টেলিস্কোপ দিয়ে যে দেখতে চাইত তারা ভর্তি আকাশ, সে জানত ‘যাহাই জ্বলজ্বল করে তাহাই তারা নয়’ তাহলে তার পরিণতি এইভাবে কেন? তারামন্ডল, সৌরজগত, মহাকাশকে সে বুঝতে চাইত মন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু কাছের পৃথিবীতে মনুষ্য-সৃষ্ট তারাদের মেকি জৌলুস, কৃত্রিম আলো তাকে টেনে নিয়ে গেল নিম অন্ধকারমাখা কালো সুড়ঙ্গে? ‘এ তারা, ওহ তারা হর তারা’-এ মিল নেই বুঝতে পারল না ওই মেধাবী ছাত্র! কৃষ্ণ গহ্বর আর সুড়ঙ্গ-পাতাল যে আলাদা! মরীচিকায় দিক ভুল হয় এখানে নিরন্তর। টাকার আঠায় জড়িয়ে যায় বিবেক। এই গ্রহের মহাতারকাদের পিচ্ছিল পথ তাকে নিয়ে গেল… ‘আ যা গুফাওমে আ’।

তার কোনও দোষ নেই, এ কথা যেমন ঠিক নয় তেমন সুশান্তের মতো আরও অনেক মানুষের এমন পরিণতির পিছনে যে নিষ্ঠুরতাগুলো থাকে তাও একেবারে সত্যি। তোমার শর্ত মেনে এই গর্তে ও আবর্তে থাকতে হলে নিজস্বতাকে তুলোধোনা করে দিতে হবে, আর তা পারলেই তুমি বলবে আমায়- ‘আদর করে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন’। এসবই জানা, কিন্তু নিজস্বতা? আমিটাকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে কী পড়ে থাকবে আমার? প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, ইচ্ছে, সব কিছু তখন ব্র্যান্ডের আওতায়। প্রোমোশন, পাবলিসিটি, বাজার, ডিমান্ড, প্রোডাক্ট এসবই সারসত্য হয়ে ওঠাবে, বসাবে। মেনে নিতে পারলেই তুমি ‘সিতারা’, বিম্বিত হবে কোটি মানুষের হৃদয়াকাশে। ছোটো শহর থেকে উঠে আসা শিল্পীদের এসব শিখে নিতে হয় আরবসাগরের আকাশে ঝুলে থাকা ‘তারা’দের থেকে। সহ্য করে নিতে হয় অপটু, অশিক্ষিত, অভদ্র ‘তারা’দের বারোয়ারি দাপট। ভোপালের রঙ্গমঞ্চের অভিনেতার কপালে শিকে ছেঁড়ে না, নওয়াজউদ্দিনকে নিরাপত্তারক্ষী হয়ে পেট চালাতে হয় মাসের পর মাস, মিঠুন চক্রবর্তীকে অমানবিক কষ্ট, অপমান সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যেতে হয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে কিন্তু কুমার গৌরব, তুষার কাপুর, উদয় চোপড়া, ফারদিন খান, সূরয পাঞ্চালি, টাইগার শ্রুফ বিরাট বিরাট ব্রেক পান সময়, কাল নির্বিশেষে বাবা, কাকার প্রভাবে। আর এইসব তাবড় তাবড় বাবা কাকারাও বোধহয় ভুলে যেতেই চান নিজেদের লড়াইয়ের সময়টা। বান্দ্রাস্ট্যান্ডে বড়ো বড়ো ব্যানারে স্টারকিডদের আলোকিত মুখের তলায় দাঁড়িয়ে ঘষটানো কেরিয়ার নিয়ে পকেটের খুচরো পয়সা গোনে বিহারের, আলোয়ারের, নদীয়ার, উজ্জয়িনীর, জামশেদপুরের প্রশিক্ষিত প্রতিভাবানরা। আর অ্যাম্বিশাস অভিনেত্রীদের দশা যে কতটা নারকীয় হতে পারে তা কল্পনাতীত। একটু আলোর ছোঁয়া পেতে কত অন্ধকার গলি ঘুঁজি পেরতে হয় তাদের, তলাতলে নেমে যেতে হয় ক্রমশই।

অনিশ্চিত রোজগার, খ্যাতি, প্রতিপত্তি যেখানে ওঠানামা করে সেনসেক্সের মতো সেখানেই এই আলোর আর কালোর মিশেল। বিনোদন তো তেমনই একটা জগৎ। এখানে পরপর তিনটে ফ্লপ করলে লোক মুখ ফিরিয়ে নেবে, চেনা হাত ছেড়ে চলে যাবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার্স নেমে যাবে। জীবন দুর্বিষহ।

তারপর সবুরে মেওয়া ফলে একসময়, কিছু অন্যরকম ছবিতে অভিনয় করে একদিন তাঁদের খুব নাম হয়, যত নাম হয় তত ভুরু ওপরে ওঠে উন্নাসিক প্রযোজকদের। টেরা চাউনি, বিদ্রুপ, দলবাজি, ছড়ি-ঘোরানো হাবভাব তোয়াক্কা না করে কিংবা সেসব সহ্য করে দু তিনটে হিট দিতে পারলে ‘এ’ লিস্টেড প্রযোজকগণ ফিরে তাকান এইসব অনার্য অভিনেতাদের দিকে। নীল-রক্ত নিয়ে জন্মানো তারকা-সন্তানদের একের পর এক ব্যর্থতায় প্রযোজকদের লোকসান হলে তখন তাদের দৃষ্টি পৌঁছয় ছাতাবিহীন, গডফাদারহীন, এইসব লড়াকু অভিনেতাদের দিকে।

যত বড়ো আলো তার পিছনে ততটাই অন্ধকার। তারাদের পা ডুবিয়ে রাখতেই হয় অন্ধকার পরিখায়। সঙ্গে সহস্রমুখ স্তাবক পুষতে হয়, স্তাবকরাই অবশ্যম্ভাবী করে তোলে স্খলন, পতন, নিমজ্জন। অন্যকে টেনে নামানোর ক্ষেত্রেও স্তাবকদের বিরাট অবদান। যেভাবে হলগুলো থেকে ছোটো প্রযোজক, অনামি পরিচালকদের  উৎকৃষ্ট ছবি টেনে নামায় রাঘব বোয়ালেরা। নিরাপত্তাহীনতার চূড়ান্ত। নিজের ক্ষমতা সীমিত তাই অন্যের কলমে, ক্যামেরায়, স্বপ্নের বাস্তাবায়নে, প্রতিভায় বাগড়া দাও। একঘরে করে দাও তাদের। জোট বেঁধে খিল্লি ওড়াও। রাজনীতির, ক্ষমতার চারপাশে থেকে নিজের জমি শক্ত করে নাও। লস অ্যাঞ্জেলস থেকে টালিগঞ্জ গল্পটা কম বেশি একই রকম। স্থূলতার, পদ্ধতির, পরিমাণের রকমফের আছে।

সুশান্ত সিং রাজপুতের মতো ছেলেরা এখানে বেমানান, অনেকে বলেছেন এমন। কেউই চিনি না তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে তাই জানিনা তিনি সত্যিই কতটা বেমানান ছিলেন! তবু এই বেমানান হয়ে যাওয়ার বেদনাটাই আমাদের সবার বুকে বিঁধেছে। কেন? কারণ এই ‘অড ম্যান আউট’ ব্যাপারটা আমাদের সঙ্গে হয় যে পদে পদে রোজের জীবনে। কর্মস্থলে, সাংস্কৃতিক পরিধিতে, পরিবারে এমনকি নিজের কাছেও প্রশ্ন ওঠে ব্যর্থতা নিয়ে। তাই অড ম্যান উড়ে যেতে চায় পৃথিবী থেকে। এ কোনও সাফাই নয় আত্মবিনাশের স্বপক্ষে। এ এক পরিস্থিতি। যারা সে পরিস্থিতি সামলাতে পারে তারা লড়াই শুরু করে প্রতিদিন নতুন করে আর যারা পারে না তারা হারিয়ে যায়।

অনিশ্চিত রোজগার, খ্যাতি, প্রতিপত্তি যেখানে ওঠানামা করে সেনসেক্সের মতো সেখানেই এই আলোর আর কালোর মিশেল। বিনোদন তো তেমনই একটা জগৎ। এখানে পরপর তিনটে ফ্লপ করলে লোক মুখ ফিরিয়ে নেবে, চেনা হাত ছেড়ে চলে যাবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ার্স নেমে যাবে। জীবন দুর্বিষহ।

এইসব কথাই জানা, তবু সুশান্তের অসময়ে চলে যাওয়া সেই প্রাচীন নিষ্ঠুর সিস্টেমের দিকেই আঙুল তুলে দিল। নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে এগিয়ে এলেন অনেকেই, হয়তো #মিটুর মতোই থিতিয়ে যাবে সব, কিন্তু যে প্রশ্নগুলো উঠেছে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক তাই অনেক বেশি তীব্র, অনেক তীক্ষ্ণ, ফলার মতো। গণমাধ্যম এবং মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করলে অনেক মুখোশ খুলে পড়বে। বিন্দুসম হলেও আলো ঢুকবে জমে থাকা অন্ধকারে।