এইতো ২৫ দিন আগে, ৭১ পূর্ণ করেছিলেন তিনি, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
বাংলা রঙ্গমঞ্চের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেত্রী স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর জন্ম ২২ মে ১৯৫০, এলাহাবাদে। বেড়ে ওঠা সেখানেই। নাটকে অভিনয়ের পাঠ শুরু সেখানেই, সাতের দশকের গোড়ার দিকে। শিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে পেয়েছিলেন অনুকূল চন্দ্র ব্যানার্জীকে, ‘গাইডেন্স’ পেয়েছিলেন বি ভি করন্থ, তাপস সেন, খালেদ চৌধুরীর কাছ থেকে।
১৯৭৫-৭৬-এ এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি, এরপরে কলকাতায় চলে আসা এবং ১৯৭৮ সালে ‘নান্দীকার’এ যোগদান। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত’র পরিচালনায় নাট্যশিক্ষা, অভিনয় এবং অবশেষে তার ঘরণী হওয়া। তাঁর এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর একমাত্র কন্যা সোহিনী সেনগুপ্ত এখন নান্দীকারের অগ্রণী চরিত্র।
নান্দীকারে তাঁর জড়িয়ে থাকা প্রযোজনাগুলির মধ্যে ছিল ‘ফুটবল, ‘শানু রায়চৌধুরী’, ‘পাতা ঝরে যায়, ‘দুলিয়া, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘মাধবী’, ‘কানু’, ‘অন্ত-আদি-অন্ত’, ‘নানা রঙের দিন’, ‘নাচনী’, ‘বিপন্নতা’, ‘পাঞ্চজন্য’, ‘আলিফা’, ‘রাণী কাদম্বিনী’, ‘মানুষ’ প্রভৃতি।
শম্ভু মিত্রর প্রযোজনার গ্যালিলেও নাটকে একটি ছোট্ট চরিত্রায়ণ করে তিনি সত্যজিৎ রায়ের নজরে পড়েন। কলকাতায় আসার বছর ছয়েকের মধ্যে তিনি সত্যজিৎ রায়ের ডাক পান তাঁর পরিচালিত ‘ঘরে বাইরে’ ছায়াছবিতে ‘বিমলা’ চরিত্র রূপায়ণের জন্য। রবি ঘোষের কাছে এ খবর পেয়ে এক বনধের দিনে ১৪ কিলোমিটার হেঁটে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই বনধের দিনে নিজের বাড়ির দরজায় তাঁকে দেখে চমকে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তারপরে সত্যজিৎ রায়ের তাঁকে দেখে দু’একটি স্কেচ করা ও অবশেষে ‘বিমলা’ চরিত্রর জন্য তাঁকে মনোনীত করা এবং সহ-অভিনেতা হিসেবে পেয়ে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভিক্টর বন্দোপাধ্যায়কে। পরিচালক সত্যজিত রায়কে তাঁর মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিকাসো ও বিঠোভেনের সমাহার।(তথ্য- ফিল্মফেয়ার পত্রিকায় স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর দেওয়া সাক্ষাৎকার)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ঘরে বাইরে’র চিত্ররূপ ‘ঘরে বাইরে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি। তার আগে কান শহরে ‘ঘরে বাইরে’র প্রিমিয়ার হয়েছিল। ‘বিমলা’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শকের কাছে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সময় তাঁকে আগলে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এর ঠিক ৩০ বছর পরে, ২০১৫য় ‘বেলাশেষে’ ছিল তাঁর পরের অভিনীত বাংলা ছায়াছবি। এরপরে আর চারটি ছায়াছবিতে তিনি অভিনেত্রী হিসেবে জড়িয়ে ছিলেন, হিন্দী ছায়াছবি ‘চৌরঙ্গ’ (২০১৬), এবং আবার বাংলায় ‘বরফ’ (২০১৯) আর এখনও মুক্তির অপেক্ষারত ‘বেলা শুরু’ ও ‘ধর্মযুদ্ধ’। ১৯৯২ সালে রোনাল্ড জফের ‘সিটি অফ জয়’ ছায়াছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন।
ভারতীয় নাটকে তাঁর অভিনয় অবদান ২০১১তে তাঁকে এনে দিয়েছিল সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার।পশ্চিমবঙ্গ নাট্যসাংবাদক সঙ্ঘর দেওয়া পুরস্কার ও পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারেরও সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি।
আজ পয়লা আষাঢ়ের মেঘলা মনখারাপী দুপুরে বাংলার মনখারাপ বাড়িয়ে তিনি চলে গেলেন জীবন নাট্যমঞ্চের বাইরে। কিডনির অসুখে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।আচমকাই ‘বেলাশেষে’ পৌঁছে গেল বাংলা নাট্যমঞ্চের সোনালী একটা সময়।
ভালো থাকবেন, মঞ্চে ‘নানা রঙের দিন’ কাটিয়ে আজ ‘বেলাশেষে’র ‘অজ্ঞাতবাস’এ চলে যাওয়া স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।
Comments are closed.