সুন্দরবন নামটা মনে এলেই রহস্য রোমাঞ্চে ঘেরা একটা জায়গার কথা মনে পড়ে, জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ! পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ যার বেশিরভাগটাই বাংলাদেশে। কার ভাগে কতটা পড়ল এই নিয়ে ভাগ্যিস কাশ্মীরের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বিবাদ নেই। তাহলেই হয়েছিল আর কী! যা কিছু সুন্দর তা নিয়েই তো বিবাদ এই উপমাহাদেশে।
বেত-হোগলা ঝোপ, শ্বাসমূল অরণ্য সমৃদ্ধ দ্বীপগুলি, ছোট-বড় খাঁড়ি আর যেদিকে দুচোখ যায় শুধু জল, এই নিয়েই তো এই ব-দ্বীপ। সুন্দরবনের আর এক রূপ অধরা, স্যাঁতসেঁতে, পিচ্ছিল- যাকে ছোঁয়া যায় না হাত দিয়ে, চোখ এবং ক্যামেরার লেন্স একমাত্র অবলম্বন। আমরা যারা বেড়াতে যাই তাদের কাছে সুন্দরবনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অতুলনীয় কিন্তু এই আনন্দানুভূতির মধ্যেও এক অমোঘ বিষন্নতা মনকে ঘিরে ধরে যখনই মনে পড়ে যে এখানকার মানুষের কাছে বেঁচে থাকার নামই লড়াই। মিন, মধু, মাছ, কাঁকড়া সংগ্রহ করাই প্রধান জীবিকা আর জীবন-জীবিকার জন্য এখানকার মানুষদের করে যেতে হয়
আরও পড়ুন: ইচ্ছে হলেই ইচ্ছে গাঁও
আমরণ অসম সংগ্রাম। লঞ্চে করে যখন নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছিলাম তখন নদীর পাড় ঘেঁষে থাকা কিছু গাছে দেখতে পাচ্ছিলাম লাল কাপড় বাঁধা, অর্থাৎ দক্ষিণ রায় (রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, যার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সুনাম পৃথিবীজোড়া) ওখানে এসেছিলেন এবং মনুষ্য শিকারে সফল হয়েছিলেন। জীবন ও মৃত্যুকে পায়ের তলায় নিয়ে সুন্দরবনের মানুষ সংগ্রাম করে জলের এবং জঙ্গলের জীবনে টিকে থাকার জন্য।

জঙ্গল মানুষকে অপেক্ষা করতে শেখায়, স্থিতধী হতে বলে, মৌনতাও প্রয়োজন সে কথা জানিয়ে দেয়। তাই লঞ্চের ডেকে চুপ করে হাতে ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করে মন, কোনো ভালো মুহূর্ত ধরে রাখার (দেখলাম তো কত চিত্রগ্রাহককে নিরন্তর অপেক্ষায় থাকতে) জন্য অথবা এমনি কোনও দায় ছাড়াই কেবলমাত্র উপভোগ করার তাগিদে সবুজ গাছ গাছালি, নিঃসীম জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকলে মন শান্ত হয়। হরিণ যুগলের জল খেতে আসা, বন্য শুয়োরের নদীর পাড়ের কাদা থেকে খাদ্যাণ্বেষণ, কুমীরের আলস্য যাপন, সারস, বক, সিগ্যালের উড়ান এবং অবস্থান দেখতে দেখতে ভেসে বেড়ানো, কত কত ফ্রেম তৈরি হয়ে যায়। সজনে খালি, সুধন্যখালি, ঝড় খালি, দোবাঁকি এসব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখা এবং সুন্দরবনের গন্ধ নেওয়ার অভিজ্ঞতাও বেশ সুখকর। তবে সবাই এইসব জায়গায় যায় বলে লোকজনের কোলাহল এবং ভিড় থাকবে। ভিড় এবং কোলাহল কমলে দোবাঁকি জঙ্গলের গা ছমছমে পরিবেশের স্বাদ এনে দেবে। এখানে হরিণ দেখতে পাওয়া যাবে প্রচুর আর দক্ষিণ রায়ের উপস্থিতির কথা কেই বা কবে বলতে পেরেছে?
আরও পড়ুন:মায়াবী তিনচুলে ও ছোটা মাঙ্গওয়া
এবারের সুন্দরবন ভ্রমণের আরও একটি মনোরম অভিজ্ঞতা হল ‘বনবিবির পালা’ দেখতে পাওয়া। বায়না আগে থেকেই করা ছিল। পাখিরালয়ের হোটেলের লনে আয়োজিত হল পালাগান। প্রত্যাশা প্রায় কিছুই ছিল না কিন্তু মন উপচে উঠল অভিনেতা, কলাকুশলীদের নিষ্ঠা আর অধ্যাবসায় দেখে। কলকাতার পেশাদারী নাটক দেখে বড় হয়েছি তাই শহুরে অহঙ্কারী মন ভেবেছিল গ্রাম্য যাত্রার হইহল্লা দেখে হাসি পাবে। কিন্তু অহঙ্কার হয়ই তো চূর্ণ হওয়ার জন্য, হলও তাই।
আমি একাধিকবার সুন্দরবন এলাম। সুন্দরবন আসলে কেবলমাত্র ভ্রমণ নয়, রহস্যময় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে জলের জীবন, সংগ্রামের জীবনকে দেখতে পাওয়া। আর এমন সব জীবন কাহিনি এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যে জীবনগুলো মৃত্যুকে কাছে থেকে দেখেছে, অনুভব করেছে।