তিন তালাকের বিরুদ্ধে অর্ডিন্যান্স জারি মোদী সরকারের একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। গত ১৯ শে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সে সই করার সঙ্গে সঙ্গেই শরিয়তি তিন তালাক আইন একটি দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এরফলে ভারতের মাটিতে তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের একটি অধ্যায় সমাপ্ত হল। মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীর মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে এই অধ্যায়টি ভারতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এই ইতিহাসটি রচনায় নরেন্দ্র মোদী অপ্রত্যাশিতভাবে যে ভূমিকাটি পালন করলেন তার জন্যে ইতিহাসে তাঁর নামও লেখা থাকবে। কারণ, এটা স্বীকার করতেই হবে, তিন তালাকের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের সংগ্রাম সাফল্য পেত না যদি নরেন্দ্র মোদী তাদের সংগ্রামের পাশে অকুতোভয়ে দৃঢ়ভাবে না দাঁড়াতেন।
কী কী আছে অর্ডিন্যান্সে তা এক নজরে দেখা যাক। (১) সরাসরি মুখে, চিঠিতে, টেলিফোনে, এসএমএসে, হোয়াটসঅ্যাপে বা অন্যভাবে তিন তালাক প্রদান সম্পূর্ণ বেআইনি। (২) তিন তালাক প্রদান শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ– তিন বছর জেল ও জরিমানা। (৩) তিন তালাক প্রদান জামিন আযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। পুলিশ অভিযুক্তকে জামিন দিতে পারবে না। আদালতের হাতে জামিন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে বিচারকও স্ত্রীর সঙ্গে কথা না বলে তাঁর সম্মতি ব্যতীত জামিন দিতে পারবেন না। এবং দু’পক্ষের কথা শুনে সন্তুষ্ট হলে বিচারক মামলা তুলে নিতেও পারবেন। (৪) তিন তালাকের বিরুদ্ধে স্ত্রী কিংবা তাঁর বাবার বাড়ির যে কেউ থানায় গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারবে। (৫) তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী তার নিজের ও সন্তানসন্ততির জন্য খোরপোষ চাইতে পারবেন। (৬) সন্তান মায়ের কাছে থাকবে।
গত বছর লোকসভায় যে বিলটি পাশ হয় তার উপর কয়েকটি সংশোধনী-সহ এই অর্ডিন্যান্সটি জারি করা হয়। সংশোধনী আনা হয়েছে বিরোধীদের দাবির ভিত্তিতে। বিলে ছিল যে কেউ অভিযোগ জানাতে পারবে। বিলে বিচারকের জামিন দেওয়ার এবং মামলা তুলে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধীদের দাবি মেনে সংশোধনী-সহ রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করে। কিন্তু তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা বিলটি পাশ হতে দেয়নি। তাই সরকারের কাছে অর্ডিন্যান্স জারি করা ছাড়া অন্য বিকল্প ছিল না। মুসলিম নারীদের তালাকের খড়গ থেকে বাঁচাতে এবং তাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে সরকারের পক্ষে এই অর্ডিন্যান্সটি জারি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
কংগ্রেস দল দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তিন তালাককে বেআইনি ও দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধে রূপান্তরিত করে আজ যে গৌরবজনক ইতিহাস তৈরি করলেন সে ইতিহাস তৈরি করার সুযোগ ছিল জওহরলাল নেহরু উত্তর যুগের কংগ্রেস দলের প্রধানমন্ত্রীদের সামনে। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ সে দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে অর্পণ করে যান। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে, সংবিধানে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তর্ভুক্তি একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র, যত দ্রুত সম্ভব এটা বাতিল করে সবার জন্যে একই আইন প্রণয়ন করতে হবে। কংগ্রেস দলের কোনও প্রধানমন্ত্রীকেই সংবিধানের সেই নির্দেশনা কার্যকরী করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরং তাঁরা সচেতনভাবে তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন। পশ্চাদপদ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি বাতিল করার পরিবর্তে তাকে আরও সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছেন।
অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে বিরোধীপক্ষ সমস্বরে হৈ চৈ শুরু করেছে। সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে তাঁরা যেভাবে একই সুরে বিলের বিরোধিতা করেছিল ঠিক সেভাবেই তারস্বরে গলা ফাটাচ্ছে অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধেও। হাজার চেষ্টা করেও মোদীর সরকারকে ভোটে হারাবার ক্ষেত্রে তাঁরা একমত ও জোটবদ্ধ হতে না পারলেও মুসলিম নারীদের বিরুদ্ধে তারা সবাই এককাট্টা। সংসদের ভিতরে ও সংসদের বাইরে, সর্বত্রই, বিরোধীদলগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে কে কত বেশী মুসলিম ধর্মগুরু ও মুসলিম পুরুষদের পদলেহন করতে পারে তারই। এক্ষেত্রে ডান বামে কোনও প্রভেদ নেই। মুসলিম নারীদের অন্যায় তালাকের জুলুম থেকে রক্ষা করা, ওদের একটু নিরাপত্তা দেওয়া এবং ওদের হাতে কিঞ্চিত ক্ষমতা তুলে দেওয়ার যে প্রয়াস করছে বিজেপি সরকার, তাকে বানচাল করতে গোটা বিরোধী পক্ষই ঐক্যবদ্ধভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আধুনিক যুগে মানব সভ্যতার ইতিহাসে নিশ্চিতভাবেই এটা একটা জঘন্য দৃষ্টান্ত ও কুৎসিত অধ্যায়।
তিন তালাক আইনটি মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অংশ। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি যে সম্পূর্ণ নারীবিরোধী ও পুরুষকেন্দ্রিক তা মুসলিম বিশ্বেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। আর তাই তো ২২টি মুসলিম দেশ – যার মধ্যে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশগুলি অন্তর্ভুক্ত – তিন তালাক আইনকে নিষিদ্ধ করেছে। ২২টি মুসলিমদেশেই আদালতের মাধ্যমে তালাক প্রদান বাধ্যতামূলক করেছে এবং স্ত্রীকেও তালাক দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। ঐ দেশগুলি বহুবিবাহকেও নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছে। অথচ ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে তিন তালাক আইন-সহ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি আজও অপরিবর্তিত ও অক্ষত রয়েছে যা বিশ্বের সামনে আমাদের মাথা হেঁট করেছে।
বামপন্থীরা খুব আদর্শ ও নীতির বড়াই করে। বলে যে, নীতি ও আদর্শের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্যেই নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার স্বার্থে নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করতে তারা একবারও দ্বিধা করেনি।
কংগ্রেস দল দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে তিন তালাককে বেআইনি ও দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধে রূপান্তরিত করে আজ যে গৌরবজনক ইতিহাস তৈরি করলেন সে ইতিহাস তৈরি করার সুযোগ ছিল জওহরলাল নেহরু উত্তর যুগের কংগ্রেস দলের প্রধানমন্ত্রীদের সামনে। ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ সে দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে অর্পণ করে যান। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে, সংবিধানে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের অন্তর্ভুক্তি একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র, যত দ্রুত সম্ভব এটা বাতিল করে সবার জন্যে একই আইন প্রণয়ন করতে হবে। কংগ্রেস দলের কোনও প্রধানমন্ত্রীকেই সংবিধানের সেই নির্দেশনা কার্যকরী করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বরং তাঁরা সচেতনভাবে তার বিপরীত পথে হেঁটেছেন। পশ্চাদপদ মুসলিম ব্যক্তিগত আইনটি বাতিল করার পরিবর্তে তাকে আরও সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করেছেন। যেমন দৃষ্টান্ত এক- কংগ্রেসের সবচেয় জনপ্রিয় নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের নির্দেশনার বিপরীত পথে হেঁটে ১৯৭২ সালে তৈরী করে দেন নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ (All India Muslim Personal law Board)। ইন্দিরা গান্ধীর এই পদক্ষেপটি মুসলিম সমাজের বিরাট সর্বনাশ করেছে। এর পেছনে অতিশয় হীন একটা উদ্দেশ্য ছিল। তা হল মুসলিম সমাজকে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে আরও নিবিড়ভাবে যাতে শৃঙ্খলিত করতে পারে তার জন্যে মুসলিম ধর্মগুরুদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। দৃষ্টান্ত দুই– ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন সুপ্রিম কোর্ট শাহবানুর খোরপোষ মামলায় তাঁর পক্ষে রায় দেয়। সে রায়ের মূল কথা ছিল- তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর যদি তার নিজের ও সন্তানের ভরণপোষনের সামর্থ না থাকে তবে তার স্বামীকে তাদের খোরপোষ দিতে হবে। মানবতা ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে এটা ছিল একটি ঐতিহাসিক রায়। মুসলিম ধর্মগুরুরা কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং রায়টি বাতিল করার জন্যে সরকারের কাছে দাবি জানায়। ইন্দিরা গান্ধী নিখিল ভারত মুসলিম ব্যক্তিগত আইন পর্ষদ তৈরি করে মুসলিম ধর্মগুরু ও গোঁড়া মুসলমানদের মাথায় তুলে দিয়েছিলেন, ফলে তারা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বাতিল করার দাবিতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করার ঔদ্ধত্য ও দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিল। রাজীব গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে মোল্লা সমাজের পক্ষে দাঁড়ান। সংসদে বিল এনে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খারিজ করে দেন। রাজীব গান্ধীর এই পদক্ষেপটিও যে মুসলিম সমাজের বিরাট সর্বনাশ করেছে তা বলা বাহুল্য। ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে মুসলিম নারী ও মুসলিম সমাজের এরূপ ভয়ঙ্কর সর্বনাশ করেন একদম বিনা বাধায়। তথাকথিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ কোনও বাম বা ডান দলই বিরোধিতা করেনি। কংগ্রেস এ সব হীন কাজ করেছে মুসলিম ভোট পাবার স্বার্থে। কারণ মুসলিম সমাজে পুরুষরাই নারীর ভোটও নিয়ন্ত্রণ করে। ঐ একই কারণে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও হয় চুপ ছিল না হয় ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে সমর্থন করেছিল। বামপন্থীরা খুব আদর্শ ও নীতির বড়াই করে। বলে যে, নীতি ও আদর্শের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও কিছুর জন্যেই নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করা যায় না। কিন্তু মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ধরে রাখার স্বার্থে নীতি ও আদর্শ ত্যাগ করতে তারা একবারও দ্বিধা করেনি।
কংগ্রেস, অন্যান্য অধিকাংশ পেটি বুর্জোয়া দল ও তামাম বামপন্থী দলগুলি নির্লজ্জভাবে সেই ঐতিহ্য এখনও বহন করে চলেছে। ফলে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার যখন মুসলিম নারীর স্বার্থে তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছে তখন তারা নানা অজুহাতে তুমুল বিরোধিতা করেছে। লোকসভায় বিরোধিতা করেছে, রাজ্যসভায় প্রবল বিরোধিতা করে বিলটি আটকে দিয়েছে, এখন সরকার যখন অর্ডিন্যান্স জারি করেছে তখনও বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওঁদের অজুহাতগুলি ছেঁদো বা বিভ্রান্তিমুলক ছাড়া আর কিছু নয়। ওঁরা কী বলছেন-
- ১) ভোটের স্বার্থে তিন তালাক নিষিদ্ধ করতে চাইছে বিজেপি। তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ তো জনস্বার্থ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি একটি পদক্ষেপ। ভোটের স্বার্থেই বিজেপি যদি এ কাজটি করে সেটা কি দোষের?
- ২) সামনে লোকসভা ভোট তাই বড্ড তাড়াহুড়ো করে অর্ডিন্যান্স এনেছে সরকার। এ অভিযোগটি বিভ্রান্তিকর। কারণ, ক). তিন তালাক নিষিদ্ধ করার বিলে তারা সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছে। তাদের কয়েকটি দাবি মেনে বিলে সংশোধনী আনা সত্ত্বেও তারা দু দু’বারই রাজ্যসভায় সর্বাত্মক বিরোধিতা অব্যাহত রাখে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিলটিকে আটকে দেয়। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, তিন তালাক বেআইনি করতে অর্ডিন্যান্স ছাড়া সরকারের সামনে বিকল্প কিছু ছিল না।
- ৩) সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু তিন তালাক বেআইনি ঘোষণা করেছে তাই তিন তালাক বাতিল করতে আইন প্রণয়ন করায় তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন ছিল না। এটা এক ধরনের ডাহা মিথ্যাচার। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক বেআইনি বলে রায় দিলেও তিন তালাক অব্যাহত রয়েছে এবং তিন তালাকের অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে পুলিশ আইন নেই বলে অভিযোগ নিচ্ছে না। সরকারি হিসেব মতে সুপ্রিম কোর্ট রায়ের (২৯/৮/১৭) পর এ বছর (২০১৮) ১৩ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০১ টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। তালাকের সব ঘটনার খবর সরকারের কাছে থাকে না। সুতরাং কোনও সংশয় নেই যে, তিন তালাকের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশী। এই পরিসংখ্যানটি প্রমাণ করে যে সরকারের বিরুদ্ধে তাড়াহুড়ো করে অর্ডিন্যান্স জারি করার অভিযোগটি করে বিরোধিরা কত বড়ো মিথ্যাচার করছে।
- ৪) তিন তালাক দেওয়ার অপরাধে স্বামীর কারাবাসের বিধিতে আপত্তি তোলা হচ্ছে এই অজুহাতে যে, এটা স্ত্রীর পক্ষেই ক্ষতিকর, কারণ স্বামীর জেল হলে কে খোরপোষ দেবে? এটাও একটা প্রতারণামূলক অজুহাত। কারণ, শরিয়তি তালাক আইনে খোরপোষ দেওয়ার বিধান নেই। সুতরাং স্বামীর জেল না হলে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী খোরপোষ পাবে, জেল হলে পাবে না – এমন কথা বলার অর্থ হলো মুসলিম নারীর সাথে সজ্ঞানে প্রতারণা করা।
- ৫) তিন তালাক বাতিল আইনের বিরুদ্ধে তাদের আর একটি বড় আপত্তি হল এই যে, এই আইনের না কি পুরুষদের বিরুদ্ধে অপব্যবহার হতে পারে। এরূপ অভিযোগ উত্থাপন সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ, তিন তালাক না দিলে কারও বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং এটা একটা হাস্যকর অজুহাত। নির্লজ্জ মানুষদের পক্ষেই এমন অজুহাত খাড়া করা সম্ভব।
তিন তালাক নিয়ে বিজেপি ও বিরোধী দলগুলির মধ্যে যে তীব্র লড়াই চলছে সেই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার ভূমিকা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বিজেপি ও বিরোধীদের মধ্যেকার লড়াইটা আসলে মুসলিম নারী বনাম মোল্লাতন্ত্রের লড়াই। মুসলিম নারী বনাম মুসলিম পুরুষদের লড়াই। এই লড়াইয়ে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি পক্ষ নিয়েছে মুসলিম নারীর। এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য ঘটনা। অবিশ্বাস্য, কারণ, আরএসএস ও বিজেপি হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যে অবিচল এবং তাদের মূল প্রতিপক্ষ হল ইসলাম ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা। তথাপি মোদীজি তিন তালাককে বেআইনি করতে কেন এত তৎপর ও সংকল্পবদ্ধ তা এক বিরাট রহস্য।
আরও পড়ুন: একজন মহিলা যখন হালালা বিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তখন মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা চুপ কেন?
আরও পড়ুন: ‘মেহরাম’ ছাড়াই নারীকে হজযাত্রার অনুমতি প্রদান একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
অপরপক্ষে তথাকথিত সংখ্যালঘু (মুসলিম) দরদি এবং নারীর সমানাধিকার ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা সরাসরি নগ্নভাবে মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করছেন। এটা প্রমাণ করে যে, এ দেশে এ যুগে কোনও রাজনৈতিক দলেরই নীতি ও আদর্শ বলতে কিছু নেই। এই লড়াইয়ে নাগরিক সমাজের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনগণ যাঁরা পান থেকে চুন খসলে, কিংবা কোথাও মানবাধিকারের ঘটনা ঘটলে তার প্রতিবাদে সরকারের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ মুখর হন, তাঁরা চূড়ান্ত রূপে মূক ও বধির সেজে বসে রয়েছেন। তাঁদের এই ভূমিকা শুধু হতাশাব্যঞ্জকই নয়, ভীষণ লজ্জাজনকও। অন্যদিকে মিডিয়ার বৃহৎ অংশ কার্যত অবস্থান নিয়েছে মুসলিম নারীর বিরুদ্ধে। কংগ্রেস, টিএমসি, সিপিআই, সিপিআইএম-সহ তামাম বিরোধী পক্ষ তিন তালাক বিরোধী বিল ও অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার করছে, সেগুলিকেই তারা ব্যাপক মাত্রায় প্রচার করে জনগণকে বিভ্রান্ত ও বিপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছে। প্রধানত বাণিজ্যিক কারণেই যে মিডিয়া এই অন্যায় পক্ষপাত করছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু নাগরিক সমাজ কেন অন্তত বিবেকের তাগিদে মুসলিম নারীর ন্যায় লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াবার সৎসাহস দেখাতে পারছে না তা চরম বিষ্ময়কর ব্যাপার। নাগরিক সমাজের এই কাপুরুষোচিত বধিরতাকে নিন্দা জানাবার ভাষা আমার নেই।