গ্রীষ্মের দাপট এখনও শুরু হয়নি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ চড়চড় করে বাড়ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক উৎসব বলে কথা!

১৭তম লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি আমরা। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে চারটি রাজ্যে (অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুনাচলপ্রদেশ, ওড়িশা ও সিকিম) বিধানসভা নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। এবারের লোকসভা নির্বাচন বেশ কিছু কারণে আগের নির্বাচনগুলির থেকে আলাদা।

প্রথমত, ২০১৪ সালের নয় দফার নির্বাচন কমিয়ে এবার সাত দফা করা হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময়কাল একই রকমভাবে কমানো হয়নি। ২০১৪ সালে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয় ৭ এপ্রিল এবং গণনা হয় ১৬ মে। অর্থাৎ প্রথম দফার ভোটগ্রহণ থেকে গণনার মধ্যে ৪০ দিনের অন্তর ছিল। কিন্তু এবারের নির্বাচনের সময়কাল নয় দফা থেকে কমিয়ে সাত দফা করা হলেও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময়কাল কমানো হয়নি, সাত দফায় এবারের নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হতে লাগবে দীর্ঘ ৪৩দিন (১১এপ্রিল প্রথম দফার ভোট গ্রহণ থেকে ২৩মে গণনা পর্যন্ত)। কেন এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময়কালকে সংক্ষিপ্ত করা গেল না সেটা একধরনের বিস্ময়! প্রায় দেড় মাস সময় ধরে এই ধরনের যে কোনও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে এটা সত্যিই দীর্ঘ সময়।

পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পাঁচ দফা থেকে বাড়িয়ে সাত দফা করা হয়েছে, এটা একটি বড় পরিবর্তন। নির্বাচন কমিশনের পরিষ্কার বক্তব্য, রাজ্যে একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি হওয়ায় তারা এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবনাচিন্তা করেছে। রাজ্যে বিজেপি’র উত্থান এবং স্থানীয় রাজনৈতিক হিংসার প্রবণতা নির্বাচন কমিশনকে যে এ’বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য করেছে সেটা পরিষ্কার।

দ্বিতীয়, এবার ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার দফা পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হল কিছু বড় এবং উত্তেজনাপ্রবণ রাজ্যে সুষ্ঠভাবে নির্বাচন করানো। ২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে ছয় দফায় ভোটগ্রহণ হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গ এবং জম্মু ও কাশ্মীরে হয়েছিল পাঁচ দফায়। এবার উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হবে সাত দফায়। পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীরে হবে পাঁচ দফায়। পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া পাঁচ দফা থেকে বাড়িয়ে সাত দফা করা হয়েছে, এটা একটি বড় পরিবর্তন। নির্বাচন কমিশনের পরিষ্কার বক্তব্য, রাজ্যে একটি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি হওয়ায় তারা এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবনাচিন্তা করেছে। রাজ্যে বিজেপি’র উত্থান এবং স্থানীয় রাজনৈতিক হিংসার প্রবণতা নির্বাচন কমিশনকে যে এ’বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য করেছে সেটা পরিষ্কার।

তৃতীয়, এই প্রথম একটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন চার দফায় সংগঠিত হবে। এই ‘অভাগা’ রাজ্যটি হল ওড়িশা। এর কারণ, এখানে লোকসভা নির্বাচন চার দফায় সংগঠিত হবে। ১১, ১৮, ২৩ এবং ২৯ এপ্রিল এই রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন সংগঠিত হবে। ২০১৪ সালে কোনও একটি রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন করানোর জন্য দু’দফার বেশি পর্যায়ে ভোট করানোর প্রয়োজন পড়েনি।

চতুর্থ, জম্মু ও কাশ্মীরে এই মুহূর্তে বিধানসভা নির্বাচন করানো উচিত ছিল, কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে হচ্ছে না। এটা সত্যিই দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অবাক করেছে। যখন জম্মু ও কাশ্মীরের ছ’টি লোকসভা কেন্দ্রে এবার পাঁচ দফায় নির্বাচন করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তখন একই সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনটিও  সেরে ফেলা হচ্ছে না কেন সেটা বোধগম্ম হচ্ছে না। দুটি নির্বাচন একই সঙ্গে করিয়ে নিলে ফের নতুন করে নির্বাচনী নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হত না। নির্বাচন কমিশনের মূল্যায়ন হল, এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের প্রক্রিয়া অনেক বেশি জটিল, ফলে তার জন্য আরও বেশি সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হত। যেহেতু একই সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যেও নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করতে হচ্ছে তাই এই রাজ্যে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা সম্ভব হবে না। এমনিতেই জম্মু ও কাশ্মীর, তার উপর বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের মনোভাব সম্পূর্ণ আলাদা। স্থানীয় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে বিধানসভা নির্বাচন সংগঠিত হয়, সেখানে লোকসভা নির্বাচন হয় জাতীয় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে, বিশেষত জম্মু এবং লাদাখে। তাই এই দুই নির্বাচন প্রক্রিয়া একসাথে করে পরিস্থিতি জটিল করে না তোলার জন্য কেন্দ্রই হয়ত নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছে। এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

পঞ্চম, এবার নির্বাচনে এত বড় সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করবেন যা অভাবনীয়। এবারে মোট ভোটার সংখ্যা ৯০ কোটি, এর মধ্যে ৮.৪ কোটি নতুন ভোটার, যারা প্রথমবার ভোট দিতে যাবেন। মোট ভোটার সংখ্যা চীন ছাড়া পৃথিবীর যে কোনও দেশের থেকে বেশী। এবং এই ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে নতুন ভোটারদের সংখ্যার থেকে তুরস্কর (৮.২ কোটি) মতো ১৬টি দেশের মোট জনসংখ্যা কম।

ষষ্ঠ, সম্ভবত এই নির্বাচনে রাজনৈতিক জনসভা, সংবাদপত্র এবং সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া। সে কারণেই বোধ হয় নির্বাচন কমিশন ফেসবুক, ট্যুইটার, গুগুল এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির উপর নজরদারি চালাচ্ছে। কমিশনের তরফে ওই সংস্থাগুলিকে চোখ-কান খোলা রাখার জন্য বলা হয়েছে। কোনও দলীয় প্রার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্থ ব্যয় করতে পারবেন না। সম্ভবত এর কারণ, যাতে তাদের নির্বাচনী এলাকার জন্য বরাদ্দ ব্যয়ের সীমা অতিক্রম না করে যায়।

সপ্তম, ভোটিং মেশিন নিয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ উঠেছে, তাই এবার কমিশন প্রতিটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভিভিপ্যাট-এর (voter verifiable paper audit trails) ব্যবস্থা রাখছে। পাশাপাশি ভোটযন্ত্রে দলীয় প্রতীকের পাশে প্রার্থীদেরও ছবি থাকবে। আশা করা যায়, নির্বাচনের পর পরাজিতদের অভিযোগ এবার অনেকটা কমবে।

অষ্টম, এই প্রথম কোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে তা কেবলমাত্র এফিডেভিট করে জানালেই হবে না, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বা কোনও সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে। এটা সত্যিই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। ফলশ্রুতি হিসেবে কয়েক হাজার প্রার্থী বিবৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছেন- ‘‘…, আমি xxx ধারায় অভিযুক্ত’’। অবশ্যই স্থানীয় কোনও সংবাদপত্রে ছোট হরফে যদি এই বিবৃতি প্রকাশিত হয় তাহলে হয়ত তা কারোর চোখে পড়বে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা খুবই বড় একটি পরিবর্তন।

নবম, এবার ‘সিটিজেন রিপোর্টিং’এর সুযোগ রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মোবাইল অ্যাপের (C-Vigil) মাধ্যমে যে কেউ তার এলাকায় ভোটগ্রহণের সময় কোনও অনিয়ম বা গন্ডগোল হলে তার ছবি অথবা ভিডিও তুলে সরাসরি এই অ্যাপের মাধমে পোস্ট করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পোস্ট করার কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের ‘ফ্লাইং স্কোয়াড’ সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কারণ, কেউ ফেক ছবি বা ভিডিও পোস্ট করে ‘ফ্লাইং স্কোয়াড’কে ডেকে এনে ব্যস্ত রাখতে পারে, যাত সেই সুযোগে তারা অন্যত্র অবৈধ কাজকর্ম চালাতে পারে।

সব শেষে, এবার বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকে জাতীয় এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এবার ২০১৪-র থেকে ২০১৯-এর নির্বাচনে মোট ভোটদানের হার বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।