মৃত্যু আমাদের দেশে সবসময় তুরুপের তাস। ভোটের বৈতরণি পার করতে, শুকিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক প্রবাহকে চাঙ্গা করতে, ধুঁকতে থাকা রাজনৈতিক দলকে অক্সিজেন যোগাতে মৃত্যু বিরাট ভূমিকা পালন করেছে সর্বদাই। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীর মৃত্যুই হোক, হোমরাচোমরা নেতার মৃত্যু অথবা বিশেষ কোনও ব্যক্তিত্বের অকাল  প্রয়াণই হোক ফায়দা তোলার জন্য প্রস্তুত থাকে রাজনৈতিক শিবির। অতিমারি, অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের জেরবার অবস্থা কোনও কিছুই কিছু নয় এই দেশে! পঙ্কিল রাজনীতিই সব আবেগ, বোধ, চিন্তাশক্তিকে গ্রাস করে নেয় সর্বাগ্রে।

সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুকে নিয়ে তেমনই হচ্ছে দেশ জুড়ে। ছয় সপ্তাহ পরে হঠাৎ করে আবার তাবড় মিডিয়া হাউসগুলো জেগে উঠেছে এই ইস্যুকে নিয়ে। স্টিং অপারেশন, স্টুডিওয় বসে বসে ‘ভার্ডিক্ট’ দিয়ে দেওয়া, অমুক বনাম তমুককে লড়িয়ে দেওয়া, অভিনেতার কাছের, দূরের বন্ধু পরিজনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার হিড়িক দেখে মনে হচ্ছে আলো জ্বালবার, রহস্য উন্মোচন করার থেকেও তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে চরিতার্থ করাই আসল লক্ষ্য।

সুশান্ত হয়ত এসব কিছুই চাননি। সহজ জীবন চেয়েছিলেন তিনি। জটিল রাজনীতির মারপ্যাচ তিনি চাননি- না জীবনে, না সম্পর্কে, না জীবিকায়। বন্ধু নির্বাচনে হয়ত ভুল ছিল, সে তো আমাদের সবারই থাকে। সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভুল ছিল। ঠিক হয়ে যেত সবই আবার কালের নিয়মে, যদি তিনি বেঁচে থাকতেন। কিন্তু তিনি মরিয়া প্রমাণ করিলেন যে তিনি মরেন নাই।

ভোট বড়ো বালাই

সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে যা হচ্ছে তা কি খুব সরল রৈখিক বলে মনে হয় আমাদের সবার? না। রাজনৈতিক অভিসন্ধির গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কারণ হল ভোট। সাধারণ মানুষের আবেগ, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে সুশান্তের সঙ্গে। তাই যেনতেন প্রকারেণ কাজে লাগাও তাকে। যে বিহার পুলিশ কিছুদিন আগে অবধি সুশান্ত সিং রাজপুতের বাবা কে কে সিং-এর এফআইআর নিতে চায়নি সেই বিহার পুলিশ মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমারের অনুরোধে উদ্যোগী হল, শুধু তাই নয় মুম্বাইয়ে গিয়ে সেখানকার পুলিশকে না জানিয়েই পৃথক তদন্ত শুরু করে দিল। সুশান্তকে শিখন্ডি খাড়া করে এনডিএ চালিত বিহার আর কংগ্রেস সমর্থিত শিবসেনা সরকারের মধ্যে যেন অঘোষিত দ্বৈরথ শুরু হল। সুশান্তের মৃত্যুর পর বিহারের সাধারণ মানুষ করণ জোহর-সলমান খানদের স্বজনপোষণমূলক কীর্তিকলাপ নিয়ে বিষোদগার করেছে, তাই এই সেন্টিমেন্ট কাজে লাগাবার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর পাবেন না নেতা-মন্ত্রীরা।

জেডইউ, আরজেডি, বিজেপি সব রাজনৈতিক দল ভোটের আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছে “জাস্টিস ফর সুশান্ত” স্লোগান আওড়াতে আওড়াতে। চিরাগ পাসওয়ান বলেছেন ‘নীতিশ কুমারের অনেক আগেই উচিত ছিল তদন্তের নির্দেশ দেওয়া। তিনি বিলম্ব করলেন অযথা’। তেজস্বী যাদব সাংবাদিক সম্মেলন করে সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছিলেন। অভিনেতা শেখর সুমন যিনি ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলের টিকিটে লড়েছিলেন তিনিও এই মৃত্যুটিকে ধারাবাহিকভাবেই সন্দেহজনক বলে আসছেন। ট্যুইটারে তিনি লিখেওছিলেন যে সুশান্তের মুম্বাইয়ের বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সিবিআই তদন্ত কেন হচ্ছে না, কাদের বাঁচানোর জন্য, এ প্রশ্নও তিনি তোলেন। কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছেলেকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। জন অধিকার পার্টির সর্বেসর্বা পাপ্পু যাদবও সুশান্তকে “বিহারের গর্ব” বলে উল্লেখ করে সিবিআই তদন্তের পক্ষে সওয়াল করেন। সুশান্ত সিং রাজপুতের তুতোভাই নীরজ কুমার সিং নিজেও বিজেপি’র বিধায়ক। আগে জেডইউ দলের সদস্য ছিলেন তিনি। এইসব মিলিয়ে বিহারের রাজনৈতিক হাওয়া সরগরম। বিহারে জাতি-বর্ণ তো নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড়ো ফ্যাক্টর। সুশান্ত ছিলেন রাজপুত। ২০১৫ সালের নির্বাচনে জেডিইউ-আরজেডি-কংগ্রেস জোটের ৩৯ জন উচ্চবর্গীয় প্রার্থীর মধ্যে ১২ জনই ছিলেন রাজপুত। এখনকার বিহারের বিধানসভায় ১৯ জন রাজপুত বিধায়ক রয়েছেন। রাজপুতের প্রতিপত্তি, সেন্টিমেন্ট বিহারের ভোটে অবশ্যই বড়ো প্রভাব ফেলেছে অতীতে, ফেলবে ভবিষ্যতেও। অথচ যাকে কেন্দ্র করে এইসব অঙ্ক সেই অভিনেতাটি ২০১৭ সালে সঞ্জয় লীলা বনশালির পদ্মাবত ছবিকে ঘিরে করনি সেনার বিক্ষোভ, অশোভন আচরণ, সেটে এসে ভাংচুর, পরিচালককে নিগ্রহ করার প্রতিবাদস্বরূপ নিজের পদবী থেকে রাজপুত অংশটি সরিয়ে দিয়েছিলেন।

Rhea-Sushant 

অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা

সবচেয়ে অবাক লাগে যে, সুশান্ত টেলিস্কোপে তারা দেখতেন। আকাশ দেখার, পদার্থবিদ্যা পড়ার, নাসায় যাওয়ার নেশা ছিল তাঁর। সেই সুশান্তের মৃত্যুর পর কালো জাদু, বাঙালি মেয়েদের বশ করার মন্ত্র জানা থাকে- এসব বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তাঁর স্বজন, ভক্তরা। তারা এই উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটিকে ঠিকঠাক চিনতেন তো? তাঁর বান্ধবীর হাজারটা দোষ থাকতে পারে, সে নিকৃষ্টতম মানুষ হতেই পারে কিন্তু বিজ্ঞানকে জড়িয়ে থাকা অভিনেতার মৃত্যু ঘিরে এইসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন কথা উঠে আসবে এ মেনে নেওয়া যায় না। আদপে কিন্তু সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে অনেক বেশি ক্ষমতাবান করে তোলা হচ্ছে এই সব অবৈজ্ঞানিক তথ্য বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে। সে এতই ক্ষমতাবান যে একজন সুস্থ মানুষকে তুকতাক করে মৃত্যুর মুখে পৌঁছে দিতে পারে। আবার এ কথাও বলা হচ্ছে যে বেশিরভাগ বাঙালি মেয়েরা নাকি এসব জাদুটোনা, তুকতাক করতে পারে! এ সমস্ত অভিযোগ মেয়েরা মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলছে! এরকম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করছে অক্লেশে কারা! তারা কতটুকু চেনেন বাঙালি মেয়েদের? এবং এইসব কথা শেয়ার করা হচ্ছে নির্দ্বিধায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারা কেন তাহলে সেসময়ে বাধা দেননি এসব বুজরুকি কাণ্ডকারখানায়! এই কি আধুনিক মানসিকতা! বিজ্ঞানমনস্কতা!

ফুটেজ পাওয়ার আশায় সেলিব্রিটিগণ

হোক না মৃত্যু মর্মান্তিক।

হোক না হৃদয় ক্ষয়!

আমি কেন খাবনা ফুটেজ!

বোকারাই চুপ রয়।

চুপ থাকাটা কাজের কথা নয় একেবারেই, একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে যা যা মনে হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের বঞ্চনা, যন্ত্রণার কথা বলাই যায়। বড়ো বড়ো মিডিয়া হাউসগুলোর স্বজনপোষণ, ইন্ড্রাস্ট্রির বাইরে থেকে আসা মানুষদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা নিয়ে সোচ্চার হওয়াই যায়। সেটুকুই মানুষ শুনতে চায়, জানতে চায়। কিন্তু ফুটেজ খাওয়ার জন্য সমসাময়িক সবাইকে গালমন্দ করা এবং সবসময় খবরে থাকতে চাওয়ার নামে সামাজিক মাধ্যমকে কলতলায় পর্যবসিত করার মধ্যে কার্যসিদ্ধি থাকতে পারে, মার্জিত রুচি নেই। ন্যুনতম বোধ নেই। যেচে পড়ে পাঙ্গা নেওয়ার মধ্যে কেমন ফ্রাস্ট্রেশনের গন্ধ থাকে, নিজের প্ল্যাটফর্মের জোরে সবাইকে আক্রমণ করার মধ্যে গাজোয়ারি দাদাগিরি থাকে। যে দাদাগিরির বিরুদ্ধেই কিন্তু আসল প্রতিবাদ সঙ্ঘঠিত হওয়া উচিত ছিল। করণ জোহর, সলমান খান, আদিত্য চোপড়াদের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে, বলিউডি গ্যাং-এর স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের বিপক্ষে কথা বলাটাই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছিল কিন্তু এখন যেহেতু হাতে কাজ নেই, ঘরবন্দি দশায় বাড়তি ফুটেজ খাওয়ার লোভে সুশান্তের মৃত্যুকে খাড়া করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসিকতাটা ক্রমশ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে কিছু কিছু সেলিব্রিটির আচরণে।