প্রিয় আমাকে ভালবাসা উজাড় করে দেওয়া আর্জেন্টিনার বাঙালি সমর্থকরা,

২০১১’র ২ সেপ্টেম্বর কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে আর্জেন্টিনা বনাম ভেনেজুয়েলা ম্যাচটা আমি আজও ভুলিনি। ভুলিনি সেদিন তোমাদের উজাড় করে দেওয়া ভালবাসায় অতবড় স্টেডিয়াম ভরিয়ে দেওয়া, আমার আর আমার দলের জন্য। ওই ম্যাচটাই ছিল আমার প্রথম বারের জন্য আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হওয়ারও ম্যাচ। তোমাদের সেদিনের ওই ভালবাসা আমি সারাজীবনেও ভুলব না। আমি জানি যে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে, যেকোনও প্রতিযোগিতায় আমি খেলি না কেন, তোমাদের ভালবাসা আমাকে ঘিরে থাকে। আমি এটাও জানি, তোমাদের ভালবেসে “বংজেন্টাইন”ও (বেঙ্গলী আর্জেন্টাইন) বলেন অনেকে।

আমি জানি, তোমাদের মধ্যে অনেকেই আবার আমার ক্লাবেরও (এই মুহূর্তে অবশ্য আমি ফ্রি প্লেয়ার) অন্ধ সমর্থক। তাই এটাও তোমরা জানো যে, এফ সি বার্সিলোনার হয়ে আমি জিতেছি মোট ৩৪টি ট্রফি। তার মধ্যে ছিল ইউসিএল বা উয়েফা চ্যাম্পিয়নশিপ লীগ ৪ বার (২০০৫-০৬, ২০০৮-০৯, ২০১০-১১, ২০১৪-১৫), লা লিগা ১০ বার (২০০৪-০৫,২০০৫-০৬,২০০৮-০৯,২০০৯-১০,২০১০-১১,২০১২-১৩,২০১৪-১৫,২০১৫-১৬,২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯), কোপা দেল রে ৭ বার (২০০৮-০৯,২০১১-১২,২০১৪-১৫,২০১৫-১৬,২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০২০-২১), সুপার কোপা ৭ বার (২০০৬,২০০৯,২০১০,২০১১,২০১৩,২০১৬ ও ২০১৮), উয়েফা সুপারকাপ ৩ বার (২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫) এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ৩ বার (২০০৯, ২০১১ ও ২০১৫)। ৬টি ব্যালন ডিওর (২০০৯, ২০১০, ২০১১, ২০১২, ২০১৫ আর ২০১৯), ৫ বার গোল্ডেন বল (২০০৫, ২০০৯, ২০১১, ২০১৪ আর ২০১৫) আর ৬ বার গোল্ডেন বুটও (২০০৯-১০, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯) আপাতত আমারই দখলে।

আর এটা তো তোমরা জানই যে, আর্জেন্টিনার হয়ে আমার জেতা ট্রফি এখনও অবধি মাত্র ২টি, চিন অলিম্পিকে সোনা (২০০৮) আর অনুর্দ্ধ কুড়ি বিশ্বকাপ (২০০৫)। এই তালিকায় কোনও বিশ্বকাপ নেই, নেই কোনও কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়নশিপও, যদিও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছে ২ বার আর কোপা আমেরিকা জিতেছে ১৪ বার। আর্জেন্টিনা শেষবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছে ১৯৮৬ সালে আর শেষবারের মতো কোপা আমেরিকা জিতেছে ১৯৯৩ সালে। এ নিয়ে অহর্নিশ আমাকে এবং তোমাদেরও ছোট হতে হয় অনেকের কাছে। মাঝে মাঝে সেটা শালীনতারও সীমা অতিক্রম করে যায়, আমি জানি। ঠোঁট আর পেয়ালার দূরত্বে ধরতে পারিনি ২০১৪’র বিশ্বকাপ, এই ব্রাজিলের মাটিতেই। ২০০৭, ২০১৫ আর ২০১৬’র কোপা আমেরিকা ফাইনালও খালি হাতে ফিরিয়েছে আমাকে আর আর্জেন্টিনাকে। তাই ২০২১-এর ব্রাজিল কোপা আমেরিকা (১৯১৬-১৯৬৭ এই টুর্নামেন্টের নাম ছিল সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ আর ১৯৭৫ থেকে এখনও কোপা আমেরিকা নামেই পরিচিত এই টুর্নামেন্ট) এবং ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপ আমার পাখির চোখ বহুদিন ধরেই, জেতার জন্য। 

আমি জানি, ২০২২-এর বিশ্বকাপ এখনও অনেক দূরের পথ, তাই আপাতত মন, প্রাণ, ক্ষমতা, ইচ্ছেশক্তি সব ঢেলে দিয়েছি ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এই ২০২১-এর কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে। ২০২০’তে আর্জেন্টিনা আর কলম্বিয়াতে হওয়ার কথা ছিল এই টুর্নামেন্ট। কোভিডের জন্য ২০২০’র বদলে ২০২১-এ এই টুর্নামেন্ট শুধু আমাদের দেশে হবে বলে ঠিক হয়। আর্জেন্টিনায় কোভিডের প্রকোপ বাড়ায় ৩০ মে তারিখে আবার আয়োজক দেশ বদলায়, এবারে আয়োজক দেশ হয় ব্রাজিল। গ্রুপে ৪ ম্যাচে ৭-২ গোলের গড়ে ১০ পয়েন্ট পেয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা (১-১ বনাম চিলি, ১-০ বনাম উরুগুয়ে, ১-০ বনাম প্যারাগুয়ে এবং ৪-১ বনাম বলিভিয়া)। কোয়ার্টার ফাইনালে আমাদের কাছে ৩-০ গোলে হারে ইকুয়েডর আর সেমিফাইনালে আমরা কলম্বিয়ার সঙ্গে ১-১ ড্র করার পরে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে হারাই ওদের। এবার ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, খেলা হবে ১১ জুলাই ২০২১ তারিখে, মারাকানা স্টেডিয়ামে। এবার জেতার জন্য সর্বস্ব পণ করে মাঠে নেমে ১০০ শতাংশ দিতে হবে আমাদের, জিততে হলে। ৬ ম্যাচে ৪ গোল করে (টাইব্রেকার বাদ দিয়ে) আমি এখনও এই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা।

এ সবই অতীত এখন। যেমন অতীত, আমি প্রথমবারের জন্য কোপা আমেরিকায় খেলেছিলাম ২০০৭ সালে। এই ব্রাজিলই ভেনেজুয়েলায় ২০০৭য়ের ফাইনালে আমাদের ৩-০ গোলে হারিয়ে ট্রফি জিতে নিয়েছিল।খুব কাছে এসেও এই টুর্নামেন্টে খালি হাতে ফেরা আমার, সেই প্রথম, যদিও ২টো গোল করেছিলাম আমি সেবারে। ২০১১তে আমাদের নিজেদের দেশে কোয়ার্টার ফাইনালে উরুগুয়ে টাইব্রেকারে আমাদের হারিয়ে দেয় ১-১ (৫-৪) গোলে, টুর্নামেন্টেও কোনও গোল ছিল না আমার। ২০১৫তে চিলির মাঠে চিলি ফাইনালে টাইব্রেকারে আমাদের হারিয়ে দেয় ০-০ (৪-১) গোলে, যদিও সেমিফাইনালে নির্ধারিত ৯০ মিনিটেই প্যারাগুয়েকে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম ৬-১ গোলে।১টা গোল আর ৩টে অ্যাসিস্ট ছিল আমার সেবার। আর ২০১৬তে আমেরিকায় চিলি আবার ফাইনালে টাইব্রেকারে আমাদের হারিয়ে দেয় ০-০ (৪-২) গোলে, পেনাল্টি মিস হয়েছিল আমারও। অথচ সেবার গ্রুপে ২-১ গোলে  চিলিকে, ৫-০ গোলে পানামাকে, ৩-০ গোলে বলিভিয়াকে হারানোর পরে কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-১ গোলে ভেনেজুয়েলাকে আর  সেমিফাইনালে ৪-০ গোলে আমেরিকাকে হারিয়ে ফাইনালে গিয়েছিলাম আমরা আর মোট ৫টা গোল ছিল আমার। সেসব কেউ মনে রাখেনি, মনে রাখে না।আর ব্রাজিলের মাটিতে আমার খেলা ৫ম কোপা আমেরিকায় সেমিফাইনালে ব্রাজিলের কাছেই হেরে গিয়েছিলাম আমরা, পুরো টুর্নামেন্টে ১ গোল ছিল আমার।

এ সবই অতীত এখন। যেমন অতীত এই টুর্নামেন্ট চলাকালীন আমার দ্বারা ভেঙ্গে যাওয়া অনেক রেকর্ডও। আর্জেন্টিনার হয়ে ১৪৭বার খেলা মাসচেরানোকে টপকে দেশের হয়ে খেলে ফেললাম ১৫০ ম্যাচ, ১১ তারিখে ওটা হয়ে যাবে ১৫১। প্রথম আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় হলাম আমি, যে ৬টা কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্ট খেলে ফেলল, এর আগে ৫টা কোপা আমেরিকা খেলেছিলেন মাসচেরানো। এবারের ৬টা ম্যাচে ৫টা অ্যাসিস্টও শুনলাম নতুন রেকর্ড, এক টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টের। আর ১১ তারিখে ফাইনাল খেললেই কোপাতে দেশের হয়ে ৩৪টা ম্যাচ খেলা হয়ে যাবে আমার, চিলির হয়ে ৩৪টা ম্যাচ খেলা লিভিংস্টোনকে ছোঁয়া হয়ে যাবে সেদিন। ব্রাজিলের জিজিনহো আর আমাদের নরবার্টো মেন্ডেজের ১৭ টা করে গোল আছে এই টুর্নামেন্টে, আর আমি এখনও অবধি কোপাতে করেছি ১৩টা গোল (২০০৭-এ ২ গোল, ২০১৫-তে ১ গোল, ২০১৬-তে ৫ গোল, ২০১৯-এ ১ গোল আর ২০২১-এ এখনও পর্যন্ত ৪ গোল)।

এ সবই অতীত এখন। তিক্ত বর্তমান হল কোপায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক চ্যাম্পিয়নশিপ (১৪) টাইটেলহোল্ডার আমার আর্জেন্টিনা শেষ কোপা জিতেছে ২৮ বছর আগে, ১৯৯৩ সালে। আর আমি এখনও কোনও কোপা জিতিনি। ফুটবল আমাকে সব দিয়েছে, একটা কোপা আর একটা বিশ্বকাপ ছাড়া। এবং এজন্যই আমার নিন্দুকরা প্রতিনিয়ত আঙুল তুলে যান আমার দিকে। আমার দেশেরও অবশ্যই আমার কাছে প্রত্যাশা এই দু’টো টুর্নামেন্ট জেতার। ২০২২-এর বিশ্বকাপেও কঠিনতম লড়াইয়ে আমি থাকব, একটা শেষ চেষ্টার জন্য। কিন্তু ২০২৪-এর পরবর্তী কোপার সময় আমার বয়েস হবে ৩৭। তাই কোপায় হয়ত এটাই আমার শেষ বছর আর শেষ সুযোগ। আপাতত ফুটবলের কাছ থেকে সব পেয়েও কিছু না পাওয়ার প্রধান দু’টো ক্ষতের একটাতে প্রলেপ দেবার এটাই সর্বোত্তম সুযোগ আমার।ফুটবলের থেকে সব পেয়েও কিছু না পাওয়ার ব্যথা ভুলিয়ে দেবার সর্বশেষ চেষ্টা আমরা করব ১১ তারিখে। যে লড়াই এবারে আমার সহযোগীরা করেছে, আর একদিন লড়ে যেতেই হবে তাকে মর্যাদা দেবার জন্য। একটা স্বপ্নপূরণের এই চেষ্টায় সফল আমাদের হতেই হবে এবার।

এবারে আমাদের পারতেই হবে, শেষ নিঃশ্বাস অবধি লড়ে যেতে হবে। আমি জানি, প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের সেরা ফুটবলাররা কেউ আমাদের এক ইঞ্চি জমিও ছেড়ে দেবে না। দেশ এবং বিদেশের সবাই এখন আমাদের জন্য অপেক্ষায়। আমরা সবাই জানি ১১ তারিখে আমাদের জেতার মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে আছে বিশ্বজোড়া আর্জেন্টিনা সমর্থকরা। ওটাই বিশ্বাস। ওটাই ভালবাসা। আর আমরা তো জানিই, এই সেই সময়, যখন দেওয়ালে পিঠ, যখন মাথা নীচু। তখনই, ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়াতে হয়, মাথাটা তুলতে হয়। আগে হয়েছে, এবারও হবে। আমরা এবারেও না পারলে আরও একবার রক্তাক্ত হবে আর্জেন্টিনার শরীর, আমার শরীর, আপনাদের শরীরও। সহযোদ্ধারা সবাই জানে যে, এই অবস্থায় আমি মানে একটা আলতো হাসি, একটা ধারালো বাঁ পা, কিছু লক্ষ্যে স্থির ফ্রিকিক আর একটা বুকভরা স্বপ্ন দেখা। পায়ে ইঞ্জেকশান নিয়েও পাঁচজনকে কাটিয়ে যেতাম আমি অনায়াসে, এবারেও সব চাপ এক একটা ডজে ছিটকে দিতে হবেই আমাকে। আমার জন্য অবশ্য এটাই আদর্শ পরিবেশ। 

সবাই জানে যে, আর্জেন্টিনা মানে চে গুয়েভারার দেশ, যে গৃহযুদ্ধ টপকে, ফকল্যান্ড যুদ্ধ পেরিয়ে এসেছে। সবাই জানে যে, আর্জেন্টিনা মানে দিয়েগো মারাদোনার দেশ, যিনি বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র, যিনি ফুটবল আলোর উজ্জ্বলতায় বিশ্ব ফুটবলকে ধুইয়ে দিয়েছিলেন একটা দীর্ঘ সময় ধরে। এই দুজনের জন্যও ১১ তারিখে হাসিমুখে মাঠ ছাড়তেই হবে আমাদের। জানি কাজটা কঠিন, কিন্তু এবার আমাদের কোপা আমেরিকা কাপটা চাই। আর তাহলেই তোমাদের মুখগুলো ভেসে যাবে হাজার ওয়াটের আলোয়।আশা করি, ১১ তারিখে একটা সুন্দর সকাল বাঙালিদের জন্য উপহার দিতে পারব আমরা। আর সেটাই হবে সাড়ে সাত মাস আগে প্রয়াত বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্রকে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

ইতি – লিওনেল মেসি।

(১০ জুলাই ২০২১)

(সম্পূর্ণ কাল্পনিক)