কয়েকদিন আগে একটি ছোট খবরে চোখ আটকাল, থমকাল বহতা জীবনের চিন্তার স্রোত, বিষণ্ণ হলাম আর তাই তা ভাগ করে নিতে চাইলাম পাঠকের সঙ্গে। কলকাতার এক নামী স্কুলের শিক্ষিকা বাধ্য করেছেন তাঁর কিছু ছাত্রীকে “আমি সমকামী’’(I am a lesbian)- এই কথা লিখতে। তাঁর মতে, ওই ছাত্রীদের ‘শুধরে’ দেওয়ার জন্যই এই ধরনের কড়া শাসন!
স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতার বিশেষ প্রভাব পড়তে পারে একটি শিশুর মানসিক গঠনে, যার রেশ থেকে যেতে পারে তার ভবিষ্যতের সমস্ত সিদ্ধান্তে, কাজে, অভিব্যক্তিতে, যাপিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। কোমল বয়সের অপমানকে গঠনমূলকভাবে জীবন গড়ার কাজে লাগাতে পারে কিছু মানুষ। অন্যেরা বিভ্রান্ত, দুঃখিত হয়ে একটি নেতিবাচক মনোভাবের শিকার হবে, যার কঠিন অভিঘাত তার স্বজন, পরিবার থেকে সমাজ পর্যন্ত বহন করতে বাধ্য হতে পারে।
সিগমাণ্ড ফ্রয়েড যে কটি ভাগে একজন মানুষের ‘psycho-sexual development’- কে ভাগ করেছেন, তা্রই তৃতীয়টি হল ‘phallic stage’। ওনার মতে এই সময়ে একটি শিশু আকৃষ্ট হয় তার থেকে ভিন্ন লিঙ্গের ‘parent’-এর প্রতি। একে বলা হয় ‘Oedipus complex’। কিন্তু এটির সঙ্গেই শিশুটির মনে জেগে ওঠে সমাজ দ্বারা প্রভাবিত পাপবোধ, এই আকর্ষণের কারণে। তখনই তার মধ্যে একটি অবদমন বা repression-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এবং এই দুইয়ের মধ্যে সংঘাতকে সমাহিত করার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই তার জীবনে নিজস্ব যৌনতার বীজ বপিত হয়। ফ্রয়েড-এর মতে, সমকামীতার উৎস এই ‘Oedipus complex’।
স্নায়ু বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে মস্তিষ্কর গঠনের তারতম্য নির্ধারণ করে মানুষের যৌনতার অভিমুখ। মস্তিষ্কর ‘gray matter’-এর পরিমাণ, ডান এবং বাম ‘hemisphere’-এর আয়তন আর স্নায়ুর সংযোগের ওপর নির্ভর করে মানুষ কোন লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ঠিক যেমন আমাদের রোগা, মোটা, ফর্সা, কালো, খর্বকায়, লম্বা হওয়া মস্তিষ্কর বিভিন্ন অংশ দ্বারা নির্ধারিত হয়, তেমনই ‘hippocampus’, ‘amygdala’ আমাদের যৌনতার অভিমুখকে নির্ধারণ করে। তবে বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে পরিবেশগত কারণকেও গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সমকামী বা লেসবিয়ান বলে নারীদের পৃথক করার ব্যাপারটি ঊনবিংশ শতাব্দীর ঘটনা। ইতিহাস বলে, নারী কখনই পুরুষের সমান অধিকার পায়নি সমপ্রেম-এর সম্পর্কে। আর সে যখনই সোচ্চার হয়েছে তার যৌন চাহিদা নিয়ে, মূলত সমকামের ব্যাপারে, তখন অজ্ঞতার জন্যই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ ভাবা হয়েছে। প্রায় দুই শতাব্দী পেরিয়েও যদি স্কুলকে এর জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে বলতেই হবে সামাজিক ব্যাধির শিকড় বেশ গভীরেই থেকে গেছে।
আমাদের সমাজে এখনও অনেক মানুষ যৌন অধিকার সম্পর্কে অবহিত নন। “Sexual rights include the right of all people to decide over their own bodies and sexuality.” এই সহজ অধিকারের থেকে এখনও অনেকটাই দূরে বহু সমাজ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক শাস্তির অধীনে পড়ে। এবং এর শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ একাধিক দশক ধরে।
বয়ঃসন্ধিক্ষণ এমন এক সময়, যখন শরীর, যৌনতা, সম্পর্ক সব কিছু নিয়েই একটা অনুসন্ধিৎসু মন জেগে ওঠে এবং সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাস্থ্যকর মানসিক প্রক্রিয়া। এবং এই সময়ে যে সব সমপ্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার সব কটিই যে সারা জীবন টিকে থাকে, এমন নয়। সেই একই ব্যক্তিরা পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতেই পারে। তাই তেমন কিছু দেখলেই ‘গেল-গেল’ রব তুলে শাস্তি বিধান করা সেই মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর।
বিজ্ঞাপন, social media এখন সব অর্থেই সমাজের শিক্ষক। এক পোশাকের ‘shopping site’-এর বিজ্ঞাপনে সমকামের স্বীকৃতি দেখে ভাল লেগেছিল। এরকম আরও কিছু দেখলে ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়বে আশা করা যায়, না হলে সহজাত প্রবৃত্তিকে অস্বীকার আর ভণ্ডামির মাশুল গুনতে হতে পারে আরও অনেক সতেজ প্রাণকে। তার কোনও প্রয়োজন আছে কি?
Comments are closed.