মিঞা কি মল্লারের বন্দিশ টুকরো হয়ে জানলার শার্সিতে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস আর তুমুল বৃষ্টি একেবারে কাঁটায় কাঁটায় এবার বাঙালি জীবনে। করোনা কেড়ে নিয়েছে বাকি সব রোমান্টিকতা কিন্তু বর্ষার এই দুর্দান্ত আগমন ভাসিয়ে দিয়েছে আমাদের। ঘরে বসে বৃষ্টি দেখা, সঙ্গে গান, কবিতা, মুখরোচক খাবার, বৃষ্টির ছবি, আর প্রেম।  এসব দিন আমাদের কাঙ্খিত। ভারতীয় ছবিতে বৃষ্টির মাহাত্ম্য বিশেষ। বিদেশের মতো এখানে বৃষ্টির রূপ প্যানপেনে নয়। সে ঝাঁপিয়ে আসে, ভাসিয়ে দেয়, মাতিয়ে দেয় এবং সারা বছর সে অমিল। এখন অবশ্য ঘন ঘন তাঁর মুখ দেখা যায়, আগে তেমনটি ছিল না তাই তার বিরাট কদর ছিল।

এ লেখা লিখতে লিখতেই জানু বড়ুয়ার ছবি ‘দি ক্যাটাস্ট্রোফি’-এর একটি দৃশ্য উড়ে এল অন্তর্জাল মারফত! আর সে কী দৃশ্য! রেইন মেশিনের বৃষ্টি নয় একেবারে ঝুপ্পুস বারিষ। বর্ষাকালে যেমন হয় দুকূল ছাপিয়ে! কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝাপসা চারিধার। মাঠ ঘাট প্রান্তর। ভিজে একসা বাড়ির পথে যাওয়া দুই মেয়ে। দাওয়ায় উঠে তারা কাপড় নিংড়ে নেয় আর তাকিয়ে থাকে বৃষ্টির দিকে, যেন আয়না হয়ে যায় চোখ দুটি! এই দৃশ্য কবিতার মতো নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমায়! ছবিটা দেখে ফেলতেই হবে, না হলে মুক্তি নেই। আর তারপরই অপু দুর্গা ভেসে ওঠে চোখের ওপর… সেও ছিল এক ভয়ানক বৃষ্টি… বিরাট কচু পাতার তলায় অপু দুর্গা ভিজছে একসা হয়ে। অঝোর ধারা মুখ চোখ বেয়ে। ভিজে চুপচুপে গোটা নিশ্চিন্দপুর। এরপর জ্বর হবে দুর্গার। এই বৃষ্টির দৃশ্য শুরু হলেই কান্না পায়। গুম গুম করে বুকের ভেতর। আবার মনে পড়ে যায় ‘ছায়াসূর্য’-এর ‘ঘেঁটু’কে। ঘেঁটুর চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুর। আর কী চরিত্র! আহা! কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যায়, সবার চোখে অবহেলিত ঘেঁটু মন দিয়ে ফেলে তাকে। খুঁজে পায় মনের মানুষ, বৃষ্টিময় রাস্তায় সে ভিজতে ভিজতে ভালোবেসে ফেলে নিজেকেও। তার মুখের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা আর নেপথ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে’। অতুলনীয়। বৃষ্টি মানেই তো প্রলেপ। যেমন বৃষ্টির কথায় যে গানগুলো মনে পড়ে যায় তাদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে যায় মান্না দে আর লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘পেয়ার হুয়া একরার হুয়া’। ওই গানের মতো নার্গিসকে এত সুন্দর আর কখনও লাগেনি আমার! একই ছাতার তলায় রাজ কাপুর আর নার্গিস। ছাতা উড়ে যেতেও পারে যেকোনও মুহূর্তে।… ওদিকের ফুটপাথে বর্ষাতি পরে কাপুর পরিবারের তিন খুদে সদস্য হেঁটে যায়… তুলি দিয়ে আঁকা দৃশ্য যেন! ‘ডমডম ডিগা ডিগা ডিগা, মৌসম ভিগা ভিগা’ গানেও বৃষ্টিতে বিগলিত রাজ কাপুর ভেসে গেছেন শ্রাবণে কিন্তু ‘শ্রী ৪২০’ ছবির মতো দৃশ্যায়ন ওখানে ছিল না। আর ‘রিমঝিম গিরে শাওন’ গানে বর্ষার রূপ, রোমান্স, মাদকতা স্বমহিমায়। তুমুল বৃষ্টিতে ভেজা মেরিন ড্রাইভ কেমন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আমাদের জানলায়, অদেখা জুটি অমিতাভ-মৌসুমীর রসায়ন বৃষ্টির মতোই অল্প অল্প করে নেশা ধরায়। সত্তরের দশকের পুরুষের মন তো এই গানেই ‘সুলগ সুলগ’ হয়ে আকুল। অনেকেরই কলার টিউনে যখন তখন মনে বর্ষা নেমে আসে এই গানে। ‘টিপ টিপ বর্ষা পানি’ গানে যেমন রগরগে সেক্সুয়াস নাচ ছিল অক্ষয়-রবীনার তেমনি নব্বই দশকেই অন্য পেলব রোমান্সের পুরনো ঘরানা ছিল ‘রিমঝিম রিমঝিম, রুমঝুম রুমঝম ভিগে ভিগে রুত মে, তুম হাম হাম তুম… চলতে হ্যায় চলতে হ্যায়…’ ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’র মনীষা ঝড় তুললেন যুবাদের হৃদয়ে। লিখতে লিখতেই ভাবছি বৃষ্টির দৃশ্যগুলো কিন্তু আমাদের ছবিতে ভারি আইকনিক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে নীতা যখন বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে সেদিন বৃষ্টি এল মুষলধারে। দাঁড়িয়ে আছে দাদা। মুছে যাচ্ছে কি তার পূর্ববর্তী অধ্যায়! অথবা সূচনা  অন্য পর্বের! ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে বাসন্তী বলে ওঠে,“পুরুষ মানুষ দিয়া কি হইব? তারা বৃষ্টির পানির ফোঁটা, ঝরলেই শেষ, তারা জোয়ারের জল তিলেক মাত্র সুখ দিয়া নদীর বুক শুইষ্যা নেয়”। অভিমানী মন ও শরীর ভিজতে চায়।

আমাদের কাছে বৃষ্টি তো অনুঘটক, বৃষ্টি মানেই সৃজন… কবিতা, গল্পে, সিনেমায় বৃষ্টি নিয়ে আমরা গদগদ।  ‘বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি এ কোন অপরূপ সৃষ্টি’ গাইতে গাইতে ভিজতে থাকেন অপর্ণা সেন। হিন্দি ছবিতে যশ চোপড়ার জামানায় নায়িকার বৃষ্টি ভেজা রূপ মানেই ছবি হিট। আর বৃষ্টিতে ভিজে নায়ক নায়িকার জীবনে ঘটে যেত অঘটন! ওহ! পরিত্যক্ত বাড়িতে সিক্ত নায়ক নায়িকার আশ্রয় নেওয়া ও তারপর ‘ভিগি ভিগি রাতো মে, মিঠি মিঠি বাতো মে, অ্যাইসি বরসাতো মে ক্যায়সা লাগতা হ্যায়’। তখন কি আইটেম নাম্বারের স্থান নিয়েছিল বৃষ্টি! ‘আজ রাপট যায়ে তো হামে না উঠাইয়ো, আজ ফিসল যায়ে তো হামে না উঠাইয়ো’ স্মিতা পাটিলের ওই সাহসী নাচ সেই প্রথম পর্দায়। আমরা রোমাঞ্চিত অমিতাভ আর স্মিতার জুটি্র রসায়ন দেখে। দারুণ মোহময়ী ওই দৃশ্যে স্মিতা অথচ এতটুকু সস্তা মনে হয়নি। আর কে বলবে তিনি ওইরকম দৃশ্যে এর আগে অভিনয় করেননি! আমরা তো তাঁকে ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে দুর্যোগে অভাবে ভোগা ক্লিষ্ট চরিত্রে দেখেছি! আকাশে মেঘ দেখার দৃশ্যে দেখেছি, আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন মুখ তাঁর, ছবির পোস্টার ওটাই ছিল। ‘অন্তহীন’ ছবিতে, ‘যাও পাখি বলো হাওয়া ছলো ছলো’… আহা! বৃষ্টির নরম পেলব সুর, দৃশ্যায়ন, শহুরে রোমান্টিক জীবন প্রেম ভিজিয়ে দেয় আর ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন ঝরো ঝরো ঝরিছে’-এর মতো করে এসে উদ্বেল করে দেয় ইট কাঠের জীবন। কাক ভেজা ভিজে যান মধুবালা, ভিজতে ভিজতে আশ্রয় নেন গ্যারেজে, শিফনের শাড়ি, ভেজা চুল ঝেড়ে নেন অক্লেশে, ‘এক লেড়কি ভিগিভাগি সি’ বলে গেয়ে ওঠেন আপামর কৈশোর পেরিয়ে আসা যুবকের দল। রুখা সুখা হৃদয়ে বৃষ্টি আসে অনেকদিন পর। ‘ঘনন ঘনন ঘির আয়ে বাদরা’ বলে গেয়ে ওঠেন ফুটুফাটা দেশের চাষিভুসি মানুষ যারা মেটাতে পারেনি খাজনা/লগান। বৃষ্টি এলে ফলন, ফলন হলেই মিটবে কিছুটা সমস্যা, বৃষ্টি মানে প্রতীক্ষা আর বৃষ্টি আসার মুহূর্তে তাকে বরণ করতে হয়, বরখা বাহার আসলে এক উৎসব।

‘নমক হালাল’ ছবিতে ‘আজ রাপট যায়ে তো হামে না উঠাইয়ো …’ গানের দৃশ্যে স্মিতা পাটিল ও অমিতাভ বচ্চন।