এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কানপুর ডিএভি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক ছাত্র। ট্রেন লেটের কারণে বিতর্ক সভায় পৌঁছতে দেরি হয়েছে ছাত্রটির। বিচারকরা প্রতিযোগীদের উৎকর্ষতার গণনায় ব্যস্ত, এমন সময় দেরিতে আসা ছাত্রটি অনুরোধ করেন- আমাকে প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই, আমার বক্তব্য আপনারা শুনুন। বিচারক মন্ডলীর মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অন্যতম জনপ্রিয় কবি হরিবংশ রাই বচ্চন। ছেলেটির বক্তব্যে সকলে অভিভূত, তাই প্রথা ভেঙে তাঁকেই প্রথম ঘোষণা করা হল। ছাত্রটি আর কেউ নন, ভারতের ভাবীকালের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।
১৯৫৩ সালের ২০ মে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর কাশ্মীর যাত্রার সঙ্গী তাঁর সচিব অটলবিহারী বাজপেয়ী। জম্মু-কাশ্মীরের উধমপুর দিয়ে কাশ্মীরে প্রবেশের সময় সচিব অটলবিহারী বাজপেয়ীকে তিনি নির্দেশ দেন ‘‘এক দেশ মে দো বিধান দো নিশান নেহি চলেগি’’ এই প্রচারকে ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দিতে। ২৩ জুন, ১৯৫৩ কাশ্মীরে শেখ আবদ্দুলার কারাগারে ডঃ মুখার্জীর ‘মেডিকেল মার্ডারে’র পর কলকাতায় অন্তিম যাত্রায় শিয়রে দেখা গেল অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। একহাতে তুলো দিয়ে অত্যন্ত যত্নে প্রিয় নেতার চোখ মোছাচ্ছেন, আর অন্য হাতে রুমাল দিয়ে নিজের চোখ মুছছেন।
১৯৫৭ সালে জনসংঘের সভাপতি এবং উত্তরপ্রদেশের বলরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। লোকসভার বক্তৃতায় সকলকে চমকে দিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু বিদেশী অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করালেন এই বলে, ‘‘এই ছেলেটি একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে!’’ চার দশক পর ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন ১৩ দিনের জন্য। সেদিন প্রধানমন্ত্রী’র পদ থেকে তাঁর চলে যাওয়া ভারতবাসী মানতে পারেনি।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য প্রথমবার কারাবাস হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর। দ্বিতীয়বার কারাবাস ১৯৭৫ সালে জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে জরুরি অবস্থার আগল ভাঙার আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য। জনসংঘকে জনতা দলে মিশিয়ে দিয়ে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরার পরাজয়কে নিশ্চিত করেন। ১৯৭৭ সালে মোরারজি দেশাই-এর নেতৃত্বে প্রথম অংশগ্রহণকারী সরকারের বিদেশমন্ত্রী হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে তাঁর দেওয়া হিন্দিতে ভাষণ সারা বিশ্বের নজর কাড়ে। ১৯৮০ সালে তাঁরই সভাপতিত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুজনিত প্রবল হাওয়াতে বাজপেয়ী পরাজিত হন। পরাজয়কে ঠাট্টা করে তিনিই বলতে পারেন- ‘‘অ্যাসে অ্যাসে লোগ ক্যায়সে হো গ্যায়ে আউর ক্যায়সে ক্যায়সে লোগ অ্যায়সে হো গায়ে।’’ ১৯৯২ সালে বিতর্কিত ধাঁচা ধ্বংসকে তিনি দুর্ভাগ্যজনক আখ্যা দিতে ভোলেননি। ১৯৯৬ সালের পর ১৯৯৮-এ ১৩ মাসের এক অনৈতিক আস্থা ভোটে পরাজিত হলেন। কিন্তু লোকতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে লোকসভার জবাবী ভাষণ শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। ১৯৯৮ সালে ১১ই মে তিনটি এবং ১৩ই মে দুটি মোট পাঁচটি পরীক্ষামূলক পারমানবিক বিস্ফোরণ করা হয়। পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার ভয় দেখালে বাজপেয়ী স্বভাবচিত ভঙ্গীতে বলেছিলেন, পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করলে খুব বেশি হলে ভারতের অর্ধেক লোক মারা যাবে। কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্রে পাকিস্থান বলে কোনও দেশ পরদিন থেকে থাকবে না।
১৯৯৯ সালে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে তৃতীয়বারের জন্য পূর্ণসময়ের সরকার এল। ২০০২ সালে গোধরা পরবর্তী পর্যায়ে অভিভাবক সুলভভাবে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেকথা সকলের জানা। মোদী বাজপেয়ীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হাম ভি ওহি কর রহে হ্যায়, সাহাব।’’ প্রত্যুত্তরে বাজপেয়ী রাজনৈতিক গুরুর মতো বলেছিলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, নরেন্দ্রভাই সেটাই করবেন।’’ এ এক গুরু-শিষ্য পরম্পরা।

বাজপেয়ীর ইতিবাচক পাকিস্তান নীতি সকলের জানা। বাজপেয়ী বলেন, ‘‘বাধায়ে আতি হ্যায়… কদম মিলাকর চলনা হোগা।’’ কেবলমাত্র বাজপেয়ীজীই অনুকরণীয় ভঙ্গীতে বলতে পারেন, ‘‘অনেকেই জানতে চাইছে, লাহৌর বাসযাত্রা এবং পোখরান-২ এর মধ্যে কী সম্পর্ক? বাজপেয়ীর মতে এটা একই মুদ্রার দুই পিঠ। এক পিঠে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা, অন্যপিঠে বন্ধুত্বের হাত।’’ যেমন ১৯৯৯-এ কারগিলে অনুপ্রবেশকারী পাক সেনাদের মোক্ষম জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি, তেমনি ২০০১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মোশারফের সঙ্গে আগ্রায় ঐতিহাসিক বৈঠক করেছিলেন।
২০০১ সালে লস্কর ই তৈবা ও জৈশ ই মহম্মদ মিলিতভাবে সংসদ আক্রমণ করে। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাজপেয়ীর পাশে থাকার আশ্বাস দেন। বাজপেয়ী বলেন, বিরোধী নেত্রী যখন সরকারের সঙ্গে, তবে বুঝতে হবে ভারতের গণতন্ত্র সুরক্ষিত।
আমেরিকা যখন ইরাক আক্রমণ করে, আমেরিকা চাইছিল ভারত ইরাকে সেনা পাঠাক। বাম নেতারা দেখা করে আপত্তি জানান। বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘‘যাও বাহার যা কে জোরসে বোলো।’’ বাইরে শোরগোল হল, ভারত ইরাকে সেনা পাঠালো না। বাজপেয়ী বলতেন,
‘‘ছোটা মনসে কৈ বড়া নেহি হোতা।
টুটে মনসে কৈ খাঁড়া নেহি হোতা।’’

বাজপেয়ীর রসবোধ তারিফ করার মতো। দিল্লির কোনও অনুষ্ঠানে বাজপেয়ীকে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন করা হয়। বাজপেয়ীজি বলতে উঠেই প্রথমেই বলেন, ‘‘ভূত কাহা সে আয়া।’’ দিল্লি’র দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের বিজেপি’র সদর দফতর থেকে রাষ্ট্রীয় স্মৃতিস্থল পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার পথ অজাতশত্রুর অন্তিম যাত্রায় পায়ে হেঁটে সামিল বাজপেয়ীর উত্তরসূরী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। সেই জনসমুদ্রে সব প্রদেশের সব সম্প্রদায়ের, সব রাষ্ট্র নেতাদের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছেন জনতা জনার্দনের হৃদয়ের সম্রাট অটলবিহারী বাজপেয়ী। মনে পড়ছে তাঁরই কবিতার লাইন-
‘‘ম্যায় জি ভর জিয়া, ম্যায় মন সে মরু,
লওটকর আয়ুঙ্গা, কুছ সে কিউ ডরু?’’
Comments are closed.