অধরাই থেকে গেল সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যাশা। তাতে অবশ্য হতাশায় ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা এখনও তৈরি হয়নি। তবে একটা মিশ্র অনুভূতি ছড়িয়ে রয়েছে এই বাংলার আকাশে বাতাসে। নির্বাচনের প্রচার পর্বের শুরু থেকেই তুমুল উন্মাদনার পারদ চড়িয়েও শেষমেষ ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন না ঘটার দায় কেবল মাত্র পরাজিত দলেরই। নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর প্রার্থী তালিকা প্রকাশে গড়িমসির কারণে কর্মীদের মধ্যে ধৈর্যচ্যুতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। যদিও বা এক এক করে ছ’দফায় তালিকা প্রকাশ হল কিন্তু প্রার্থীদের নাম দেখে হতবাক হয়েছে কর্মী থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই। এমন সব নাম সামনে এল যাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে আদৌ যুক্ত নন। কেউ কেউ আবার কুখ্যাত মাফিয়া না হয় ব্যবসায়ী। রাতারাতি উড়ে এসে জুড়ে বসা বেশ কিছু নেতা উপনেতার নামও সেই তালিকায় জায়গা পেয়ে গেল। যা দেখে দীর্ঘদিনের সক্রিয় অনুগত কর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হল। তাদের মনে সন্দেহের কালো মেঘের উদয় হল, এটা কীভাবে সম্ভব হল?

পাশাপাশি দেখা গেল একাধিক অভিনেতা অভিনেত্রীদের ভালো আসনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। যেখানে শিক্ষিত ওজনদার প্রার্থী দিলে জেতার সম্ভবনা ছিল, সে সম্ভবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া হল। তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করল, দল কি সত্যিই শাসক দলের সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে চায়? এমনই আশা নিরাশার দোলাচলে রাজ্যজুড়ে কর্মীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে যারা পাগলের মতো আবেগ দিয়ে দলটাকে ভালবেসে ছিল তারা মনে দ্বিধা নিয়েও শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের মাঠে উপস্থিত ছিল। আর অনুগত কর্মীদের একটা বড় অংশ যারা সোনালি পশ্চিমবঙ্গের আশা বুকে ধরে রেখেছিল তারা হতোদ্যম হয়ে প্রায় নিস্ক্রিয় হয়ে গেল। অবশ্য এখানে বলে রাখা ভাল যে ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের ফলাফল আশানুরূপ হওয়ার পর থেকেই প্রতিপক্ষ দল সচেষ্ট হয়েছিল হাওয়া ঘোরানোর খেলায়।  সে কাজে তারা যেথেষ্ট মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছে সে কথাবলাই যায়। অথচ যে দলটি দু’বছর আগে লোকসভায় ১৮টি আসন পেয়েছিল, সেই দলটি কেমন যেন নিস্প্রভ হয়ে গেল। অবাক হতে হয় দেখে যে ঝাড়গ্রাম এবং হুগলি এই দু’টো আসন লোকসভায় জিতলেও এবার এই কেন্দ্রগুলোর অধীনে সবকটি বিধানসভার আসনে হেরেছে।

এহেন ফলের পিছনে তাহলে গোপন কাহিনীটি কেমন? চলুন একবার বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া যাক। প্রতিপক্ষ দল যখন দুর্নীতির পাঁকে আকণ্ঠ ডুবে রয়েছে, সারদা-রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি, নারদা ঘুষকাণ্ড, গরু চোরাচালান, কয়লাপাচারের মতো কয়েক ডজন গুরুতর অভিযোগে সিবিআই আর ইডি রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তখন তাদের লড়াইটা ছিল বেঁচে থাকার লড়াই, শুধু ভোটে জেতার লড়াই ছিল না। তার উপর কয়েকজন সাংসদ ও বিধায়ক এইসব অপকর্মের সাজা স্বরূপ ইতিমধ্যেই জেল খেটে এসেছেন। তাই তারা এবারের ভোটে আট ঘাট বেঁধেই নেমেছিলেন। একদিকে নিজেদের দলের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার উদ্যোগ, অন্যদিকে বিরোধীদলকে দুর্বল করার প্রয়াস। যার জন্য সর্বোচ্চ নেত্রীকে বলতে শোনা গেছে, তোমরা কাটমানি ফেরত দিয়ে দাও, মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করো। আবার কখনও অভাব অভিযোগ শুনে মানুষের ইচ্ছাপূরণের জন্য দুয়ারে সরকারকে পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের ঘরে সুকৌশলে হানা দিয়েছেন। বুথস্তর থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত পদাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। এও দেখা গেল কাউন্টিং এজেন্ট থেকে ইলেকশন এজেন্টদের অধিকাংশ শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। যার ফলে বিজেপির কর্মীদের মনে স্বাভাবিক কারনেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন হয়েছে তেমনই কাউন্টিং সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তারা কাউন্টিং টেবিল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সব মিলিয়ে ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। বাংলার রাজনীতিতে অপরিপক্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপেশাদার আচরণ যারপর নাই হতাশ করেছে লক্ষ লক্ষ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে। নিরাশার ধূসর মরুপ্রান্তরে সোনালি স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

ভোটের প্রচার পর্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে উদ্দামতা দেখা গিয়েছিল কিংবা ফলাফলের পূর্বাভাসে যে ছবি ফুটে উঠেছিল, একদম তার বিপরীত ফল প্রকাশিত হল ২ মে।শাসকের পরিবর্তনের বদলে প্রত্যাবর্ত ঘটে  গেল! অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শাসক দলের বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি অনিয়মের অভিযোগ ছিল। চাল চুরি, ত্রিপল চুরি, রেশন চুরি, আমফানের টাকা বেআইনিভাবে হাতিয়ে নেওয়া, ভ্যাকসিন চুরি, মেডিক্যাল কলেজ থেকে কোভিড চিকিৎসার জন্য মহার্ঘ ইঞ্জেকশন (টোসিলিজুমাব) গায়েব করা এমন অনেক কিছু। যার পরিণামে দুর্দশার শিকার হয়েছে অতি সাধারণ মানুষ। তবে সব অভিযোগই কি অসত্য, ভিত্তিহীন? আসলে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। অধিকাংশ মানুষের স্মৃতিশক্তি স্বল্পায়ু। তাছাড়া গরীব ও প্রান্তিক মানুষজন যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাদের হাতে এককালীন টাকা কিংবা অস্থায়ী কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বঞ্চণার ক্ষোভকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা ফলদায়ক হয়েছে। সেইসঙ্গে বিরোধীদলের নীচু থেকে উঁচু স্তর পর্যন্ত পদাধিকারীদের কামিনী কাঞ্চণের দ্বারা বশীভূত করার কাজে সফলতা স্পষ্টত বিরোধী শিবিরকে দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষ দলের নেতাদের অনাকাঙ্খিত নৈতিক অবক্ষয়, প্রার্থী চয়নে আর্থিক বানিজ্য, সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে দুর্বলতা এবং অনভিপ্রেত রাজনৈতিক আচার আচরণ এই হতাশাজনক পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমন নানাবিধ কারণে ফলাফল এতটাই খারাপ হয়েছে যে লোকসভার নিরিখে জেতা আসনগুলিও সব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।