ছোট শহরের গল্প, তথাকথিত তারকা-বিহীন ছবি, কম বাজেটে নির্মাণ, মধ্যবিত্ত জীবনযাপন এসব অনুষঙ্গ যেন হারিয়েই যাচ্ছিল বাণিজ্যিক ছবি থেকে। বিগ বাজেটের ছবিগুলোর সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে কোটি টাকার ক্লাবে প্রবেশটাই যেন সব কিছুর নির্ধারক হয়ে উঠছিল। লার্জার দ্যান লাইফ মার্কা ব্যাপারটাই গিলে খাচ্ছিল আমাদের সবাইকে। বাণিজ্যিক ছবিতে লার্জার দ্যান লাইফ ব্যাপারটা থাকবেই কিন্তু অন্যরকম সুখ-দুঃখের গল্পও সেলুলয়েডে সঠিকভাবে তুলে ধরলে তা মাত দিতে পারে তেমনটাই দেখলাম এ বছরে। ফর্মুলা, থোড় বড়ি খাড়া থেকে বেরনোর সাহস দেখালে শাবাশি তো দিতেই হয়। নতুন নতুন পরিচালকদের ভরসার জায়গা এসব ছবি। তথাকথিত স্টাররাও অন্যপথে হাঁটতে চাইছেন এখন। অক্ষয়কুমার ‘টয়লেট এক প্রেম কথা’, ‘জলি এল. এল. বি’ করে ফেলেছেন, ‘প্যাডম্যান’ আসছে আগামী বছরে।
পরিচালকরাও খান, কাপুর, দেবগন, কুমার এবং পাড়ুকোন, চোপড়াদের কথা ছাড়াও আয়ুস্মান খুরানা, রাজকুমার রাও, ভূমি পেড়নেকর, স্বরা ভাস্কর, তাপসী পান্নু, কলকি কোয়েচলিন, রিচা শর্মা প্রমুখ এবং শক্তিশালী চরিত্রাভিনেতাদের উপর ভরসা রাখছেন। তাই পঙ্কজ ত্রিপাঠি, সীমা পাহওয়া, ব্রিজেন্দ্র কালা, রঘুবীর যাদব, রাজেশ শর্মা, সঞ্জয় মিশ্র প্রমুখরা ইন্টারেস্টিং চরিত্র পাচ্ছেন। পাঠক বলতেই পারেন আগেও এমন ছবি হয়েছে, নতুন কি এই বছরে ঘটে গেল? আমরা জানি অভয় দেওল, ইরফান খানরা তো এমন ছবিতেই বিশ্বাস করে এসছেন সেই শুরু থেকে। বিনয় পাঠক, রণবীর শোরে, রাহুল বোস এমন ছবিগুলিই বাছতেন বা এমন ছবি এদের কাঁধে ভর দিয়েই তৈরী হত। একথা ঠিক যে এই ধরনের ছবিগুলোর জন্য একধরণের ‘নিশ’ দর্শক ছিলই এবং মাল্টিপ্লেক্সের জন্ম এই ছবিগুলোকে বাড়তি মাইলেজ দিয়েছে অতীতে বেশ কয়েক বছর ধরে কিন্তু এবার যেটা অন্যরকম লাগল তা হল- ছবির বিষয়, গল্প বা নির্মাণ। ভালো না লাগলে মানুষ বিরাট বিরাট স্টারওয়ালা ছবিও দেখেনি কিন্তু সেইসব দর্শকরাই এই তারকা-বিহীন ছবিগুলো দেখেছে। তাই হয়তো ‘টিউবলাইট’, ‘মম’, ‘হ্যারি মেট সেজল’, ‘রেঙ্গুন’, ‘সিমরান’, ‘বেগম জান’, ‘বাদশাহো’, ‘ভূমি’, ‘সরকার থ্রি’, ‘রাবতা’, ‘শেফ’ ইত্যাদি ছবিগুলি বক্স অফিসে সেভাবে না চললেও, অন্যরকমের ছবিগুলো যেমন, ‘হিন্দি মিডিয়াম’, ‘লিপ্সটিক আন্ডার মাই বুরখা’, ‘বরেলি কি বরফি’, ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’, ‘নিউটন’, ‘সিক্রেট সুপারস্টার’( এটি আমির খানের ছবি হলেও মুখ্য চরিত্রে তিনি নেই এবং এই ছবি একই দিনে মুক্তিপ্রাপ্ত গোলমাল এগেন-কে বেশ ভালো টক্কর দিয়েছে) ইত্যাদি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ফল করেছে বক্স অফিসে। আরও আশার কথা হল, ২০১৭-তে ইরফান খান (যিনি খানদানি ‘খান ক্ল্যান’ থেকে আলাদা) অভিনীত দুটি হিন্দি ছবির (যেখানে তাঁর নায়িকারা বলিউডে নতুন মুখ) মধ্যে প্রথমটি (‘হিন্দি মিডিয়াম’) হিট আর দ্বিতীয়টি (করিব করিব সিঙ্গল) ভাগ্য পরীক্ষায় সদ্য উত্তীর্ণ। তাছাড়াও এই বছরটিকে যে অভিনেতার ‘সুপার ইয়ার’ বলে বলা হচ্ছে সেই রাজকুমার রাওয়ের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শাদি মে জরুর আনা’ হল তাঁর পঞ্চম ছবি এবং এই পাঁচটি ছবির চারটিতেই তিনি একক নায়ক। সুতরাং এইসব কাঁধগুলোর ওপর এখন ভরসা রাখছেন প্রযোজক, পরিবেশকরা।
আরও পড়ুন: স্থূল ভাঁড়ামো আর অশ্লীল রসিকতার বাইরে বাংলা ছবিতে এখন হাস্যরস কোথায়?
বাংলায় অনেকটা এই একই ট্রেন্ড। অপ্রত্যাশিতভাবে ‘বিবাহ ডায়েরিজ’, ‘মাছের ঝোল’, ‘ধনঞ্জয়’, ‘দুর্গা সহায়’ এবং সবশেষে ‘সহজ পাঠের গল্প’ (এই ছবিটির সাফল্য সত্যি অবাক করেছে, কোনও প্রচার ছিল না, কোনও বড় মুখ নেই ছবিতে, স্রিফ দর্শকদের মৌখিক প্রচারে একটি অসামান্য ছবি তার যোগ্য সম্মান পেয়েছে) মানুষ ভালোবেসেছে, মানুষের মুখে মুখে এ ছবিগুলোর প্রচার হয়েছে। ‘ওপেন টি বায়োসস্কোপ’-এর পর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় আরো একবার নতুন মুখ নিয়ে এসেছেন তাঁর ‘প্রজাপতি বিস্কুট’-এ।
আরও পড়ুন: আমরা কেন ছোটদের জন্য ছবি বানাতে পারছি না?
বেশ কিছুদিন ধরেই রিমেক থেকে মুখ ফিরিয়েছে বাঙালি দর্শক তাই মন্দা বাজারে এ ধরণের ছবিগুলো অন্য ধারার সাফল্যের কথাই বলছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন যে বিগ বাজেটের বাণিজ্যিক ছবি বক্স অফিস সাফল্য না পেলে নাকি ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না তাই ‘চ্যাম্প’, ‘বস’, ‘ককপিট’ এই ছবিগুলো কেমন চলছে তার উপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে। দেব প্রযোজক হওয়ার পর বাণিজ্যিক ছবি প্রযোজনা করছেন, কিন্তু একেবারে মশালা ছবির ফর্মুলা মেনে চলেননি তার অন্যতম কারণ বোধহয় এই ছোট ছোট অন্যরকম ছবিগুলির সাফল্য আর অনেকগুলো বিগ বাজেটের ছবির ব্যর্থতা।
কেউ কেউ মনে করেন দর্শকরা এখন অনেক বেশি পরিণত, তাঁরা মৌলিক কিছু দেখতে চায়। তেলেগু, তামিল ডিভিডির হুবহু অনুকরণে কিংবা একটু উল্টে পাল্টে হিন্দি বা সাউথের হিট ছবির গল্পের বঙ্গানুকরণ আর আমোদিত করে না দর্শককে। পুরনো বোতলে নতুন মদে নতুন করে নেশা হয় না তাদের। আবার অনেকে মনে করছেন যে কম বাজেট, ছোট শহরের গল্পের এই ট্রেন্ড আসলে প্রযোজক বা পরিবেশকদের পরিণত হওয়ার ফলশ্রুতি। তাঁরাই এই ধরণের গল্পের উপর এতদিন ভরসা করতে পারেননি, এখন কর্পোরেট সংস্থাগুলি প্রযোজনায় আসায়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরী হওয়ায় পট পরিবর্তন হয়েছে আর হিট ছবির সংজ্ঞা বদলাচ্ছে।