করোনা পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ৯১ বছর বয়সে জীবনের ট্র্যাকে দৌড় থামাতে হল ভারতের কিংবদন্তী স্প্রিন্টার মিলখা সিংকে। চণ্ডীগড়ের পিজিআইএমইআর হাসপাতালে শুক্রবার (১৮ জুন, ২০২১) রাত সাড়ে ১১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গত মাসের ২০ তারিখে করোনা আক্রান্ত হন মিলখা সিং। তখন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ায় এবং শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ৩০ মে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ি আসার পর আবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়, কমে যায় শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা। ৩ জুন তাঁকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বৃহস্পতিবার রাত থেকে ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নতুন করে জ্বর আসে তাঁর। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা আরও কমে যায়। তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বিকেল থেকেই তাঁর শরীরে করোনা পরবর্তী জটিলতা বাড়তে থাকে। হাসপাতাল থেকে এবারে আর বাড়ি ফেরা হল না তাঁর।
প্রায় তিন সপ্তাহ করোনার সঙ্গে লড়াই করার পরে গত ১৩ জুন তাঁর স্ত্রী নির্মল কৌর (কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনি নিউমোনিয়াতেও ভুগছিলেন) প্রয়াত হন মোহালির এক হাসপাতালে। ১৯৩৮-এর ১০ অক্টোবর তারিখে জন্মানো নির্মল কৌর ভারতের জাতীয় ভলিবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৫৫ সালে ২৬ বছরের মিলখা সিংয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল সপ্তদশী নির্মল কৌরের। এর সাত বছর পরে তারা বিবাহসূত্রে বাঁধা পড়েন। স্ত্রীর প্রয়াণের পাঁচ দিনের মধ্যেই মিলখা সিংও প্রয়াত হলেন। সস্ত্রীক মিলখা সিংয়ের মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল ভারতীয় ক্রীড়া জগতের একটা বিরাট, বর্ণময় অধ্যায় এবং মিলখা-নির্মল জুটির ৫৯ বছরের বিবাহিত জীবন। প্রখ্যাত গলফার জীব মিলখা সিং তাঁর পুত্র। এ ছাড়াও তিনি রেখে গেলেন তিন কন্যাকে।
তাঁর বাবার নাম ছিল সম্পূরণ সিং আর মা’র নাম চাওয়ালি কৌর। ১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের পঞ্জাব প্রদেশের মজফফরপুর জেলার গোবিন্দপুরায় জন্ম হয় মিলখা সিংয়ের। জায়গাটি এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত। ১৩ জন ভাই বোনের মধ্যে মিলখা ছিলেন অষ্টম। তাঁর ১৮ বছর বয়সে, দেশ ভাগের সেই কঠিন সময়ে তিনি নিজের চোখের সামনে দেখেছিলেন বাবা-মাকে জীবন্ত পুড়ে মরতে। সেই সময়েই তাঁর বাবার দেওয়া নির্দেশ “ভাগ, মিলখা ভাগ” অক্ষরে অক্ষরে পালন করে প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে ট্রেনের সিটের নীচে বসে বানভাসি ফিরোজপুর থেকে দিল্লিতে পালিয়ে এসেছিলেন। মিলখা সিং-এর পরবর্তী জীবনের ও দৌড়ের ট্র্যাকের হার না মানা লড়াইয়ের উৎস ছিল ছোটবেলায় চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হওয়া। সেখান থেকেই হয়ত জীবন ও ট্র্যাকে হার না মানা লড়াইয়ের রসদ জোগাড় করেছিলেন “উড়ন্ত শিখ”।
পনেরোটা দিন কেটেছিল দিল্লির রেল স্টেশনে। ঠিকমতো খাবার জুটত না। একটা সময় এমন ছিল, অভাবের তাড়নায় পেট চালাতে মালগাড়ি থেকে কয়লা, চাল চুরি করে বিক্রি করতে হত দিল্লির খোলা বাজারে। নিজের আত্মজীবনী ‘দ্য রেস অব মাই লাইফ’-এ সেই সব দিনের কথা মনে করতে গিয়ে শেষ বেলাতেও চোখ ভিজিয়ে ফেলতেন ‘উড়ন্ত শিখ’। কিংবদন্তী ভারতীয় ক্রীড়াবিদের সেই দুর্দশা চোখে দেখা যেত না। নিয়মিত খাবারও জুটত না। এর পরেও ভাগ্যের ফেরে রাত কাটাতে হয়েছে তিহার জেলের অন্ধকার কারাগারে। দিল্লি থেকে ট্রেনে যাতায়াতের সময়ে স্থানীয় ছাতড়া স্টেশনে বিনা টিকিটে ধরা পড়েছিলেন সেদিনের কিশোর মিলখা সিং। জরিমানার ২৫ টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য ছিল না। জায়গা হয়েছিল দাগি খুনি ডাকাতদের সঙ্গে তিহার জেলে। একটা সময় তো তিনি ভেবেছিলেন যে জীবনটা অন্য খাতে বয়ে যাবে। পরে তাঁর দিদি নিজের গয়না বেচে মিলখা সিং-এর জামিন করিয়েছিলেন।

ভারতের খেলার জগতে কিংবদন্তী হিসেবে পরিচিত মিলখা সিং-এর অবদান নতুন করে বলার কিছু নেই। “ভাগ, মিলখা ভাগ”-এর সেই মন্ত্র আর ছোটবেলার সেই লড়াই এবং হার না মানা মানসিকতা ২৭ বছর বয়সী মিলখা সিংকে পৌঁছে দিয়েছিল ১৯৫৬’র মেলবোর্ন অলিম্পিকে, ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার দৌড়ের ট্র্যাকে। সেবার হিটেই বিদায় নিলেও তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৬০, রোম অলিম্পিকের ফাইনালে ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়েও (প্রথমে হাতে মাপা সময় ছিল ৪৫.৫৯ সেকেন্ড, পরে সবার মতো তাঁর ক্ষেত্রেও ০.১৪ সেকেন্ড যোগ করা হয়) অল্পের জন্য (০.১৩ সেকেন্ড) ব্রোঞ্জপদক হাতছাড়া হয় তাঁর। ১৯৬৪’র টোকিও অলিম্পিকেও ৪X৪০০ মিটার রিলেতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন মিলখা। ১৯৫৮ সালে কার্ডিফে কমনওয়েলথ গেমসে ৪৪০ গজের দৌড়ে সোনা পেয়েছিলেন মিলখা সিং, যেটি ছিল ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ভারতের হয়ে জেতা প্রথম সোনার পদক। ১৯৫৮’র টোকিও এশিয়াডে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড়ে ২টি সোনা জেতা মিলখা সিং ১৯৬২’র জাকার্তা এশিয়াডেও ২টি সোনা জিতেছিলেন ৪০০ মিটার এবং ৪X৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে। তাঁর মোট এশিয়াড সোনার সংখ্যা ছিল ৪। এছাড়া ১৯৫৮’র কটক ন্যাশনাল গেমসে ২০০ মিটার ও ৪০০ মিটার দৌড়ে এবং ১৯৬৪’র কলকাতা ন্যাশনাল গেমসে ৪০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক বিজেতার নামও ছিল মিলখা সিং। রোম অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়ার আফশোস জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেছে মিলখা সিংকে।
৩৯টাকা ৮আনা বেতনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে টেকনিক্যাল কর্মী হিসাবে কাজ করতেন মিলখা সিং। এশিয়ান গেমসে দুরন্ত পারফরমেন্স করার পরে পাকিস্তানের জেনারেল আয়ুব খান মিলখা সিংকে ভারতের “উড়ন্ত শিখ” নামে প্রথম ডাকেন, এটা অনেকেরই অজানা। মিলখা সিং-এর কোনও পদক তাঁর কাছে নেই। ভারতের এই প্রবাদপ্রতিম অ্যাথলিট নিজের সব পদক ভারত সরকারকে দান করেছেন এবং পাতিয়ালার স্পোর্টস মিউজিয়ামে তাঁর সব পদক রাখা আছে। ১৯৫৯ সালে তিনি ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৮’র কার্ডিফ কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের হয়ে প্রথম সোনা জিতেছিলেন মিলখা সিং। তার জন্য ৪৩ বছর পরে ২০০১ সালে তাঁকে অর্জুন পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনিই ছিলেন কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী প্রথম ভারতীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট। তাঁর জন্মস্থান পাকিস্তানই একদিন তাঁকে আলাদা করে দিয়েছিল তাঁর মা–বাবা–দাদা–দিদিদের থেকে। তাই পরে এক দ্বিপাক্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় তিনি যাননি, সুযোগ পেয়েও। বহুবার সওয়াল করেছেন সাফল্য পেতে হলে দেশের খেলাধুলার ভার সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেবার পক্ষে, যা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বারবার।
১৯৬০য়ের রোম অলিম্পিকের ফাইনালে ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড় ৩৮ বছর ধরে ছিল জাতীয় রেকর্ড। ১৯৯৮ সালে ওই রেকর্ড ভেঙ্গেছিলেন পরম মিলখাভক্ত পরমজিত সিং, ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়ে। পক্ষান্তরে ১৯৫৮ সালে কার্ডিফে তিনি যে রেকর্ড গড়েছিলেন, তা ২০১০-এর দিল্লি কমনওয়েলথ গেমস পর্যন্ত অক্ষত ছিল। দিল্লিতে সোনা জিতে মিলখা সিংকে স্পর্শ করেছিলেন ডিসকাস থ্রোয়ার কৃষ্ণা পুনিয়া।
ঘোরপ্যাঁচওয়ালা গলিঘুঁজি না জানা মিলখা সিং অলিম্পিক, এশিয়াড, কমনওয়েলথ গেমসের দৌড়ের ট্র্যাকের মতই তাঁর জীবনের ট্র্যাকেও সরাসরি দৌড়ে গেছেন আজীবন। বাবার উপদেশ “ভাগ মিলখা ভাগ” তাঁকে ছেড়ে যায়নি কোনওদিন। ২০১৩ সালে ওমপ্রকাশ রাকেশ মেহেরার পরিচালনায় ওই “ভাগ মিলখা ভাগ” নামেই মিলখা সিংয়ের জীবন কাহিনী রুপোলি পর্দায় তুলে ধরেছিলেন ফারহান আখতার, মিলখা সিংয়ের অনুমতি নিয়েই। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার, সব ইনগ্রেডিয়েন্ট-সহ অকপটে পর্দায় তুলে আনার অনুমতি দেওয়ায় মিলখাকে সম্মান জানাতে অভিনব উপহার দিয়েছিলেন পরিচালক, ১৯৫৮ সালে ছাপা একটি এক টাকার নোট। ১৯৫৮ সালেই কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছিলেন মিলখা সিং। অন্য বলিউড তারকাদের থেকে মিলখা সিং’কে অনেক বেশি কাছ থেকে দেখেছেন ফারহান আখতার। পর্দায় তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে মিলখা সিং বলেছিলেন, “অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা যেখানেই গিয়েছি, সবাই বলেছেন ফারহান যেন আমার প্রতিচ্ছবি। ছবি তৈরির সময় ওর সঙ্গে দেখা করেছি। ১১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়তে দেখেছি ওকে।”
মিলখা সিং ও তাঁর সাফল্যকে দেখেই তখনও ব্রাত্য অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে এসেছিলেন বহু ভারতীয় ক্রীড়াবিদ। এজন্যই ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে ‘আইকনিক’ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দৌড়ের ব্যাপারে সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে কেউ তা পাননি, এমনটা প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। অ্যাথলেটিক্সে পিছিয়ে থাকা আমাদের দেশে তিনিই প্রথম এনে দিয়েছিলেন কমনওয়েলথ গেমসের আর এশিয়াডের সোনার পদক এবং অলিম্পিকের ফাইনালেও উঠেছিলেন। অল্পের জন্য অলিম্পিক পদক না পেলেও ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সকে তিনি তুলে দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতার শিখরে। সারা বিশ্বে ‘উড়ন্ত শিখ’ নামে খ্যাত তিনি নিজে যা পারেননি, তা দেখতে চেয়েছিলেন কোনও ভারতীয় অ্যাথলেটের গলায়। সেই কবে, ১৯০০ সালে কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছেলে নর্মান প্রিচার্ড দু’টি রুপো জিতেছিলেন অলিম্পিকে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অলিম্পিক অ্যাথলেটিক্সে ভারত পদকহীন, যে পদক একটুর জন্য ওঠেনি মিলখা সিংয়ের গলায়। আর তাই ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে মিলখা সিং বলেছিলেন –
“I failed to win a medal in 1960 Rome Olympics and it hurts me till today. More than half a century has passed since then but no Indian has been able to win an Olympic medal in athletics. It is my last wish to see an Olympic medal around an Indian athletes’ neck on the podium at the Olympic Games.”
নিজের সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থাকতে থাকতেই এক অনন্ত দৌড়ে দিগন্ত পেরিয়ে “উড়ন্ত শিখ” উড়ে গেলেন অন্য ঠিকানায়। ভারতীয় অ্যাথলেটিক্স ও খেলার দুনিয়া এই “সোজাপথে দৌড়ে যাওয়া” আইকনিক দৌড়বীরকে কোনওদিন ভুলবে না। তাঁর মৃত্যুতে ভারত হয়ত হারাল তার সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদকে, বললেও অত্যুক্তি হবে না।