বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সমস্ত প্রক্রিয়ার উপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ জারি এটাই প্রমাণ করে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন নির্লজ্জ মিথ্যাবাদী ছাড়া আর কিছুই নন। মমতা বলছেন, রাজ্যে ৫৮ হাজার বুথে ৯০ হাজার প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, আর এটাই নাকি প্রমাণ করে- নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে চলেছে! কিন্তু ৫৮ হাজার বুথের মধ্যে কতগুলি আসনে তৃণমূল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে, সেটা মুখ্যমন্ত্রী বলছেন না কেন? যদি ৫৮ হাজার বুথের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্দল-সহ বিরোধীরা স্বাভাবিকভাবে প্রার্থী দিতে পারত তাহলে প্রার্থীর সংখ্যা কম করে ২ লক্ষ হওয়া উচিত ছিল। রাজ্যে এতগুলি বিরোধী দল থাকা সত্ত্বেও পঞ্চায়েত বুথ পিছু একজন করেও বিরোধী প্রার্থী নেই! বীরভূম, বাঁকুড়াতে ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদ অবধি দখল করেছে তৃণমূল। এর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন এগুলি স্বাভাবিক! অর্থাৎ এই রাজ্যে ওঁনার দলের বিরুদ্ধে কতজন বিরোধী প্রার্থী দাঁড়াবে, সেটা উনিই ঠিক করে দেবেন। বিরোধীদের আর কোনও সাংবিধানিক অধিকার নেই।

panchayat violence

গত এক সপ্তাহ ধরে রাজ্যের প্রত্যেকটি জেলায় তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব সবাই টিভিতে, কাগজে দেখেছে। হাতে বোমা-বন্দুক-ছোরা নিয়ে, মাথায় হেলমেট পড়ে তৃণমূলি গুন্ডারা বিডিও, এসডিও এমনকি ডিএম অফিস পর্যন্ত ঘিরে রেখে বিরোধী প্রার্থীদের বারে বারে আক্রমণ করেছে, মনোনয়ন পত্র ছিনিয়ে নিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার ভৃত্যের মতন শুধু তাকিয়ে দেখেছে। অনুব্রত মন্ডলের মতন নেতারা “উন্নয়ন” দাঁড়িয়ে আছে, কেউ মনোনয়ন জমা দিতে পারবে না জাতীয় বিবৃতি দিয়ে গেছেন প্রতিদিন। প্রাক্তন সাংসদ-সহ অজস্র বিরোধী নেতারা মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মহিলাদের চুল ধরে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রথমে মেরে, তারপর পুলিশ কেস দিয়ে জেলে পোরা হয়েছে কিছু বিরোধীদের। সাংবাদিক, চিত্র-সাংবাদিকদেরও নিগৃহীত করা হয়েছে এই সব সংবাদ পরিবেশন করার জন্য। আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, এগুলি নাকি সব বিরোধীদের নাটক আর মিডিয়ার কারসাজি! ওনার মতে কেবলমাত্র সাতটি জায়গায় অশান্তি হয়েছে, এবং সেই সব জায়গায় নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরাই মার খেয়েছে, অর্থাৎ মানবাধিকার শুধু শাসকদলের কর্মীদেরই আছে, বিরোধীরা আর মানুষ নয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার জেরে যারা মারা গেছেন তারা কি সবাই তৃণমূল কর্মী?
রাজ্যের নির্বাচন কমিশন একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্রকুমার সিংহ একদিন সন্ধ্যায় মনোনয়ন জমা করার তারিখ বাড়িয়ে পরেরদিনই সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেন। কারণ, তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে শাসিয়ে এসেছে। এগুলি কি মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে ঘটেছে, নাকি তারই ইশারায়? এর পর যখন মমতা বলছেন যে তিনি কেন্দ্রে মোদী-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে চাইছেন, আর বিরোধীরা বিজেপির সাথে জোট করছে, সেটা আরও হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির সাথে জোট করেছেন বারবার। ভবিষ্যতেও যে করবেন না তার নিশ্চয়তা কি? কিছু বুদ্ধিজীবী যখন নন্দীগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন, তখন তাঁরা ওনার চোখে ছিলেন বুদ্ধিজীবী; আর এখন ওই বুদ্ধিজীবীরাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে তৃণমূলের হাতে গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে যখন সরব হচ্ছেন তখন মমতা বলছেন যে ওরা কেউ এসইউসিআই, বা কেউ সিপিআইএম। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে আদর্শের কথা একেবারেই বেমানান।
মমতা কি চাইছেন? তিনি এই মুহূর্তে বিজেপির বিরুদ্ধাচরণ করছেন বলে বাকি বিরোধীদের তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে? প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে তিনি চা খেয়েছেন বলে নিচু তলার সমস্ত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের তৃণমূলের দাসত্ব স্বীকার করে নিতে হবে? ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা মানে কি গণতন্ত্রের পরিবর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বৈরতন্ত্র আর তৃণমূল কংগ্রেসের মাফিয়াতন্ত্রকে মেনে নেওয়া?

panchayat violence

আসলে মমতা নিজেই টের পেয়েছেন যে বাংলার গ্রামগঞ্জের মানুষ তৃণমূলের চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্থ, পেশীবল-অর্থবল সর্বস্ব মাফিয়ারাজকে আর মেনে নিতে চাইছে না। সেই জন্য তৃনমূলের ভিতর থেকেই আজ হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থক পঞ্চায়েতে প্রার্থী হয়েছেন, অনেকেই নির্দল হয়ে। উন্নয়নের নামে যে ধাপ্পাবাজি উনি এতদিন করে এসেছেন তার স্বরূপ এতেই প্রকাশ পায়। গ্রামোন্নয়ন, কন্যাশ্রী, কিষান মান্ডি, কৃষকের আয় বৃদ্ধি এসব যদি সত্যি হতো, তাহলে তৃণমূলের ভিতর থেকে এত বিক্ষুব্ধ প্রার্থী হচ্ছে কেন? আর গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি মমতার শাসনের পক্ষেই থেকে থাকে, তাহলে জেলায় জেলায় সন্ত্রাস নামিয়ে বিরোধীদের দমন করতে হচ্ছে কেন? আসলে যেন তেন প্রকারেণ জনগণের ক্ষোভকে চাপা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই এখন মমতার উদ্দেশ্য।
হাইকোর্ট সোমবার কি রায় দেবে জানা নেই। বিচার ব্যবস্থার উপরেও আজকাল বিশ্বাস রাখা মুশকিল। বিজেপির আমলে জাস্টিস লোয়ার অপমৃত্যু, সুপ্রিম কোর্টের চারজন বিচারপতির বিদ্রোহ, বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাটাকেই টলিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে যেটা হচ্ছে, সেটা বন্ধ হওয়া দরকার। এক সময় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং গ্রামের গরীব, প্রান্তিক জনগণের ক্ষমতায়নে সারা দেশের সামনে পশ্চিমবঙ্গ একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পেরেছিল। বামেদের নিজেদের অধঃপতনের ফলেই অবশ্য সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পরবর্তী কালে গ্রাম সমাজকে ভোটের জন্য নিয়ন্ত্রণ করার যন্ত্রে পরিণত হয়। আর তৃণমূল জমানায় এখন পঞ্চায়েত হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামগঞ্জে মাফিয়া রাজ প্রতিষ্ঠার একটা মাধ্যম। এর সাথে গণতন্ত্রের আর কোনও সম্পর্ক নেই।
এই নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে কোনও নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েত নির্বাচন অসম্ভব। আসলে রাজ্যের নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইনটাই ত্রুটিপূর্ণ, যার ফলে শাসকদল যেমন ইচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে অপব্যবহার করে যেতে পারছে। কেন্দ্রের নির্বাচন কমিশনের কাছাকাছি স্বায়ত্ত ক্ষমতা যতদিন রাজ্যের নির্বাচন কমিশনের না হবে, ততদিন পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে করা মুশকিল। এই বিষয়গুলিতে হাইকোর্ট নজর দিলে ভালো। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন, তাদের সকলেরই এই বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। গণতন্ত্রকে না বাঁচিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকেও রক্ষা করা যাবে না।
এই প্রশ্নে সমস্ত প্রতিবাদী উদ্যোগই সমর্থনযোগ্য। শুধু ৬ ঘণ্টার প্রতীকী বন্‌ধ করে নয়, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে আইনসঙ্গতভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচন করার দাবিতে প্রকৃত গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।