শনিবার (২৯ মে) সিপিআই(এম)-এর রাজ্য কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল ভোটে বাম-কং-আইএসএফ জোটের ভরাডুবি। এই বৈঠকে ভোটের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে আব্বাস সিদ্দিকির দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোট গঠন নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন সিপিআই(এম)-এর একাধিক রাজ্য কমিটির সদস্য। তাঁদের এই ক্ষোভ কতটা বাস্তবসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ তা পর্যালোচনা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।
এবারের (২০২১) বিধানসভা নির্বাচনে কং-বাম-আইএসএফ জোট নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। এটা শুরু হয় জোট গড়ার প্রস্তুতি পর্বে। জোট তথা সংযুক্ত মোর্চা গঠন করার পর চর্চার তীব্রতা অনেকটা বাড়ে। সেটা আকাশচুম্বী হয় নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার ভরাডুবি হলে।
চর্চার প্রধান অভিমুখ মূলত একটিই
জোট গঠনের প্রস্তুতি পর্বেই চর্চা বা আলোচনার একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ পরিলক্ষিত হয়। অভিমুখটি মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হল তারা কমিউনিস্ট পার্টির ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বিসর্জন দিয়ে একটি ইসলামী মৌলবাদী দলের সঙ্গে জোট করেছে। নীতিগত এই সমালোচনা প্রাপ্য ছিল কংগ্রেস দলেরও। কিন্তু সমালোচনায় বিদ্ধ করা হচ্ছে শুধু সিপিআই (এম)-কেই। এই সমালোচনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তা হল, সমালোচকদের মধ্যে মূলত প্রাধান্য রয়েছে তাদেরই যারা সিপিআই (এম)-এর ঘোরতর বিরোধী। এই সমালোচকরা মনে করে যে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিআই (এম)-এর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই আর অবশিষ্ট নেই। তাদের একপেশে ও নেতিবাচক সমালোচনায় আমার মনে যুগপৎ বিষ্ময় ও একটা প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রশ্নটি হল, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সিপিআই (এম) আদৌ আর কমিউনিস্ট পার্টি নেই, তাদের তো ‘ইসলামী মৌলবাদী দলের’ সঙ্গে জোট করাই স্বাভাবিক। তাহলে তারা তাদের ‘নীতিচ্যুত’ হওয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? তারাই দেখছি নীতির প্রশ্নেই দলটাকে লাগাতার ছিঁড়ে খাচ্ছে। ওদের সিপিআই (এম) – এর পেছনে জোঁকের মতন এই লেগে থাকা বিষ্ময়কর বৈকি! এই গোত্রের সমালোচকরা সবাই যে কমিউনিস্ট বিদ্বেষী তা কিন্তু নয়, ওদের মধ্যে একদল মানুষ আছে যারা বামপন্থায় বিশ্বাসী। এই সমালোচকদের তো সিপিআই (এম) – এর ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে অতিরিক্ত কথা বলার কোনও অর্থই হয় না।
আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে সিপিআই (এম)-এর ভিতরেও প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে দলের সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যেও। ফলে ঘরে ও বাইরে সর্বত্রই দলের নেতৃত্বকে প্রবল সমালোচনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এর আগেও জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না করা, সোমনাথ চ্যাটার্জীকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা এবং পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার প্রশ্নে দলের ভিতরে ও বাইরে প্রবল সমালোচনা সামাল দিতে হয়েছিল। এই ইস্যুগুলি ছিল সবটাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার দলের রাজ্য নেতৃত্বকে ঘরে ও বাইরে নীতিগত প্রশ্নে যেভাবে কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে তা একেবারেই নজিরবিহীন।
যত জ্বালা সব পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীকে নিয়ে
দলের ভিতরে ও বাইরে সিপিআই(এম)-কে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়েও কম প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। সে সমালোচনা আজও রয়েছে। কিন্তু এই ইস্যুটি এবার কার্যত চাপা পড়ে গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে সামনে উঠে এসেছে আব্বাস সিদ্দিকী ও তাঁর দল আইএসএফ ইস্যুটি। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন থেকেই সিপিআই(এম)-এর জনসমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। এবারও সেটাই হয়েছে। এর জন্যে মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই(এম)-কে আইএসএফকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসও যে নির্বাচনে একটি আসনও পায়নি তারজন্যেও মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই(এম)-কেই। দায় চাপানোর ভঙ্গিটি এমনই যে আইএসএফকে জোটে না নিলে কংগ্রেস ও বামফ্রণ্টের ফল যেন ভালো হত। বামফ্রণ্টের শরীক দলগুলিও নির্বাচনে ভরাডুবির জন্যে দায়ী করছে সিপিআই (এম)-কে আইএসএফের সঙ্গে জোট করাকে। তারা এমন ভাব দেখাচ্ছে যে আইএসএফকে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠনে যেন তাদের সম্মতি ছিল না। অথচ বাস্তব সত্যিটা হল আইএসএফকে জোটে নেওয়ার প্রশ্নে ফ্রণ্টের মধ্যে কয়েক দফা আলাপ আলোচনা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐক্যমতের ভিত্তিতেই আইএসএফকে জোটে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করা হয়েছে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল আইএসএফ এর নাম ও পতাকা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থাৎ আব্বাস সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে আসেননি, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনেই তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চান তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন তাঁর দলের নামকরণ ও পতাকার রঙ নির্বাচনে। রাজনৈতিক দল তৈরি করে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঘোষণা যখনই তিনি দেন তখনই গোটা রাজ্য তোলপাড় শুরু হয়। তাঁর সভা সমাবেশগুলিতে ব্যাপক জনসমাগম হচ্ছে দেখে শাসকদল ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায়। তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক নিয়ে। ফলে তাঁকে জনগণ থেকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে, বিচ্ছিন্ন করার অভিযানে নামে শাসকদল। সে কাজে ফুরফুরা শরীফের প্রধান পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকীও নগ্নভাবে শাসকদলকে সঙ্গ দেন। তারা একযোগে আব্বাসের বিরুদ্ধে দুটি মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করে। অভিযোগ দু’টি হল,
- আব্বাস সিদ্দিকী একজন উগ্র ও গোঁড়া মুসলমান এবং একটি কট্টর মুসলিম সাম্প্রদায়িক দল তৈরি করে বিজেপির হাত শক্ত করতে চান।
- বিজেপি তাঁর পেছনে প্রচুর অর্থ ঢালছে তাঁকে দিয়ে মুসলিম ভোট কাটানোর জন্যে।
আব্বাস সিদ্দিকী দলের নাম ও পতাকার রঙ ঠিক করার সময় তাঁর বিরুদ্ধে তোলা এই দুটি মারাত্মক অভিযোগ সম্পর্কে সজাগ ও সতর্ক ছিলেন। সেই পরিকল্পিত অভিযোগ খণ্ডন করেন দলের নাম ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রণ্ট রেখে এবং পতাকায় মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকার রঙ (সবুজ) ও চিহ্ন (চাঁদ) পরিহার করেন। এভাবে দলের নাম ও পতাকার রঙ নির্বাচন করার মাধ্যমেই তিনি একটা বলিষ্ঠ বার্তা দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা গুরুতর অভিযোগ দুটি সর্বৈব মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাঁর ধর্ম ও বংশ পরিচয়কে কটাক্ষ করে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত রুচিহীন কুৎসার জবাব দিতে গিয়ে তিনি বারবার ঘোষণা করেছেন যে তিনি সবার আগে একজন ভারতীয় এবং ভারতীয় হিসেবে তিনি গর্বিত। সর্বোপরি দলের সাংগঠনিক কমিটিতে হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসী, জঙ্গলবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতিনিধি রাখার মাধ্যমেও তিনি বার্তা দিয়েছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি আস্থাশীল এবং ধর্ম-বর্ণ জাত-পাত নির্বিশেষে সমস্ত বঞ্চিত ও পশ্চাদপদ মানুষের জন্যেই লড়াই করতে অঙ্গীকারবদ্ধ, তা কোনো ফাঁকা বুলি নয়। তথাপি তাঁর কথা ও প্রতিশ্রুতিতে ভরসা না রেখে তাঁর বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসা প্রচার করে যাওয়া হয়েছে। কেন তাঁর কথা, দলের কর্মসূচী ও নির্বাচনী ইস্তেহার সব কিছুকেই ছেঁড়া কাগজের মতন মূল্যহীন মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল? তাঁর বংশ ও ধর্ম পরিচয়ের জন্যে? নাকি সিপিএম (এম) তাঁর দলকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কাছে টেনে নিয়েছে বলে? নাকি বিজেপিকে আটকাতে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের হাত শক্ত করার জন্য?
আব্বাসকে যেভাবে দেগে দেওয়া হল তা তাঁর প্রাপ্য ছিল না
ভারতীয় রাজনীতিতে কয়েকটি শব্দবন্ধ খুবই প্রচলিত। যেমন ভোটব্যাঙ্ক, তোষণনীতি, আইডেন্টিটি পলিটিক্স ইত্যাদি। তোষণনীতির নানা প্রকার থাকলেও এ রাজ্যে তার মূলটা হচ্ছে মুসলিম তোষণ। মুসলিম তোষণ কথাটা বিজেপি বলে এবং তাদের সৌজন্যেই সবার মুখে শোনা যায়। মুসলিম তোষণ কথাটা কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সঠিকটা হবে মোল্লাতন্ত্র তোষণ। বিজেপি সচেতনভাবেই ‘মুসলিম তোষণ’ শব্দবন্ধ কথাটি প্রচার করে। কারণ, তাদের মেরুকরণ রাজনীতির জন্যে এই শব্দবন্ধটাই উপযুক্ত। এখন আবার আমাদের দেশের ভোট রাজনীতি হয়ে উঠেছে আইডেন্টিটি পলিটিক্স নির্ভর। আইডেন্টিটি পলিটিক্সটাও এসেছে তোষণের রাজনীতি থেকে। জনগণকে যেমন ধর্মের নামে ভাগ করার হীন রাজনীতি করা হয় সে রকমই তোষণের রাজনীতি করা হয় নানা জাতি-উপজাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের নামেও। ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, জাত-পাত ও জাতি-উপজাতির ভিত্তিতে মানুষকে দেখা হয় ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিতে ফায়দা তোলার জন্যেই। নানা ধরণের ভোটব্যাঙ্ক আছে ভারতীয় রাজনীতিতে। যেমন মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক, যাদব ভোটব্যাঙ্ক, রাজবংশী ভোটব্যাঙ্ক, আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক, দলিত ভোটব্যাঙ্ক, গোর্খা ভোটব্যাঙ্ক, লেপচা ভোটব্যাঙ্ক, চাঁই ভোটব্যাঙ্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। এ দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই এই হরেক রকমের ভোটব্যাঙ্ককে ভাগ বসাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। এতে এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে রাজনৈতিক দলগুলো গরীব ও মেহনতী মানুষদের মানুষ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শুধু ভোটার হিসেবেই। তাই তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা ভাবে না, ভাবে কেবল কীভাবে তাদের সন্তুষ্ট করে তাদের ভোট পাওয়া যায়। ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের জন্যে বিভিন্ন রকমের কৌশল গ্রহণ করা হয় তাদের মন-মানসিকতা ও চাহিদা অনুযায়ী। মুসলিম সমাজ কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের অক্টোপাশে আজও সমানে বন্দি এবং সেক্ষেত্রে ধর্মগুরুদের নিদানই শেষ কথা। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কৌশলই হল মুসলিম ধর্মগুরুদের সন্তুষ্ট করা। মুসলিম ধর্মগুরুদের একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ হল মুসলিম সমাজে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তাই মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ মানেই হল মোল্লাতন্ত্র শোষণ। এ প্রবন্ধে শুধু মোল্লাতন্ত্র তোষণ নিয়েই আলোচনা করতে চাই। সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা বলে নেওয়া অতি আবশ্যক যে
স্বাধীনোত্তর কালে ডান, বাম-সহ সমস্ত অবিজেপি পার্টির সরকারই যে যার মতন করে মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতি করে আসছে। লক্ষ্য হল তথাকথিত সেই ‘মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক’। কংগ্রেস সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক।
- কংগ্রেস সরকার হিন্দু বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু মুসলিম বহুবিবাহ বহাল রেখেছে।
- হিন্দুদের ধর্মীয় সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করে নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার দিয়েছে, কিন্তু মুসলিমদের সেই ধর্মীয় আইন (ফারাইজ আইন) বহাল রেখেছে।
- হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র টোল কবেই বিদায় নিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছে কংগ্রেস সরকার তাতে উৎসাহ দেয়নি বলে। মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা আজও টিকে রয়েছে। শুধু তাই নয়, দিন দিন এর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ কংগ্রেস সরকার–সহ সমস্ত অবিজেপি সরকার এই শিক্ষাব্যবস্থায় উৎসাহ দেয় এবং এর পেছনে অঢেল অর্থ খরচ করে বলে।
- দেশে ধর্মনিরপেক্ষ অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রবর্তন করা যায়নি মোল্লাতন্ত্র চায় না বলে।
- মোল্লাতন্ত্র তোষণের সবচেয় নিকৃষ্ট নমুনা রেখে গেছেন রাজীব গান্ধী। খোরপোষ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়কে খারিজ করে দেন তিনি সংসদে একটি কালা আইন প্রণয়ন করে মুসলিম নারীর সুরক্ষার নামে। কিন্তু বস্তুত সেই আইনে মুসলিম নারীদের খোরপোষ চাওয়ার অধিকারকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
আগেই বলেছি যে অবিজেপি সব দলের সরকারই কমবেশি মোল্লাতন্ত্র তোষণ ও ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি করে। তবে এক্ষেত্রে একেবারে নগ্নভাবে মোল্লাতন্ত্র তোষণ করা বলতে যা বোঝায় তা করে চলেছে মমতা ব্যানার্জীর টিএমসি সরকার। মমতা ব্যানার্জীর সরকারের সেই নগ্ন মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতির কয়েকটা নমুনা এরূপঃ
- মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় দু’ধরণের মাদ্রাসা আছে– সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত কওমি বা খারিজি মাদ্রাসা। দ্বিতীয় প্রকারের মাদ্রাসায় জিহাদের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তৈরি করা হয় জিহাদি ও সন্ত্রাসী। একমাত্র মমতা ব্যানার্জীর সরকারই খারিজি মাদ্রাসাকে উৎসাহ দেওয়ার নজির তৈরি করেছে।
- ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতার প্রবর্তন।
- হজ হাউসের সম্প্রসারণ এবং ঝাঁ চকচকে রাজকীয় নতুন হজ হাউস নির্মাণ।
- মুসলিমদের ধর্মীয় জমায়েতে গিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ভুলভাল উচ্চারণে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাষায় ও কায়দায় সম্বোধন করা ও বিদায় জানানো। যেমন সালেমালেকুম, ইনসাল্লাহ, আল্লা হাফেজ, খোদা হাফেজ ইত্যাদি ইত্যাদি।
- রোজার মাসে উপবাস ভাঙ্গা পার্টিতে অংশ নিয়ে মাথায় আঁচল টেনে মুসলিম নারীর বেশ ধারণ করে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করা।
- অনুরূপ বেশ ধারণ করে ঈদের জামাতে অংশ নিয়ে ভাষণ দেওয়া ও মোনাজাত করা।
মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কেউ কখনও প্রতিবাদ, এমনকি সামান্য সমালোচনাও করে না। শুধু কংগ্রেস নেতা আরিফ মহম্মদ খাঁন একবার করেছিলেন যখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সংসদে মুসলিম নারীর খোরপোষ বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ও দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সেই তিনি এখন কেরালার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত। এটা কি বিজেপির দেওয়া পুরষ্কার? তাই মনে হয় অন্য কোনও কারণে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। আইনটা ছিল একটা বাহানা মাত্র।
শরিয়তি আইন এতই কুৎসিত যে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান-সহ অধিকাংশ মুসলিম দেশই সেই আইনের ব্যাপক সংস্কার করেছে। বাতিল করে দিয়েছে বহুবিবাহ ও তিন তালাক আইন। এ দেশে ৯০% মুসলিমই মাদ্রাসার ছায়া মাড়ায় না। এতদসত্ত্বেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা শরিয়তি আইন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেবার দাবি জানায় না। তাদের এই কাপুরুষসুলভ নীরবতা হেতু মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদেরই (মাওলানা, ইমাম ও মুফতিরা) দাসত্ব করে চলেছে সমগ্র মুসলিম সমাজ, যদিও মোল্লাতন্ত্রের চেয়ে বড়ো শত্রু মুসলিম সমাজের আর কেউ নেই। মুসলিম ধর্মগুরুরাই যেহেতু মুসলিম সমাজের নেতা তাই তাদেরই তোষণ করে রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের দখল নিতে, নিদেন পক্ষে ভাগ নিতে। ফলে অবিজেপি সরকারগুলোর মোল্লাতন্ত্র তোষণকারী নীতি ও ভূমিকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মুসলিম সমাজ।
অবশেষে বহু যুগের সুদীর্ঘ লজ্জাজনক নীরবতা ভাঙলেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ভাঙলেন সশব্দে, সজোরে। রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন মোল্লাতন্ত্রের তোষণের। সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর যে কাজগুলির প্রতিবাদ করেছেন সেগুলি হল-
- ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতা প্রদান
- মহরমের দিন দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা
- মুসলিমদের রোযা এফতার পার্টিতে অংশ নিয়ে রোজা এফতারের ভাণ করা
- ঈদের জামাতে গিয়ে ইমামদের পাশাপাশি খুতবা (ভাষণ) দেওয়া
- মুসলমানদের জন্যে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ১০০% পূরণ করে দেওয়ার অসত্য ঘোষণা করা
ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতার প্রতিবাদ করে তিনি বলেছেন তাতে মুসলিম সমাজের কল্যাণ হয়নি। বলেছেন রিলিফ বা ভিক্ষা নয়, প্রাপ্য অধিকার চাই। প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা প্রসঙ্গে বলেছেন যে এর ফলে একটা বার্তা দেওয়া হয়েছে যে একই দিনে মহরম ও প্রতিমা বিসর্জন হলে দাঙ্গা বাধতে পারত। এই বার্তাটা গেছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যা মুসলমানদের পক্ষে যথেষ্ট অপমানজনক। মুখ্যমন্ত্রীর রোজা, ইফতার পার্টি ও ঈদের জামাতে অংশ নেওয়াকে বলেছেন নাটকবাজী এবং মুসলিমদের প্রতি কপট দরদ প্রদর্শন।
যে কাজটা অনেকদিন আগেই করা দরকার ছিল প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের, তারা করেননি। সেটা করলেন আব্বাস সিদ্দিকী। তার জন্যে তাঁকে পীর বংশের কত বাধার যে মোকাবেলা করতে হয়েছিল তা একমাত্র তিনিই জানেন। এটা করার জন্যে যাদের তাঁকে ছিঁড়ে খাওয়ার কথা ছিল তারা তো খেয়েছেই, কিন্তু যাদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার কথা ছিল তারাও ছিঁড়ে খেয়েছে। অর্থাৎ বাম মনস্ক মানুষরাও তাঁকে সমানে ছিঁড়ে খেয়েছে। বামপন্থী এই ‘পণ্ডিত’ মানুষগুলো বঙ্গ রাজনীতিতে আব্বাসকে ভয়ঙ্কর এক মুসলিম মৌলবাদী দৈত্য বলে অভিহিত করেছে। এটা কিন্তু তাঁর প্রাপ্য ছিল না।
প্রসঙ্গ : কং-বাম-আইএসএফ জোট
শুধু আব্বাসকেই নয়, আব্বাসের সঙ্গে জোট করার জন্যে চারদিক থেকে ছিঁড়ে খেয়েছে সিপিআই (এম)-কেও। আব্বাস যাদের মূল্যায়নে একজন মুসলিম মৌলবাদী শক্তির প্রতিনিধি তাদের কাছ থেকে অন্য কিছু আশা করা অবশ্য বৃথা। এই সমালোচকরা তাঁর অতীতকেই শুধু কাঁটাছেঁড়া করেছে যা সমীচীন ছিল না। সমাজে যেমন ভাঙাগড়া হয় তেমনি ভাঙাগড়া হয় মানুষেরও। আব্বাসের মধ্যে অতি দ্রুত সেই ভাঙাগড়া আমরা দেখেছি। একজন ইমানদার মুসলিমের অবস্থান থেকে নিজেকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপযুক্ত করে তোলার জন্যে তাঁর নিরন্তর আন্তরিক চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি যা বলেছেন তা এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মতন শুধু কথার কথা ছিল না। যা বলেছেন তা যে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছিল না তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন কথায় ও কাজের মাধ্যমে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারবার বলেছেন যে তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক এবং তারজন্যে তিনি গর্বিত। দল গঠন করেছেন হিন্দু, মুসলিম, দলিত ও অন্যান্য পিছড়ে বর্গের লোকদের সমন্বয়ে। দল ও পতাকায় ইসলামের গন্ধ রাখেননি। শাসক দল ও সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে গলা ফাটিয়েছেন যা বামপন্থীরাও পারেনি। সুতরাং এ কথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে, সেক্যুলার ফ্রণ্টের সঙ্গে জোট করে সিপিআই (এম) ধর্মনিরপেক্ষ নীতির লঙ্ঘন করেনি।
সিপিআই (এম) ও বামফ্রণ্টের ভোট কমার দায় প্রসঙ্গে
বামফ্রণ্টের ভোট কমা ও একটিও আসন না পাওয়ার জন্যে দায়ী করা হচ্ছে মূলত আব্বাসের সঙ্গে জোট করাকে। এটার কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ নিহিত রয়েছে। প্রধান কারণ অবশ্যই বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের বহু অনুগামী ও সমর্থকের বিজেপির জয় আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া। এছাড়া যে কারণগুলি রয়েছে তার কয়েকটি হল-
- বাম–কংগ্রেস–আইএসএফ জোটটাই আদতে হয় নি। সেটা মূলত কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরির জন্যে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে তিনি জোটে সম্মতি দেন বাধ্য হয়ে। ফলে নামে তিন দলের মোর্চা (সংযুক্ত মোর্চা) তৈরি হলেও বাস্তবে সেটা ছিল অন্তঃসারশূন্য।
- বেশ কিছু আসনে মোর্চার একাধিক প্রার্থী ছিল।
- কংগ্রেস ও আইএসএফের বস্তুত কোনও জোটই হয়নি।
- বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে জোটটাও নীচুতলায় কাজ করেনি। ফলে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জোটের প্রার্থীকে হারাতে অন্য দলের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। এটা কংগ্রেস ও বামফ্রণ্ট উভয় তরফ থেকেই হয়েছে।
সুতরাং উপসংহারে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এটা নিছকই ভ্রান্ত ধারণা যে কংগ্রেস ও বামেদের ভোট কমেছে আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট করার জন্যে।