, যেটায় আমরা ফাইনাল পর্যায়ে খেলিনি। সেই জ্বালা, যন্ত্রণা আর দুঃখ আজও আমাকে কুরে কুরে খায়। এই ইউরো ফাইনালের লড়াই আমার আর ইতালীর কাছে গত বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার জ্বালা, যন্ত্রণা ও দুঃখ মেটানোর ফাইনাল। এটা আমাদের জিততেই হবে, যেকোনও মূল্যে।

১৯৬৮র পরে তো আর ইউরো কাপ জিতিনি আমরা। ২০০০ আর ২০১২তে ফাইনালে পৌঁছেও যথাক্রমে ফ্রান্স আর স্পেনের কাছে হেরে গিয়েছিলাম আমরা। তাই ২০১৮’র দুঃখ, জ্বালা, যন্ত্রণা ভোলা এবং ৫৩ বছর পরে ইউরো কাপ জেতা, দুটো পাখিই এক ঢিলে মারা যাবে কাল ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিলে। তাই কাল আমাদের জিততেই হবে ইউরো কাপের ফাইনালে, যেকোনও মূল্যে।

-এক অখ্যাত ইতালীয়ান।

(সম্পূর্ণ কাল্পনিক)