২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন শেষের মুখে। প্রায় একমাস ধরে আট দফায় এবারের এই বিধানসভা নির্বাচন সংঘঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনে হাওয়া কোন দিকে বইছে তা নিয়ে আমরা বিতর্ক ডট ইন-এ ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করছি। এবার আমরা আলোচনা করব দুই ২৪ পরগনা ও কলকাতার বিধানসভার আসনগুলি নিয়ে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দফায়, তারপর প্রতি দফাতেই কলকাতা বা কোনও ২৪ পরগনার কোনও না কোনও আসনে ভোটগ্রহণ চলেছে। এবার কমিশন কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাইছে না বলে এবং সংঘঠিত ভোট কারচুপি রোখার লক্ষ্যে দীর্ঘ আট দফায় ভোট করাতে বাধ্য হচ্ছে।

বলা বাহুল্য, কলকাতা আর দুই ২৪ পরগনা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরী হবার পর সেই বছরেই তারা প্রথম লোকসভার নির্বাচনে অংশ নেয়, বিজেপি’র সঙ্গে মিত্রতা করে। জেতে, তখনকার কলকাতার তিনটি (উত্তর পূর্ব , উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ), যাদবপুর ও বারাসাত কেন্দ্রে। হাওড়া ও  শ্রীরামপুরও ছিল তাদের দখলে। বিজেপির তপন শিকদার জেতেন দমদমে। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও এই আসনগুলি তারা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন লড়ে তৃণমূল। এই তিন জেলার (উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতা) ৭৭ টি আসনের ৩৩টি তৃণমূল জেতে, জোট সাথী কংগ্রেস পায় আরও ৩টি আসন- কবিতীর্থ, শিয়ালদহ আর বাদুড়িয়া। বামেদের পতন প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০০১ সালে যারা বামেদের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল ২০০৬ সালে তাদের বামমূখী হবার কথা নয়। তবু বামেরা ২০০৬ সালে ২৩৭ আসন পেয়েছিল, বোঝাই যায় ওই নির্বাচনে শক্তি প্রয়োগ হয়েছিল। মানুষ যদি সত্যিই বামমুখী হত তাহলে ২০১১ সালে তাদের ভরাডুবি হতে হত না। ২০০৬ সালে এই তিন জেলায় বামেরা ৫৪টি আসনের দখল নেয়। এসইউসিআই তাদের চিরকালীন কুলতলি, জয়নগর আসন দুটি দখলে রাখে, কংগ্রেস পায় ৪টি আসন, তৃণমূল জেতে ১৭ টিতে।

২০১১ সালে বিধানসভার আসন বিন্যাসের পর এই তিন জেলার আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৪-এ। বামেরা প্রায় হারিয়ে যায় এই তিন জেলায়, ২০১১ সালের নির্বাচনে তাদের শক্তি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দেয় সাধারণ মানুষ। বামেরা পায় মাত্র ৮টি আসন। সাথী কংগ্রেসের বাদুড়িয়া আসনের সাথে তৃণমূল পায় ৬৬টি আসন। ২০১৬ সালে তারা তাদের অবস্থান আরও মজবুত করে, বামেরা পায় মাত্র ৫টি আসন, কংগ্রেস তিনটি, তৃণমূল পায় ৬৬টি আসন।

২০১৯ সালের নির্বাচনে বাম রক্তক্ষয় আরও ঘনীভূত হবে বুঝতে পেরে বিজেপি তাদের সংগঠন বাড়ানোর দিকে নজর দেয়, জাল ফেলা হয় অন্য দলের প্রভাবশালী নেতাদের দলে টানতে। দলে আসেন মুকুল রায়, অর্জুন সিং’দের মতন  ‘ওজনদার’ নেতারা। ফলও মেলে, বিজেপি উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের মতো আসনটি জেতে, জেলার ৩৩টি বিধানসভার ১৫টিতে তারা এগিয়ে থাকে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি জেতেনি, জেলার ৩১ টি বিধানসভা ক্ষেত্রের কোথাও তারা এগিয়েও ছিল না। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিজেপি’র সংগঠন বাড়ানোর লক্ষ্যে দলে নেওয়া হয় শোভন চট্টোপাধ্যায়কে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, তবে তৃণমূলের বেড়াজাল আর ব্যক্তিগত সমস্যা টপকে উনি বিজেপিকে বিশেষ কিছু দিতে পারেননি। কলকাতার সমস্যা একই, কোনও বড় গোছের নেতা আসেনি। ফলে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্ক তেমন ভাঙেনি। তবে গ্রামে গঞ্জে ধর্মীয় কারণে জনসংখ্যার নতুন বিন্যাসের জেরে ভোটের ধর্মীয় মেরুকরণ হয়েছে। ভোটের ফলাফলে এর প্রভাব কতখানি পড়বে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে দক্ষিণ ২৪-পরগনা এবং কলকাতায় তৃণমূল কিছুটা ভাল অবস্থায় আছে, তা বলা যেতেই পারে।

টেবিল১  : উত্তর ২৪ পরগনায় ২০১১, ২০১৬ আর ২০১৯ নির্বাচনে জয়ী/ এগিয়ে থাকা  দল আর জয় / এগিয়ে থাকার ব্যবধান

টেবিল ২ : দক্ষিণ  ২৪ পরগনায় ২০১১, ২০১৬ আর ২০১৯ নির্বাচনে জয়ী/ এগিয়ে থাকা  দল আর জয় / এগিয়ে থাকার ব্যবধান

টেবিল ৩ : কলকাতায় ২০১১, ২০১৬ আর ২০১৯ নির্বাচনে জয়ী/ এগিয়ে থাকা  দল আর জয় / এগিয়ে থাকার ব্যবধান

বামেদের অবস্থা

কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী দুই ২৪ পরগনায় তৃণমূলের উত্থানে ধীরেধীরে ধরাশায়ী হয় বামেরা। ২০০৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনে এই অঞ্চলে ছিল ৭৭টি আসন, বামেরা ৫৫টি আসন জেতে, তৃণমূল পায় ১৭টি আসন, এসইউসি দুটি, কংগ্রেস ৩টি (গার্ডেনরীচ, কবি তীর্থ আর বউবাজার, যেখানে প্রার্থী ছিলেন সুদীপ বন্দোপাধ্যায়)। ২০১১ সালে বামেরা মাত্র ৮ টি আসন ধরে রাখে। ২০১৬ সালে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচে। ২০১১  সালে কংগ্রেস জিতেছিল কেবল বাদুরিয়া তে, ২০১৬ তে বাদুড়িয়ার সাথে বাগদা আর নোয়াপাড়া আসনে জয়লাভ করে তারা। ২০১৯ সালে বামেদের প্রাপ্তি শূন্য, এই অঞ্চলের কোথাও তারা এগিয়ে ছিল না। ২০১৯ সালে তারা তিরিশ হাজেরের বেশি ভোট পায় মাত্র ৯ টি কেন্দ্রে- বেহালা পূর্ব, বেহালা পশ্চিম, উত্তর দমদমে এবং যাদবপুর লোকসভার ভাঙ্গড়, সোনারপুর উত্তর, সোনারপুর দক্ষিণ, টালিগঞ্জ, বাড়ুইপুর পশ্চিম ‍ও যাদবপুরে। কসবায় ত্রিশ হাজারের সামান্য কম ভোট ছিল। যাদবপুর লোকসভার ওই ছয়টি বিধানসভা কেন্দ্রে তাদের তিরিশ হাজারের বেশি ভোট প্রাপ্তির কারণ, প্রার্থী বিকাশ  ভট্টাচার্যের জনপ্রিয়তা। পশ্চিমবঙ্গের এক একটি বিধানসভায় দেড় থেকে দু’লক্ষ ভোট পড়ে, ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও পঞ্চাশ থেকে ৭০ হাজার ভোট পাওয়া নূন্যতম প্রয়োজন। যাদবপুর ছাড়া কোথাও বামেরা সেই জায়গায় নেই। এবারের এই বিধানসভা নির্বাচনে বামেরা অনেক নতুন মুখ এনেছেন, এরা অনেকই সুশিক্ষিত, রুচিশীল, প্রতিভাবান। তবে বামেদের সেই সংগঠন আর নেই, নতুন করে কেন্দ্র- রাজ্য সংঘাতে গিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে কী দিতে পারবে, তা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই বোধগম্য নয়।

পোস্টাল ব্যালট

ভোটে নিযুক্ত সরকারি কর্মচারী, স্কুল কলেজ শিক্ষকরা ব্যালটে ভোট দেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পরিষ্কার, এতদিন বামেদের সঙ্গে থাকা সরকারি কর্মী বা সরকারি অনুদান প্রাপ্ত সংস্থার কর্মীরা বামেদের সঙ্গেই ছিলেন। তবে সরকার বদলের পর অনেকেই যান তৃণমূলে। টেবিল 8 থেকে বোঝা যাচ্ছে, এরা এখন বিজেপির দিকে আসছেন। দক্ষিণ কলকাতায় পোস্টাল ব্যালটের ভোটে বিজেপি ৯০টি ভোটে তৃণমূলের থেকে পিছিয়ে ছিল। যাদবপুরে সিপিএম ছিল প্রথমে, দ্বিতীয় তৃণমূল। বিজেপি তৃতীয় হলেও তাদের প্রাপ্তি যোগ কম ছিল না। ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপি সরকারি কর্মীদের কেন্দ্রীয় হারে বেতন, ডিএ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যে বিরাট সংখ্যক মানুষ স্কুল, কলেজ, সরকারি বা আধা সরকারি সংস্থায় কর্মরত, তারা এই নির্বাচনে বিজেপির দিকে ঝুঁকবেন বলা যেতেই পারে।

টেবিল ৪ : কলকাতা , দুই ২৪ পরগনার ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ব্যালট ভোট

সংখ্যালঘু ভোট

২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী কলকাতায় সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা ২১.৬৩%। এর মধ্যে খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ মাত্র ০.৮৮%, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও শিখ সম্প্রদায়ের সংখ্যা মাত্র এক লক্ষ। অর্থাৎ ২০-২১% মুসলিম সম্প্রদায় ভুক্ত। কলকাতা বন্দর, মানিকতলা, কাশীপুর, বেলগাছিয়া, এন্টালি, চৌরঙ্গী আসনগুলিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার যে সমস্ত ব্লকে সংখ্যালঘু ২০ শতাংশের বেশি তা নীচের টেবিলে দিয়ে রাখলাম। বাসন্তী, বিষ্ণুপুর ১, ঠাকুরপুকুর, মহেশতলায় কিছু খ্রীষ্টান থাকলেও, অন্যত্র সংখ্যালঘুদের পুরো অংশই মুসলিম সম্প্রদায়ের। ভাঙ্গড় ১ ও ২, ক্যানিং ১ ( ক্যানিং পূর্ব ), মগড়াহাট, জয়নগরে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ট।

উত্তর ২৪ পরগনায়ও অন্যরা নামেমাত্র ,মুসলিমরাই একমাত্র সংখ্যালঘু। বারাসাত ২, দেগঙ্গা, বসিরহাট ১ ও  ২, বাদুড়িয়া, হাড়োয়া, আমডাঙ্গা, হাসনাবাদ, মিনাখাঁয় মুসলিমরা ইতিমধ্যেই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তৃণমূল এখনও মুসলিম প্রধান এলাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয়। আইএসএফ যেখানে মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে , সেখানে তারা তৃণমূলকে যথেষ্ট বেগ দেবে। ধর্ম নিরপেক্ষ হবার চেষ্টায়, আইএসএফ- এর রাজনৈতিক জৌলুস অনেকটাই কমেছে। মুসলিম সত্ত্বা রক্ষার উত্তরাধিকারী হিসাবে মুসলিম জনমানসে তাদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ ছিল। বামেদের ব্রিগেডের জনসভায় মুসলিমরা সে বিশ্বাসে দলে দলে হাজিরও হয়েছিল। কিন্তু বামরা  তাদের সেকুলার বানিয়েই ছাড়ে! এই মুহূর্তে তাই আব্বাসের দল মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের উপর তেমন প্রভাব ফেলবে না। বরং তারা মিমের সঙ্গে জোট বদ্ধ হলে ৩০-৪০ আসন পেতে পারত। এখন পাঁচের বেশি আসন পাওয়া তাদের কাছে স্বপ্নের ব্যাপার।

হিন্দু শরনার্থীদের নিয়েই গড়ে ওঠা কমিউনিষ্টরা কোনও সময়েই মুসলিমদের বেশি ক্ষমতা দেবার পক্ষপাতী ছিল না। পূর্ববঙ্গে মুসলিমদের রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়ায় হিন্দুদের কী অবস্থা হয়েছে, তার খেয়াল তারা রেখেছিল। তাই তারা নিজেদের সুসময়েও মুসলিম বিধায়কের সংখ্যা কখনওই ১০-১২% এর বেশি বাড়ায়নি। কোনও মুসলিম অধ্যুষিত জেলার সম্পাদক পদেও মুসলিম নেতাদের দেখা যায়নি, বড়ো মন্ত্রিত্বও তারা পায়নি। সরকারি চাকুরিতে মুসলিম নিয়োগ তিন চার শতাংশও অতিক্রম করেনি।

তৃণমূল রাজত্বে নেতা, বিধায়ক, বড় মন্ত্রীর পদে মুসলিমরা এসেছেন, বেড়েছে সরকারি ক্ষেত্রে মুসলিমদের কর্মসংস্থানও। নানান জায়গায় শুরু হয়েছে মুসলিম নেতাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। হিন্দুদের জমি সম্পত্তি নিয়ে টানাটানি, ভয় দেখিয়ে সম্পত্তি অধিগ্রহণ, হিন্দু অনুষ্ঠানে বাধা, অন্য অনেক সন্ত্রাসের কথা হিন্দু সংখ্যালঘু গ্রামে গেলেই শুনতে পাওয়া যায়। আর এতেই শুরু হয়েছে, হিন্দু জনতার সংঘবদ্ধ হবার প্রচেষ্টা। তাই দেখা দিচ্ছে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ। ২০২১ সালের নির্বাচনের ফলাফলে হিন্দু ভোটের ব্যাপক মেরুকরণের প্রভাব পড়লে, অবাক হবার কিছু নেই।

টেবিল ৫ : দক্ষিণ ২৪ পরগণায় মুসলিম সংখ্যালঘু

টেবিল ৬ উত্তর ২৪ পরগণায় মুসলিম সংখ্যালঘু