কলকাতার একদম কাছেই সুন্দর শান্ত জায়গা দেউলটি। শহরের দমবন্ধ করা মুখরতা থেকে মুক্তি পেতে রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত দেউলটি সপ্তাহান্তের ছুটির জন্য আদর্শ জায়গা। সড়কপথে মাত্র ৬০ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই আপনি পৌঁছে যাবেন এখানে। এখানকার আর একটি অন্যতম আকর্ষণ হল পানিত্রাসের সামতাবেড় গ্রামে কথাশিল্পী শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি, যেখানে তিনি জীবনের শেষ বারো বছর অতিবাহিত করেছিলেন। তাই ছুটির অবকাশে গ্রাম্য বাংলার প্রকৃতি আর পানিত্রাসের ইতিহাস যেকোনও পর্যটককে লুব্ধ করবেই। বর্ষা আগত, বর্ষায় রূপনারায়ণের নদীর রূপ পালটে যাবে একেবারেই। তাই যাওয়ার জন্য বেছে নেওয়াই যায় আসন্ন কালকে। আর কে না জানে গ্রাম বাংলায় বর্ষা কিংবা প্রাক-বর্ষার শ্যামলিমা, মাটির সোঁদা গন্ধ মনকে সিক্ত করে। এই ভরা গ্রীষ্মে গেলেও মন্দ লাগবে না, গিয়েছিলাম তাই বলতে পারি যে গ্রামটিতে এবং রিসর্টগুলির ভিতরে এত সবুজের সমাহার যে কলকাতার কংক্রিটের তীব্র গরম সেখানে অনুভূত হবে না।
আরও পড়ুন: বিপাশার উৎসমুখে
দেউলটিতে পাখি-প্রেমীরা অনেক রকম পাখি দেখতে পাবেন। ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেই হল। গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিংবা ভ্যানে করে ঘুরে দেখতে পারেন সবুজ শ্যামলা চিরন্তন প্রসারিত গ্রামীণ বাংলা। আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেত মনে সবুজ প্রলেপ লাগিয়ে দেবে। কোথাও আবার মেঠো পথের পাশে বেশ গা-ছমছমে বাঁশ বাগান, যেন এখুনি ভূতের রাজা ‘দিল বর’- যে ‘বর’-এর দৌলতে পড়ন্ত বিকেলে কিংবা ভোরবেলায় রূপনারায়ণ নদী-তীরের অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে ক্যামেরাবন্দি হতে চাইবে বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত। মনের আশ মেটাতে নৌকায় চেপে চলেও যেতে পারেন মাঝনদীতে (তবে আকাশের গতিবিধি বুঝেই সিদ্ধান্ত নেবেন)।
শরৎচন্দ্রের বাড়ির সামনে দিয়েই বয়ে গেছে রূপনারায়ণ, সে আমলে নাকি আরও চওড়া ছিল এ নদী, এ বাড়ির সামনে দিয়েই বয়ে যেত। লেখক নিশ্চয়ই জানলার পাশে লেখার ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে বসে উপভোগ করতেন রূপনারায়ণের রূপ আর লিখে যেতেন সুনিপুণ কলমে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় গ্রাম বাংলার কথা। এখন কালের নিয়মে রূপনারায়ণ সংকীর্ণ হয়েছে আর পিছিয়ে গেছে খানিকটা দূরে। এই বাড়িতেই বসে শরৎচন্দ্র ‘রামের সুমতি’ লিখেছিলেন। এই বাড়ির দোতলায় সংরক্ষণ করা হয়েছে লেখকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, চিত্তরঞ্জন দাশ যে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর নিয়মিত পুজো হয় এখনও। বাড়ির সামনে পুকুরটা দেখে সব পাঠকেরই ‘রামের সুমতি’র কার্তিক আর গণেশের কথা মনে পড়বে। ধানের গোলা, কাঠের বারান্দা, নীচের উঠোন সব জায়গায় লেখকের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই বাড়িতেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে তিনি মিটিং করতেন। তাই এই বাড়ির উঠোনে পা দিলেই শিহরণ হবে সব বাঙালিদেরই। লেখকের ভাইপো জয় চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বাড়ির সঠিক সংরক্ষণ দেখে যেকোনও পর্যটকের ভালো লাগবে। দেউলটি থেকে সামতাবেড় প্রায় তিন কিলোমিটার। ভাড়া কিংবা নিজেদের গাড়ি করেও যেতে পারেন অথবা গ্রাম্য পথ ধরে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারেন শরৎচন্দ্রের বাড়ি।
এক রাত্রি আর দুটি দিন ভালোই কাটবে দেউলটিতে। আগে থেকে রিসর্ট বুক করে রাখলে নিশ্চিন্ত। তারপর দল বেঁধে সবান্ধব বেড়িয়ে পড়লেই হল। শরৎচন্দ্রের বাড়ি ছাড়াও টেরাকোটার কাজ সমৃদ্ধ প্রাচীন আটচালার রাধা-গোবিন্দর মন্দিরও আছে এখানে। যদিও মন্দিরের জরাগ্রস্ত দশায় সময়ের ছাপ স্পষ্ট এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাব লক্ষণীয়। এই দেউলের জন্যই হয়তো এই জায়গার নাম দেউলটি।
কোথায় থাকবেন- নিরালা রিসর্ট কিংবা প্রান্তিক রিট্রিট এই দুই জায়গাই বেশ জনপ্রিয়। সবুজ মাঠ, প্রচুর গাছ, সুইমিংপুল ছাড়াও জলাশয় এই দুই রিসর্টের ভিতর অবস্থিত। পিকনিক, অফিস ট্যুর বা কনফারেন্স করার সু-বন্দোবস্ত আছে এখানে। গাড়ি রাখার বন্দোবস্ত আছে রিসর্টের মধ্যেই।রিসর্টগুলির সুস্বাদু বাঙালি খাবার আর বিস্তৃত এবং উন্মুক্ত সবুজ প্রকৃতি, ফুলের বাগান মনকে তৃপ্ত করবে।
কি করে যাবেন- ট্রেনে করে গেলে হাওড়া থেকে ধরতে হবে পাঁশকুড়া লোকাল, দেউলটি স্টেশনে নেমে ৬ নং জাতীয় সড়কের দিকে যেতে হবে। গাড়িতে গেলে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হয়ে কোনা এক্সপ্রেস হয়ে ৬ নং জাতীয় সড়কে বাগনান পেরিয়ে কোলাঘাটের দিকে একটুখানি গেলেই পেয়ে যাবেন দেউলটি ক্রসিং।
ছবি: কৌশিক দাস।
Comments are closed.