“বহুদিন পরে, আজ আবার কথা বলতে এলাম আপনাদের সাথে। কথা মানে আমার মনের কিছু কথা আপনাদের বলব আর আপনারা শুনবেন, প্রত্যুত্তর দেওয়া ছাড়াই। তাই এটা কথা বলা, কথাবার্তা বলা নয়। আামার নাম তো নিশ্চয়ই শোনা আপনাদের। আমার নাম বাজ্জিও। রবার্তো বাজ্জিও।
ইটালীতে কোভিড ছড়ানোর কারণে আমি আর অ্যান্ড্রেয়িনা এখন আর কোথাও যাই না খুব একটা আর আমিও ফুটবলের থেকে দূরে দূরেই থাকি আজকাল। ২০১৬র ইউরোর ফাইনাল রাউন্ডের পরে তো এবারের ইউরোর আগে কোনও বড় মঞ্চে খেলেইনি আমার দেশ। ২০১৮’র বিশ্বকাপের মূলপর্বে না যাওয়াটা আজও মেনে নিতে বিস্তর অসুবিধে হয় আমার। কিন্তু ওই ২০১৮রই সেপ্টেম্বর থেকে মানসিনি-র কোচিংয়ে টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত ইটালীর খেলা এবারের ইউরোর ফাইনাল রাউন্ডে শুরু থেকেই ফলো করছিলাম আমি আর আমার সমবয়সী স্ত্রী অ্যান্ড্রেয়িনা ফাব্বি বাজ্জিও।
অনেকেই জানেন, ২২ বছর বয়সে, ১৯৮৯তে বিয়ে করেছিলাম আমরা ৭ বছর প্রেম করার পরে। আমাদের তিন সন্তান ভ্যালেন্টিনা মাট্টিয়া আর লিওনার্ডো, সবাই এখন চাকরিসূত্রে অন্য জায়গাতে থাকে, ইটালীতেই। তাই গতকাল ভিসেঞ্জায় আমার বাড়ির ছোট্ট একটা অন্ধকার ঘরে বসে মনমরা আমি আর অ্যান্ড্রেয়িনা ইউরো কাপের ফাইনাল দেখছিলাম। ১৯৯৮য়ে শেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলাম আমি, ৩১ বছর বয়সে। তারপর তো ইটালীর সব খেলাই আমরা ৫ জনেই দেখতাম, একসঙ্গে বসে, কি টিভিতে, কি মাঠে গিয়ে। এই কারণেই খেলা দেখার সময়ে ভীষণ মনখারাপ গতকাল ঘিরে ছিল, আমাকে আর অ্যান্ড্রেয়িনাকে।
৩টে বিশ্বকাপ খেললেও (১৯৯০, ১৯৯৪ আর ১৯৯৮) কোনও বিশ্বকাপজয়ী টিম স্কোয়াডেই আমার নাম লেখা নেই, যে আক্ষেপটা আজও আমাকে তাড়া করে।১৯৯৪র বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারটা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারিনি আমি কোনওদিন। আর এই ইউরো কাপে তো আমি দেশের হয়ে খেলিইনি কোনওদিন, ১৯৯২ ছাড়া। আর সেবার তো ফাইনাল রাউন্ডেই পৌঁছতে পারেনি আমার ইটালী। ইটালীর ফুটবল শিল্পী, ইটালীর ফুটবল রাজপুত্র, আরও কত নামে দেশের লোক ডাকে আর চেনে আমাকে। অনেকে আবার এটাও বলে যে, রবার্তো বাজ্জিওর মতো শিল্পীদের বিশ্ব ফুটবলের লিজেন্ড হবার জন্য বিশ্বকাপ জেতার দরকার হয় না।
কাল খেলা দেখার সময় এমনিতে কিছু ফিলিং ছিল না। টানা ৩৩ ম্যাচ অপরাজিত ইটালীকে ছেড়ে সবাই ফেভারিট ধরেছিল ইংল্যান্ডকেই। তবে নির্ধারিত সময়ে দু’দলের দুই রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের (ইংল্যান্ডের শ’ আর আমাদের বোনুচ্চি) গোলে ১-১ ও তারপরের অতিরিক্ত সময়েও ওই ফল থেকে যাবার পরে, যখন টাইব্রেকার শুরু হতে যাচ্ছে, তখন ২৭ বছর আগের অতীত এসে ঘিরে ফেলছিল আমাকে, যেমন একসময় আমাকে ঘিরে ফেলত একরাশ প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারের ঝাঁক।

মনে পড়ছিল, আমার শরীরের ভেতরে অগুন্তি সেলাই। পেইন কিলারের অ্যালার্জিতে তার প্রত্যেকটা আমাকে জানান দিত, কখনও একসাথে, কখনও একটার পর একটা। কখনও আলাদা আলাদা, কখনও সদলবলে জোট বেঁধে। সেটা ১৯৮৫, আঠেরো বছর বয়েস তখন আমার। এই জ্বালা আর সহ্য হত না। ডাক্তার সেই কবেই বলে দিয়েছেন, খেলার আশা ছেড়ে দাও। তবু মন মানত না। এত কষ্ট কেন? কেন খেলতে না পারার যন্ত্রণার সঙ্গে মিশত শরীরের ভেতরে বাইরে চোটের নুনছিটে? এর চেয়ে মৃত্যুও ভাল। এমনই ভাবতাম তখন। ওরম মনে হয় মনের টালমাটাল অবস্থায়। তখন টিনএজার আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু শুরুতেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে ফিরে এসেছিলাম খেলায়। তারপরে আবার আরও বড় বিপদকে হারিয়েও ফিরেছিলাম। এভাবে বারবার ফেরার লড়াইয়ে শেষ হাসি হেসেছিলাম আমিই।
কিন্তু ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালের শেষে আমার টাইব্রেকারে পেনাল্টি মিসে প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের হাতে জয়মুকুটটা তুলে দিয়ে চরম বিষাদ আর তিক্ততা কিংবা দেশজোড়া ক্ষুব্ধ আর হিংস্র সমর্থকদের মুখের দিকে তাকিয়ে ১৮ বছর বয়সের সেই অনুভূতিটাই ফিরে আসত প্রতিক্ষণেই। ততদিনে তো ধর্ম বদলে ‘বুদ্ধিস্ট’ হয়ে আরও ধর্মপ্রাণ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু শেষমেষ আমিও তো মানুষই ছিলাম।তাই আরও কয়েক বছর যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর পর পাপমুক্তি পেরিয়ে যখন ওই প্রশ্নটা করতেন কেউ, জবাব দিতে এতটুকুও ভাবতাম না আমি। এক সাক্ষাৎকারে সরল স্বীকারোক্তি করেছিলাম, “আপনার মনে সম্ভাব্য যা যা আসতে পারে তার সবই এসেছিল আমার মনে”।
মনে পড়ছিল, তখন ইটালীর সেরা স্ট্রাইকার আমি গোল্ডেন বলের দাবিদারও ছিলাম সেই ১৯৯৪র বিশ্বকাপে।অসম্ভব মেধাবী, দ্বিতীয় স্ট্রাইকার হিসেবেও আতঙ্ক তৈরী করা প্রখর অনুমানশক্তির গেমমেকার বলত আমাকে সবাই। বৃত্তের মাঝামাঝি থেকে জালের প্রান্ত অবধি বিস্তৃত সাম্রাজ্যে প্রাণের উন্মাদনায় ভরা এক ফুটবলার ছিলাম আমি। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে কখনও প্রতিপক্ষের ঘর ভাঙতাম তো নিপাট মিডফিল্ডার হিসেবে নিজের ঘরে সৃষ্টিসুখ আনতাম।দর্শকদের চোখ জুড়াত, মন ভরত, চিন্তাভাবনা ফুরিয়ে যেত আমার খেলা দেখলে। সেবার আমেরিকা মজেছিল আমাতে। ৫টি গোল করে ইটালীকে নিয়ে গেলাম ফাইনালে। ১২ বছর পর আবার ফাইনালে ইটালী। সবাই ভাবলেন, ১৯৮২ সালের পর আবার সেবার, আমাতেই বাজিমাত করবে ইটালী। ফুটবল বিধাতা হয়ত তখন আড়ালে হাসছিলেন নিজের মনে।ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোলের ফাইনালে প্রায় লাখখানেক দর্শক। তাদের চিৎকারে কান পাতা দায়। দুই বড় শক্তির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে নির্ধারিত সময়ে গোল হল না। অতিরিক্ত সময় শেষেও ০-০ (যেটা গতকাল ছিল ১-১)।
অতঃপর পেনাল্টি শ্যুটআউট। শিরোপা নির্ধারণকারী শেষ পেনাল্টি শট এল আমার কাছে, ২-৩ পিছিয়ে তখন আমরা। ইতালীয়ানরা শটের আগে একশ শতাংশ নিশ্চিন্ত ছিল, সেটপিস বিশেষজ্ঞ আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমার শটের জেরে বল যেন পাখা মেলে বারের বেশ উপর দিয়ে উড়ে গেল কোন অসীম অজানায়। হতভম্ব আমি কোমরে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে রক্তাক্ত হচ্ছিলাম, পেছনে ছুটে আসছেন ওই শটের জেরে বিশ্বকাপ ফিরে পাওয়া ব্রাজিলের ফুটবলাররা, সামনে হাঁটু মুড়ে গোলরক্ষক টাফারেলের সেকি চিৎকার! এই ছবিটা আমার খুনে যন্ত্রণার সাথে স্থায়ী হয়ে আছে বিশ্বকাপের ইতিহাসে। কি নির্মম এই ফুটবল খেলা! সেদিন সবাই ভুলে গিয়েছিল, আমার শটে গোল হলেও শেষ শটে গোল করে ব্রাজিলের ৪-৩ জিতে যাবার সুযোগ ছিল ১০০ শতাংশ, আমি ছাড়াও আলবার্তিনি আর ইভানিও পেনাল্টিতে গোল পাননি সেদিন। তবু এক মুহূর্তে স্বর্গ থেকে পতন হল শুধু আমারই, নায়ক থেকে ভিলেন বানিয়ে সিংহাসন থেকে আস্তাকুঁড়েতে পৌঁছে দেওয়া হল শুধু আমাকেই, সেদিন। সেই বুকভাঙ্গা গল্প বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়েছিলাম অনেকদিন পরে। ওই যে বলছিলাম না, “যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখে গিয়েছিলাম।“ সেই সময় আগাগোড়া আমার পাশে ছায়ার মতো ছিল স্ত্রী অ্যান্ড্রেয়িনা।
মনে পড়ছিল, আসলে আমার জীবনটাই তো একের পর এক লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ানোর আর ফিরে আসার অন্তহীন গল্প। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ফুটবল-প্রাণদন্ডের আদেশ পাওয়া আমি ফ্রান্সের জমিতে জামিনে মুক্তি পাই চার বছর পরে, ১৯৯৮’র বিশ্বকাপে। টানা তিনটি বিশ্বকাপে মোট ৯টি গোল করা একমাত্র ইটালীয়ান আমি ততদিনে ঝুঁটিওয়ালা হয়ে গিয়েছিলাম, লোকে বলত “দ্য ডিভাইন পনিটেল”। ১৯৯৮-এ ইটালী শুরু করল চিলির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। খেলা শেষের পথে। ১-২ পিছিয়ে ইটালী। এই সময় গোল করতে উদ্যত আমাকে বক্সের মধ্যে ফাউলের কারণে পেনাল্টি পাই আমরা। কে নেবেন সে শট? আমিই এগিয়ে গেলাম। সেই ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ হারানো পেনাল্টি শটের পর আর কখনও ভাগ্যের খেলার পেনাল্টি কিক মারিনি আমি, কিন্তু তা অনুশীলন করেছি আমি মাঝের চার বছরের প্রতিটি দিন।কারও কারও সাহসের মৃত্যু হয় না কোনওদিন। পেনাল্টি থেকে গোল করে আমিই সেদিন হার বাঁচাই ইটালীর। চার বছর আগের শাপমোচন বা প্রায়শ্চিত্ত হয়েছিল ওখানেই। বুকের ওপর থেকে পাথরটা সরে গিয়েছিল আমার আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে আমি বলেছিলাম ‘‘যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম’’।
তাই কাল আমাদের ৫ পেনাল্টি শটের ৩টে গোল (গোল করেছিলেন বেরাদ্রি, বোনুচ্চি আর বেমার্দেশি) আর ২টো মিসের পর, পেনাল্টি মিস করা বেলোট্টি (২য় শট) আর জরজিনহোর (৫ম শট) পাশেই ছিলাম আমি মনে মনে। ইংল্যান্ডের কেন আর ম্যাগুইরি ১ম ২ শটে গোল দেবার পরের ২ শটে গোল মিস করে রেশফোর্ড আর স্যাঞ্চো, যেন আমারই “টিমমেট” হয়ে। ওদের ৫ম শট যখন মারতে আসছেন সাকা, চোখ বুজে ফেলেও ওয়েম্বলিতে ইউরো ২০২১-এর ফাইনালে সাকার জায়গায় আমি ২৭ বছর আগের ক্যালিফোর্নিয়ার রোজ বোলের বিশ্বকাপের ফাইনালে ১০ নম্বর নীল জার্সি পরা কাউকে দেখছিলাম।তার মতো সাকাও গোল পায়নি গতকাল, তা বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমাদের গোলরক্ষক জিয়ানলুগি দোনারোম্মা। আর আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম পাখা মেলে বারের বেশ উপর দিয়ে অসীম শূন্যে উড়ে যাওয়া একটা বলকে আবার দেখতে পেয়ে। আমার চিৎকার শুনে ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল আমার অধুনা ছায়াসঙ্গিনী অ্যান্ড্রেয়িনা।হয়ত আবার সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলি ফিরে আসার আতঙ্ক কাজ করছিল ওর মনে।
তবে ওইটুকুই, তারপর তো ইটালীর ইউরো জয়ে কোচ মানসিনিকে আর তার পুরো টিমকে অভিনন্দন বার্তা পাঠানো, ছেলেমেয়েদেরও ফোনে অভিনন্দন জানানো আর বাড়িতেই ছোট করে সেলিব্রেশন সব পরপর হতে থাকল। ওই ২৭ বছর আগের দুঃস্বপ্নের দিনগুলিকে আর মনে আনতে চাই না আমি, কোনওদিন।
ভাল থাকবেন সবাই, প্যান্ডেমিক থেকে সাবধানে থাকবেন।”