ভারত এবং আমেরিকার রাজনীতিতে একটা মৌলিক পার্থক্য, রাজনৈতিক দলগুলির গঠন এবং বিবর্তন। ভারতের রাজনীতিতে সব রাজনৈতিক দলই একটা আদর্শের রূপরেখাতে চলার চেষ্টা করে- সেই আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে স্বপ্ন দেখায় তারা পরিবর্তন আনবে।
এবার জনগণ সেটা বিশ্বাস করবে কি না, সেটা নির্ভর করছে, সেই দল পরীক্ষিত, না নতুন শক্তি তার উপর। যেমন ধরুন, সিপিআইএম ইস্তেহারে যতই ভাল কথা লিখুক বা বাম রাজনীতি কেন উপাদেয় এই নিয়ে লেখালেখি করুক না কেন, তাদের কথাকে বিশ্বাস করার মতন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ, তারা যে ‘অপদার্থ’ তা জনগণ গত ৩৪ বছরে বুঝে নিয়েছে। কংগ্রেসেরও প্রায় একই অবস্থা। তুলনামূলকভাবে তৃণমূল এবং বিজেপি বঙ্গ রাজনীতিতে নতুন ‘ফোর্স’। এর মধ্যে ১০ বছর রাজত্ব করার জন্য তৃণমূলের প্রতিশ্রুতিও অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আবার অনেকেই আছেন যারা মনে করেন দিদি কথা রেখেছেন।
মূলত এই পটভূমিকাতেই বিজেপি’র পোয়াবারো। যেহেতু বাংলায় তারা এখনও পরীক্ষিত না। অনেক বাম সমর্থকই বিজেপিকে সুযোগ দিতে চান, যদি বিজেপি বাংলার জন্য ভাল কিছু করে, এই ভেবে। আবার বিজেপি যেহেতু দেশের গদিতে গত সাত বছর ধরে রয়েছে, সেহেতু অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা মনে করেন, চাইলেই বিজেপি ম্যাজিক্যালি কিছু করতে পারবে না এবং ভারতের অর্থনীতি এখন ধুঁকছে। যারা ভারতের অর্থনীতি ভাল ভাবে পরিচালিত করতে পারেনি, তারা বাংলার অর্থনীতি ঘোরাবে, এটা অনেকেই বিশ্বাস বিশ্বাস করতে পারছেন না।
জীবন খুবই কঠিন, এবং সেটাই বাস্তব- সেই ভাবে ভেবে গেলে কিন্ত আবার বাঁচার ইচ্ছাটাই চলে যাবে। মানুষ সব সময় বেঁচে থাকে সামনে ভাল দিন দেখবে বলে। প্যারাডক্স এটাই, সেই ভাল দিন আর আসে না। কিন্ত অতীতের দিনগুলো যা তখন মনে হত খারাপ, কত কঠিন, তার স্মৃতিচারণেই মানুষ বোঝে সেই দিনগুলো হয়ত ভালোই ছিল।
অর্থাৎ নতুন “আশা” এবং “দিশা” ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে বোঝাতে হবে আপনি নতুন কিছুতে সক্ষম। বামেদের ব্যর্থ হওয়ার মূল কারণ, তারা যতক্ষণ না পর্যন্ত সব কিছু খোল নলচ বদলে নতুন ধরনের পার্টি হওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিচ্ছে, কেউ তাদের বিশ্বাস করবে না। কিন্ত আব্বাসের হাত ধরে বা ঐশীদের নামিয়ে তারা প্রমাণ করেছেন, বাংলার বাম, আরও পচাগলা বামে পরিণত হচ্ছে। ফলে যেকোনও গণতন্ত্রে যেখানে হেসে খেলে ২০-৩০% বাম ভোট পাওয়া যায়, তারা ৫% পাবেন কি না সন্দেহ। এবং সেটাই তৃণমূলের গলার ফাঁস এখন। কারণ, বামেরা তাদের ২০% ভোট ব্যাঙ্ক না রাখতে পারলে, সেটা বিজেপি’র কাছে যাবে।
আমেরিকার গণতন্ত্রেও এই “হোপ” বা আশা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্ত সেক্ষেত্রে পার্টি না ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকার পার্টিগুলো একটি টেন্ট বা তাবু। সেই টেন্টে সব আদর্শের লোক থাকে। ডেমোক্রাটদের মধ্যেও বাইডেন এবং বার্নির মতো পথের পার্থক্য অনেকটাই-কংগ্রেস বনাম সিপিএমের সমান। এখানে সুবিধা হচ্ছে এই ‘হোপ’ বা আশা দেন নতুন প্রার্থী। যেহেতু দল প্রার্থীর আদর্শকে সেন্সর করে না বা করতে পারে না। সেহেতু পার্টির আদর্শ বলে কিছু হয় না। নতুন নতুন প্রার্থীরা নতুন আদর্শ নতুন আশার আলো দেখান।
আমি আরেকটু গভীরে ব্যাখ্যা করি। আসলেই আমাদের জীবন খুব কঠিন, এবং রাফ। এই জীবন আগেও কঠিন ছিল, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। স্টয়িক দর্শনের এটাই ভিত্তি।
যদিও জীবন খুবই কঠিন, এবং সেটাই বাস্তব- সেই ভাবে ভেবে গেলে কিন্ত আবার বাঁচার ইচ্ছাটাই চলে যাবে। মানুষ সব সময় বেঁচে থাকে সামনে ভাল দিন দেখবে বলে। প্যারাডক্স এটাই, সেই ভাল দিন আর আসে না। কিন্ত অতীতের দিনগুলো যা তখন মনে হত খারাপ, কত কঠিন, তার স্মৃতিচারণেই মানুষ বোঝে সেই দিনগুলো হয়ত ভালোই ছিল।
সেইজন্যে গণতন্ত্রে স্টয়িক দর্শন চলে না। আসলে মানুষ যে এত গান শোনে, সিনেমা দেখে- এর একটাই কারণ। এই কঠিন জীবনে বেঁচে থাকার জন্য দরকার “আশা” বা “হোপ”। Light at the end of the tunnel. সেই জন্য সব গণতন্ত্রেই প্রতিটি রাজনৈতিক দল দাবি করে, সাধারণের দু’র্দশার জন্য অন্য দল দায়ী আর তারাই “হোপ”-তারাই ভবিষ্যতের আশা।
মানুষও এই ভাবেই ভাবতে ভালবাসে। ফলে ভারতের গণতন্ত্রে ক্ষমতাশীল দলগুলো বা যারা আগে ক্ষমতায় ছিল-তারা যদি নতুন মুখ, নতুন ফর্মে নিজেদের রিনোভেট না করে, তাহলে তাদের প্রতিশ্রুতিতে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখানেই বাংলার রাজনীতিতে বাম এবং কংগ্রেস ব্যর্থ সম্পূর্ণ। তৃণমূল পিকে’কে এনে কিছুটা ‘রিনোভেশন’ করেছে। সবটা না। বিজেপির রিনোভেশনের দরকার এখনও পড়েনি, যেহেতু বাংলায় তারা নতুন এবং ডেমোগ্রাফিক এনেক্সজাইটি তাদের ফেবারে। কিন্ত আস্তে আস্তে তাদের হিন্দুত্ববাদের আবেদনও ফিকে হবে। যেমন বামেদের গরিব দরদি আবেদনে এখন লোকহাঁসাহাসি ছাড়া কিছু পাওয়ার নেই।
মোদ্দা কথা স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং জনগণ সেই স্বপ্নে বিশ্বাস করবে। এই ভাবেই চলে গণতন্ত্র। মোদী স্বপ্ন দেখাতে ওস্তাদ এবং তার জন্যেই ক্ষমতায়। কিন্ত যত দিন যাবে লোকে স্বপ্ন এবং স্বপ্নদোষের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হবে। এটাও সব দলকেই মাথায় রাখতে হবে।
আসলে আমরা ব্যর্থ রাজনীতির শিকার- এটা ভেবে সান্ত্বনা পাওয়া যায় যে আমাদের দুর্দশা, কঠিন জীবনের জন্য অন্য কেউ দায়ী। তাকে হটালেই স্বর্গ নেমে আসবে। এটা এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল টনিক। যা মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে । রাজনীতি সেটার প্রতিফলন মাত্র।