সাড়ে চার দশক আগে বহরমপুরে মোহন নামে একটা সিঙ্গল স্ক্রীন সিনেমা হল ছিল, আমার কলেজ জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হয়ে। বহরমপুরের বাসিন্দা এক প্রয়াত বন্ধুর মুখে ২০১৮তে শুনেছিলাম যে, মোহন মাল্টিপ্লেক্স হয়ে যাচ্ছে। যতদূর সম্ভব, মোহন এখন বোধহয় আর সিঙ্গল স্ক্রীন নেই।
১৯৮২।কলেজ থেকে বেরোবার দীর্ঘ পাঁচ বছর পরে একটা দরকারে বহরমপুর গিয়েছিলাম দু-তিনদিনের জন্য।তার মধ্যেই মোহন সিনেমা হলে ‘শক্তি’ দেখতে গিয়েছিলাম।মাল্টিমেগাস্টারার সিনেমা, রমেশ সিপ্পির, অভিনয়ে অমিতাভ, রাখী, স্মিতা। এবং দিলীপ কুমার। ‘শক্তি’র গল্পটা প্রায় সবার জানা। সমান সমান টক্কর হবার কথা ছিল বাবা আর ছেলের, যথাক্রমে পুলিশকর্তা দিলীপ কুমার আর পুলিশ থেকে অপরাধী হয়ে যাওয়া অমিতাভর মধ্যে। কিন্তু, কি আশ্চর্য- পুরো সিনেমায় একজনকেই দেখে গেলাম, তিনি দিলীপ কুমার! কি অভিনয়, কি অ্যাকসেন্ট, কি স্ক্রীন প্রেজেন্স। তখন, সেই অলৌকিক সময়ে অমিতাভ বচ্চন থাকা সত্ত্বেও শুধু অন্য কাউকেই দেখে যাচ্ছি কোনও সিনেমাতে, এটা অকল্পনীয় ছিল। একটা সিনে বাবা আর ছেলের টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত ছেলের মা রাখী মাথা রাখলেন দিলীপ কুমারের বুকে। পিছনের সিটে দুই পক্ককেশ বয়োজ্যেষ্ঠর আলোচনা শুরু হল এটা নিয়ে যে কতজন নায়িকা মাথা রেখেছেন ওই বুকে! আর কাউকে নিয়ে এটা হওয়া সম্ভব ছিল না, বলিউডে।
১৯২২-এর ১১ ডিসেম্বর তারিখে পেশোয়ারে জন্মানো জমিদারপুত্র মহম্মদ ইউসুফ খান ১৮ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে পাড়ি দেন পুণেতে। এক পার্সি ক্যাফে মালিক ও বৃদ্ধ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতির সহায়তায় স্যান্ডউইচের দোকান দেন সেখানে। ১৯৪২-এ ডক্টর মাসানি নিয়ে যান বম্বে টকিজে, আলাপ হয় দেবিকা রাণীর সঙ্গে, মাসে ১২৫০ টাকার স্ক্রিপ্টরাইটার হয়ে যান মহম্মদ ইউসুফ খান। দেবিকা রানিই তাঁকে নাম বদলানোর পরামর্শ দেন। মহম্মদ ইউসুফ খান কখন যেন হয়ে যান দিলীপ কুমার। তবে তিনি রাজি হয়েছিলেন অন্য কারণে। দিলীপ কুমারের আত্মজীবনী ‘The Substance and the Shadow’ জানায় যে তাঁর বাবা অভিনয় পেশার একেবারে বিরোধী ছিলেন। এসব ‘নাটক’ মনে হত তাঁর। উপরন্তু বন্ধুপুত্র রাজ কাপুর অভিনয়ে পা রাখাতে আরও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য বাবা মেনে নিয়েছিলেন ছেলের এই কাজ। অভিনয়ের প্রশংসাও করেছিলেন। ১৯৪৪-এ ২২ বছরের দিলীপকুমার অভিনয় করে ফেলেন ‘জোয়ার ভাঁটা’ ছবিতে। প্রথম হিট ১৯৪৭-এ ‘জুগনু’। ১৯৬০-এর ‘মুঘল-এ-আজম’ ছিল তাঁর অভিনীত সবচেয়ে বাণিজ্যসফল ছবি। ৫০ দশকে নাম হয়ে যায় ‘ট্র্যাজেডি কিং’, শুধুই একঘেয়ে বেদনাবিধুর চরিত্রে অভিনয় করতে করতে। অতঃপর মনোচিকিৎসকের পরামর্শে হালকা চরিত্রে অভিনয় ‘আন’, ‘আজাদ’, ‘কোহিনূর’-এর মতন ছায়াছবিতে। লক্ষ টাকার পারিশ্রমিক ছুঁয়ে ফেলা তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন হলিউডের ‘লরেন্স অফ এ রাবিয়া’ ফিল্মে অভিনয়ের অফার, যা পরে করেছিলেন ওমর শরিফ। আর কাউকে নিয়ে এটা হওয়া সম্ভব ছিল না, বলিউডে।
দিলীপ কুমার নওয়াজ শরিফকে বলেছিলেন, “মিঞা সাহেব এটা আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। আপনি সম্ভবত জানেন না যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন উত্তেজনা দেখা দেয় তখন ভারতে মুসলিমদের অবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, কখনও কখনও তাদের ঘরের বাইরে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ে। দয়া করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু একটা করুন।” উপমহাদেশের রাজনীতিকরাও কখনও কখনও মাথা রাখতেন দিলীপকুমারের বুকে।
স্বাধীন দেশের প্রথম সুপারস্টার দিলীপ কুমার ‘জোয়ার ভাঁটা’ ছবিটি (১৯৪৪) থেকে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন তা থেমে গিয়েছিল ‘কিলা’(১৯৯৯) ছবিতে। ছয় দশক জুড়ে বলিউডে অভিনয় করা (৪০ দশক থেকে ৯০ দশক) দিলীপ কুমার তাঁর ৫৫ বছরের কেরিয়ারে মাত্র ৬৩টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ছিল ‘জুগনু’, ‘নয়া দৌড়’, ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘দেবদাস’, ‘রাম অওর শ্যাম’, ‘আন্দাজ’, ‘মধুমতী’ এবং ‘গঙ্গা-যমুনা’র মতো একাধিক হিট ছবি। তিনি হিন্দি সিনেমার অভিনয় শিল্পকে এক নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন। নাসিকের বার্নেস স্কুল পেরিয়ে খালসা কলেজে পড়ার সময়ও দিলীপ কুমারের সহপাঠী ছিলেন রাজ কাপুর। তাঁরা ঘোড়ার গাড়িতে করে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতেন। শোনা যায়, সেই সময় যখন রাজ কাপুর পার্সি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করতেন তখন স্বভাব মিতভাষী দিলীপ কুমার এক কোনায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকতেন এবং তাদের দিকে খুব কমই তাকাতেন। সেদিন কারও পক্ষে ভাবা সম্ভব ছিল না যে একদিন তিনিই নীরবতার ভাষা শেখাবেন ভারতীয় সিনেমাকে, যা আসলে হবে অনেক লম্বা সংলাপের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আর কাউকে নিয়ে এটা হওয়া সম্ভব ছিল না, বলিউডে।
একটিই সিনেমার প্রযোজক ছিলেন তিনি, ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১)। ৭০ দশকের প্রথমার্ধে ফ্লপের পর ফ্লপ ছায়াছবির কারণে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১, কোনও ছায়াছবিতে অভিনয় করেননি তিনি। মোট ৮টি ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, ছবিগুলি ছিল ‘দাগ’ (১৯৫২), ‘দেবদাস’ (১৯৫৫), ‘আজাদ’ (১৯৫৫), ‘নয়া দৌড়’ (১৯৫৭), ‘কোহিনূর’ (১৯৬০), লিডার (১৯৬৪), ‘রাম অওর শ্যাম’ (১৯৬৭), ‘শক্তি’ (১৯৮২)। এত বেশী সংখ্যক পুরস্কার আর কোনও ভারতীয় অভিনেতা এখনও পাননি। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ পেয়েছিলেন দিলীপ কুমার। আর কাউকে নিয়ে এটা হওয়া সম্ভব ছিল না, বলিউডে ও উপমহাদেশে।
১৯৯৯ সাল। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। নওয়াজ শরিফ ফোন ধরা মাত্রই বাজপেয়ীজী বলছেন, ‘‘এটা কি হচ্ছে? আপনি যখন লাহোরে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন তখন পাকিস্তানী সেনারা কারগিলে আমাদের ভূখণ্ড দখল করেছে।’’ জবাবে নওয়াজ বললেন, ‘‘আপনি যা বলছেন তা নিয়ে আমার কোনও ধারণাই নেই।আমি সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সাথে কথা বলে আপনাকে দ্রুত জানাব।’’ তৎকালীন পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী খুরশিদ মেহমুদ কুরেশী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, ওই ফোনালাপ শেষ হওয়ার আগে বাজপেয়ীজী নওয়াজ শরিফকে বলেন, ‘‘আমি চাই আমার পাশে বসা একজনের সাথে আপনি কথা বলুন, যিনি আমাদের আলোচনা শুনেছেন।’’ এটা ছিল দিলীপ কুমারের কণ্ঠ, যা কয়েক দশক ধরে সিনেমাপ্রিয় ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের হৃদয় শাসন করেছে এবং যা শুধু মিস্টার শরিফের কাছেই নয়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই সুপরিচিত ছিল। দিলীপ কুমার নওয়াজ শরিফকে বলেছিলেন, “মিঞা সাহেব এটা আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। আপনি সম্ভবত জানেন না যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন উত্তেজনা দেখা দেয় তখন ভারতে মুসলিমদের অবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, কখনও কখনও তাদের ঘরের বাইরে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়ে। দয়া করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছু একটা করুন।” উপমহাদেশের রাজনীতিকরাও কখনও কখনও মাথা রাখতেন দিলীপকুমারের বুকে। আর কাউকে নিয়ে এটা হওয়া সম্ভব ছিল না, উপমহাদেশে।

প্রথম প্রেমিকা মধুবালার সঙ্গে সাত বছরের সম্পর্ক ভেঙ্গেছিল কোর্টকাছারি দিয়ে, ১৯৬৬তে ৪৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন ২২ বছরের ছোট সায়রা বানুকে। পরে ১৯৮১তে ২ বছরের জন্য বৈবাহিক সম্পর্কে ছিলেন হায়দ্রাবাদের আসমা সাহিবার সঙ্গে। জীবনের চিত্রনাট্যে প্রেমকেই আগে রেখেছিলেন বড় পর্দার ‘ট্র্যাজেডি কিং’। কিন্তু নিঃসন্তান দিলীপ কুমারকে জীবনের শেষ দিন অবধি আগলে রেখেছিলেন সায়রা বানুই। তাদের যুগ্ম সফর হয়ত সুহানা হয়েছিল এভাবেই। অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের চার মহীরূহ একটা সময় বলিউড শাসন করতেন। তাঁদের মধ্যে বলরাজ সাহনী, রাজকাপুর, দেব আনন্দ, এই তিনজনকে আগেই হারিয়েছিল ফিল্মীজগত। চতুর্থজন, দিলীপ কুমার আজ সবশেষে চলে গেলেন অধিনায়কের মত, যেন বলিউডের “লাস্ট অব দ্য মোহিকানস” মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ড্রপসিনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে। ২০০০-২০০৬ অভিনেতা-কাম-রাজ্যসভার সদস্য হয়ে একাধিক জনকল্যাণকর কাজ করেছিলেন তিনি। আর কাউকে নিয়ে এগুলো হওয়াও সম্ভব ছিল না, জীবনের চিত্রনাট্যে।
শাকিল বাদাউনির কথায় নৌসাদের সুর ছিল দিলীপ কুমারের বহু ছবির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।মহম্মদ রফি ১৯৫৫র “উড়ান খাটোলা”য় গাইলেন “ও দূর কে মুসাফির”। মহম্মদ রফিই “মধুবন মে রাধিকা নাচে রে” গাইলেন কোহিনূর-য়ে (১৯৬০)। “মন মেরা এহসান” গাইলেন মহম্মদ রফিই “আন” (১৯৫২)ছায়াছবিতে। আবার শৈলেন্দ্রর কথায় সলিল চৌধুরীর সুরে “মধুমতী” (১৯৫৮) ফিল্মে মুকেশ গাইলেন “সুহানা সফর”, মহম্মদ রফি গাইলেন “টুটে হুয়ে খোয়াবোঁ মে”, “মুসাফির” (১৯৫৭) ফিল্মে দিলীপ কুমার নিজে গাইলেন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে “লাগি নেহি ছুট্টে”। মহম্মদ রফি-আশা ভোঁসলে গাইলেন নয়া দৌড় (১৯৫৭)-য়ের জন্য সাহির লুধিয়ানভির কথায় ও পি নাইয়ারের সুরে “উড়ে যব যব জুলফেঁ তেরি”। কিশোরকুমার-পঙ্কজ মিত্র গাইলেন “সাগিনা” (১৯৭৪) ছায়াছবির জন্য মজরুহ সুলতানপুরীর কথায় শচীন দেব বর্মণের সুরে “শালা ম্যায় তো সাহাব বন গয়া”।
সে ছিল এক অন্য সময়, অন্য জীবন, অন্য সংস্কৃতি এবং অন্য ভারত। সেই সময়, সেই জীবন, সেই সংস্কৃতি, সেই ভারতের এক অনন্য নায়ক দিলীপকুমার আজ চলে গেলেন এক “সুহানা সফর” শেষ করে, অন্য কোথাও, যেখানে তিনি হয়ত আবার বলে উঠবেন “শালা ম্যায় তো সাহাব বন গয়া”।
তিনি চলে গেলেন এবং তিনি রয়ে গেলেন।
“শম্মা রহে জায়গী পরওয়ানা চলা জায়গা…”