পঁচিশে বৈশাখ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনটি এখন আমাদের জীবনে একটি বাৎসরিক উৎসবের মতোl যদিও আধুনিক বঙ্গজীবনে নানা কারণে তা ক্রমহ্রাসমানl এই দিনটিতে প্রতিবছরই আমরা দিকে দিকে স্কুল, কলেজ, ক্লাব, বিভিন্ন অফিস সংগঠন ও আরও নানা প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করিl আমরা নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু, উদ্যান ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গ করিl সভায় সভায় রবীন্দ্রনাথের গান গাই, তাঁকে কতটা মহান রূপে আমরা জেনেছি তা প্রমাণিত করতে চেষ্টা করিl তিনি এই বলেছিলেন, তিনি ঐ ঐ বলেছিলেন, তাঁর আদর্শ, তাঁর প্রদর্শিত পথকে অনুসরণ করতে হবে, এসব কথাই সকলে বলে থাকেনl কিন্তু তারপর আমরা রবীন্দ্রনাথের আদর্শের কথা, রবীন্দ্রনাথের প্রদর্শিত পথের কথা, রবীন্দ্রনাথের কর্মধারার কথা ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে আমাদের সমাজ জীবনকে চালিত করিl আজকের সময়ে আমরা জানতেও চেষ্টা করি না কি ছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শ ও জীবনকে চালিত করার শক্তিl
রবীন্দ্রনাথ ভারতের সনাতন আধ্যাত্মিক পরিবেশের অনুসরণে তপোবনের যে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদর্শে ‘শান্তিনিকেতন’এর কথা ভেবেছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় যেভাবে তাকে গড়ে তুলেছিলেন সেই ভাব আর ভাবাদর্শ আজকের ‘শান্তিনিকেতনে’ কতটুকু ছায়া ফেলে তা ভেবে দেখার বৈ কীl
রবীন্দ্রনাথ যে ভাব ও ভাবাদর্শের কথা তাঁর লেখনীতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তার কতটুকুর আমরা রূপায়ণ ঘটিয়েছি আমাদের জীবনে ও সমাজে? শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিকে বিজ্ঞাপনী মডেলের মতো আমাদের নানাবিধ আত্মপ্রচারমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করছি আর রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শের বিপরীত স্রোতে, পাশ্চাত্যের অনুসারী জীবন যাপনে আধুনিকতার লেবেল সেঁটে হাঁটতে ভালোবাসছি প্রায় সবাইl ভারতীয় সুপ্রাচীন সভ্যতা তথা সংস্কৃতির অনুসরণে রচিত রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার আদর্শ ও স্বপ্ন উপেক্ষিতই থেকে গেলl কীভাবে? সে বিষয়টি এবার একটু দেখে নেওয়া যাকl
রবীন্দ্রনাথ যে দুটো গ্রন্থকে জীবনের পরম সম্পদরূপে আঁকড়ে ধরেছিলেন সে দুটি গ্রন্থ হল –‘উপনিষদ’ এবং বৃন্দাবন দাস ঠাকুর রচিত ‘চৈতন্য ভাগবত’l এই দুটি গ্রন্থ ছিল তাঁর কাছে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মতো সে কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেই ঘোষিতভাবে স্বীকার করেছেনl পরবর্তীকালে শ্রীমদ্ভগবদগীতা’র বাণীও তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেl রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় ও পত্রাবলীতে ‘গীতা’ সম্বন্ধে অসংখ্য প্রশস্তি ও কথা উল্লেখ রয়েছেl ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থে গীতা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘‘ভগবদ্গগীতা আজও পুরাতন হয়নিl হয়ত কোনওকালেই পুরাতন হবে না।’’ অতএব রবীন্দ্র জীবন ও ভাবাদর্শের মধ্যে যে এই গ্রন্থসমূহের প্রভাব থাকবে তাতে সন্দেহ নেইl নিজস্ব পরিমন্ডল ও সমাজকে তিনি ঐ ভারতীয় সুপ্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য অনুসারেই অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত করতে চেয়েছিলেনl
এই বিষয়ে রবীন্দ্রগবেষক শ্রীসুনীলচন্দ্র সরকার ১৯৬৪ সনে প্রকাশিত তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন ও সাধনা’ নামক গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, “১৯০১ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন স্থাপন করেছিলেন তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও সাধনা- যা ছিল মহর্ষির দৃষ্টান্ত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত- তার মধ্য দিয়ে ভারতের প্রাচীন আধ্যাত্মিক আস্পৃহা, তাঁর তপোবন আদর্শ ও ঔপনিষদিক সংস্কৃতির ভাব ও ভাবনায় গভীরভাবে নিমগ্ন হয়েছিলেনl তাঁর মন ও কল্পনাকে দৃঢ়ভাবে আকর্ষণ করেছিল একটি নবপ্রভাতের চেতনা, স্বদেশের একটি আধ্যাত্মিক পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা, বর্তমান যুগ-চিত্তের পক্ষে গ্রহণযোগ্য করে তিনি ঐ প্রাচীন আধ্যাত্মিক আদর্শটিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেনl’’
শান্তিনিকেতনের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের প্রথম কয়েকটি উদ্দেশ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণে তিনি শিক্ষাকে বর্ণনা করেছিলেন ব্রত বলে এবং ঈশ্বরকে বর্ণনা করেছিলেন ব্রতপতি রূপে, যিনি সেই সংকল্প উদযাপনের অধীশ্বরl তিনি আরও বলেছিলেন যে এই আশ্রমের রূপ নিয়ন্ত্রিত হবে তার নির্জনতা, অশিথিল নিয়মতান্ত্রিকতা, জাগতিক বিলাস বস্তু ও বাড়তি সুখ সুবিধা বর্জন , অশুভ প্রবৃত্তির দমন, আদর্শ ও সেই আদর্শের প্রতীক গুরুর প্রতি অবিমিশ্র শ্রদ্ধা এবং কর্তব্যবোধ ও সেবার মনোভাব দ্বারাl গুরু ও শিষ্যের মধ্যে সম্পর্কটি অবশ্যই হবে আধ্যাত্মিকl ‘‘শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম’’ নামক পুস্তিকাটিতে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু দৈনিক নিত্যকৃত্য ও অনুষ্ঠানের উল্লেখ করে একটি নিয়ম তালিকার প্রণয়ন করেছিলেনl ঐ তালিকায় তিনি ওঁ ভূ র্ভুবঃ স্বঃ গায়ত্রীমন্ত্র অবলম্বনে ধ্যানের বিষয়টিও যুক্ত করেছিলেনl

পরাধীন ভারতে বৃটিশ শাসনাধীনের সময়েও অনেক ভারতীয়ের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি এক অহেতুক আকর্ষণ, আনুগত্যবোধ ও অভিরুচি লক্ষ্য করা গেছেl যেন ইংরেজ আদব কায়দা আর ভাষা শিক্ষা করলেই মানুষরূপে সভ্য হওয়া গেলl স্বাধীন ভারতে তো এই প্রবৃত্তি মানুষের মধ্যে আরও প্রবলl নিজের মাতৃভাষা, মনন ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে চতুর্দিকে ইংরাজীয়ানায় নিজ ছেলে মেয়েদের উৎসর্গ করার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছেl ফলে এক বকচ্ছপ জাতীয় বিচিত্র বাঙালী জাতির সৃষ্টি হচ্ছে, যারা বাঙলা মোটামুটি বলতে পারলেও, লিখতে পড়তে পারে নাl ভবিষ্যতে এক হীনমন্যতার মানসিক অসুখে ভুগবে এইসব ছেলেমেয়েরা সাংস্কৃতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েl কেননা, প্রকৃত ইংরাজী মনন ও সংস্কৃতি যেমন এদের নির্ভেজালভাবে বুকে টেনে নেবে না, তেমনি এরা ফিরেও আসতে পারবে না নিজ মাতৃক্রোড়ের মতো অমলিন আপন স্বজাতীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনেl
রবীন্দ্রনাথ এই ব্যপারটি অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন আর তাই এই প্রবণতার বিরোধী ছিলেনl তিনি এ বিষয়ে লিখেছিলেন- ‘‘আমাদের দেশের যে বিশেষ মহত্ব ছিল সেই মহত্বের মধ্যে নিজের প্রকৃতিকে পূর্ণতা দান করিতে পারিলেই আমরা যথার্থভাবে বিশ্বজনীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হইতে পারিব- নিজেকে ধ্বংস করিয়া অন্যের সহিত মিলাইয়া দিয়া কিছুই হইতে পারিব না l অতএব, বরঞ্চ অতিরিক্ত মাত্রায় স্বদেশাচারের আনুগত্য ভালো, তথাপি মুগ্ধভাবে বিদেশীর অনুকরণ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ মনে করা কিছু নয়l’’
প্রাচীন ভারতে যেভাবে মুক্ত প্রকৃতির মাঝে থেকে ও গুরুগৃহে থেকে শিশু কিশোরদের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল, মনের বিকাশ ও সুষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থার স্বার্থে ঐ ধরনের আশ্রমিক ও গুরুকুল শিক্ষা ব্যবস্থাই রবীন্দ্রনাথের পছন্দের ছিল l এই বিষয়ে ১৩১৩ বঙ্গাব্দে লিখিত ‘শিক্ষা সমস্যা’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছিলেন তার বেশ কিছুটা হুবহু তুলে ধরলাম- ‘‘মন যখন বাড়িতে থাকে তখন তাহার চারিদিকে একটা বৃহৎ অবকাশ থাকা চাইl বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে সেই অবকাশ বিশালভাবে বিচিত্রভাবে সুন্দরভাবে বিরাজমানl কোনোমতে সাড়ে নয়টা দশটার মধ্যে তাড়াতাড়ি অন্ন গিলিয়া বিদ্যাশিক্ষার ‘হরিণবাড়ি’ মধ্যে হাজিরা দিয়া কখনোই ছেলেদের প্রকৃতি সুস্থভাবে বিকাশ লাভ করিতে পারে নাl শিক্ষাকে দেয়াল ঘিরিয়া, গেট দিয়া রুদ্ধ করিয়া, দরোয়ান দিয়া পাহারা বসাইয়া, শাস্তি দ্বারা কণ্টকিত করিয়া, ঘন্টা দ্বারা তাড়া দিয়া, মানব জীবনের আরম্ভে এ কী নিরানন্দের সৃষ্টি করা হইয়াছে! শিশু যে অ্যালজেব্রা না করিয়াই, ইতিহাসের তারিখ না মুখস্থ করিয়াই মাতৃগর্ভ হইতে ভুমিষ্ট হইয়াছে, সে জন্য সে কি অপরাধী? তাই সে হতভাগ্যদের নিকট হইতে তাহাদের আকাশ বাতাস, তাহাদের আনন্দ অবকাশ, সমস্ত কাড়িয়া লইয়া শিক্ষাকে সর্বপ্রকারেই তাহাদের পক্ষে শাস্তি করিয়া তুলিতে হইবে?
তাই আমি বলিতেছি, শিক্ষার জন্য এখনও আমাদের বনের প্রয়োজন আছে এবং গুরুগৃহও চাইl বন আমাদের সজীব বাসস্থান এবং গুরু আমাদের সহৃদয় শিক্ষকl এই বনে এই গুরুগৃহে আজও বালকদিগকে ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া শিক্ষা সমাধা করিতে হইবেl কালে আমাদের অবস্থার যতই পরিবর্তন হইয়া থাক, এই শিক্ষা নিয়মের উপযোগিতার কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই, কারণ এ নিয়ম মানব চরিত্রের নিত্যসত্যের উপর প্রতিষ্ঠিতl

অতএব, আদর্শ বিদ্যালয় যদি স্থাপন করিতে হয় তবে লোকালয় হইতে দূরে নির্জনে মুক্ত আকাশ ও উদার প্রান্তরে গাছপালার মধ্যে তাহার ব্যবস্থা করা চাইl সেখানে অধ্যাপকগণ নিভৃতে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনায় নিযুক্ত থাকিবেন এবং ছাত্রগণ সেই জ্ঞানচর্চার যজ্ঞক্ষেত্রের মধ্যেই বাড়িয়া উঠিতে থাকিবেl
যদি সম্ভব হয় তবে এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে খানিকটা ফসলের জমি থাকা আবশ্যক, এই জমি হইতে বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় আহার্য সংগ্রহ হইবে, ছাত্ররা চাষের কাজে সহায়তা করিবেl দুধ ঘি প্রভৃতির জন্য গোরু থাকিবে এবং গোপালনে ছাত্রদিগের যোগ দিতে হইবেl পাঠের বিশ্রামকালে তাহারা স্বহস্তে বাগান করিবে, গাছের গোড়া খুঁড়িবে, গাছে জল দিবে, বেড়া বাধিবে l এইরূপে তাহারা প্রকৃতির সঙ্গে কেবল ভাবের নহে, কাজের সম্বন্ধও পাতাইতে থাকিবেl
অনুকূল ঋতুতে বড়ো বড়ো ছায়াময় গাছের তলায় ছাত্রদের ক্লাস বসিবেl তাহাদের শিক্ষার কতক অংশ অধ্যাপকের সহিত তরুশ্রেণীর মধ্যে বেড়াইতে বেড়াইতে সমাধা হইবেl সন্ধ্যার অবকাশ তাহারা নক্ষত্র পরিচয়, সঙ্গীত চর্চায়, পুরাণ কথা ও ইতিহাসের গল্প শুনিয়া যাপন করিবেl
অপরাধ করিলে ছাত্রগণ আমাদের প্রাচীন প্রথা অনুসারে প্রায়শ্চিত্ত পালন করিবেl শাস্তি পরের নিকট হইতে অপরাধের প্রতিফল, প্রায়শ্চিত্ত নিজের দ্বারা অপরাধের সংশোধনl দণ্ডস্বীকার করা যে নিজেরই কর্তব্য এবং তা না করিলে যে গ্লানিমোচন হয় না, এই শিক্ষা বাল্যকাল হইতে হওয়া চাই- পরের নিকটে নিজেকে দণ্ডনীয় করিবার হীনতা মনুষ্যোচিত নহেl
যদি অভয় পাই তবে এই প্রসঙ্গে সাহসে ভর করিয়া আর একটা কথা বলিয়া রাখি, এই বিদ্যালয়ে বেঞ্চি, টেবিল, চৌকির প্রয়োজন নাইl আমি ইংরেজি সামগ্রীর বিরুদ্ধে গোঁড়ামি করিয়া এই কথা বলিতেছি, এমন কেহ যেন মনে না করেনl আমার বক্তব্য এই যে, আমাদের বিদ্যালয়ে আবশ্যককে খর্ব করিবার একটা আদর্শ সর্বপ্রকারে স্পষ্ট করিয়া তুলিতে হইবেl চৌকি, টেবিল, ডেস্ক, সকল মানুষের সকল সময়ে জোটা সহজ নহে, কিন্তু ভূমিতল কেহ কাড়িয়া লইবে নাl চৌকি টেবিলে সত্যসত্যই ভূমিতলকে কাড়িয়া লয়l এমন দশা ঘটে যে, ভূমিতল ব্যবহার করিতে বাধ্য হইলে সুখ পাই না, সুবিধা হয় নাl ইহা একটা প্রকাণ্ড ক্ষতিl’’
এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে যেটুকু উদ্ধৃত করা হল সেটুকুর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি সমর্থন ও তাঁর ভাবাদর্শ পাঠকগণ সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন আশা করিl
প্রথমত আমরা বুঝতে পারি যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্য রবীন্দ্রনাথ ভারতের সুপ্রাচীন গুরুকুল বিদ্যালয় প্রথাকেই বিশ্বাস করতেনl যা শহুরে অট্টালিকার ভীড়ে আবদ্ধ থাকত না বরং বিকশিত হত প্রকৃতির নির্জন মাধুরীর মধ্যেl
দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কটি হবে গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের মতোই আধ্যাত্মিকl
তৃতীয়ত , তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের জন্য যে বেশ কিছু নিত্যকৃত্য অনুষ্ঠানের নিয়ম করেছিলেন, সেখানে গায়ত্রী মন্ত্র অনুশীলনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেনl বৈদিক গুরুকুল আশ্রম অনুসারে আশ্রমে ছাত্ররা যেমন কৃষিকাজ শিখে আহার্য সংগ্রহ করবে, ফুল ফল গাছের প্রতি যত্নবান হবে, তেমনি তারা পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে গোপালনও করবেl সন্ধ্যায় বাগানে বা মাঠে শিক্ষকের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে আকাশের নক্ষত্র চিনবে, পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাসের গল্প শুনবেl অর্থাৎ বক্তব্যকে আরও দীর্ঘায়িত না করেই বলা যায় যে প্রাচীন ঋষি মহর্ষিগণের প্রদর্শিত পূর্ণ ভারতীয় ভাবাদর্শই রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাঝে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেনl এমনকি বিদ্যালয়ে চেয়ার টেবিল বেঞ্চি ডেস্কও রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন লাভ করেনিl পূর্ণ স্বদেশী ব্যবস্থার প্রতিই তাঁর আস্থা ছিল বেশিl এর কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর লেখনীতেl চরিত্র গঠনের জন্য তিনি ব্রহ্মচর্যের অনুশীলনের উপর জোর দিয়েছিলেনl
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এইসব ভাবাদর্শের কথা আজ কে আর মনে রাখছে? বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডার কিংবা বাঁধানো ফটো রেখে আর বুকশেলফে রবীন্দ্রনাথের কিছু বই বা রবীন্দ্র রচনাবলী সাজিয়ে রাখার মধ্যেই তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য যেন সীমাবদ্ধl বছর কুড়ি ত্রিশ আগেও বাড়িতে বাড়িতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজতl এখন কোনও বাড়ি থেকে সে আওয়াজও আর ভেসে আসে নাl তাঁর ভাবাদর্শের বিপরীত পথে অন্ধ পাশ্চাত্য অনুকরণের পথেই সমাজ যেন আজ ঢলে পড়েছেl কলকাতার রবীন্দ্র সদনে পঁচিশে বৈশাখের ভোর বেলা যে আন্তরিক অনুষ্ঠানটি হত , সেটিও এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছেl রবীন্দ্রনাথের যেটুকু জন্মদিন আজ ঘটা করে প্রাণহীনভাবে পালিত হয় , সেটা যেন আজ এক সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষাl কোথাও বা শুধুই নিয়ম রক্ষাl কিন্তু অন্তরালে রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শ ও শিক্ষা উপেক্ষিতই থেকে গেল বাঙালী জীবনেl