‘‘বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার, আমার দেশ’’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই গানে বঙ্গজননীর যে রূপ চিত্রিত হয়েছ তা আমরা ভুলতে বসেছি। তাই, বাংলার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার নিয়ে ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন দেখতে হবে। এই নির্বাচনে বাংলার একজন ভূমি কন্যা যে ধরনের শব্দ প্রয়োগ করেছেন, তা যেকোনও বাঙালির কাছেই লজ্জার, অস্বস্তির।
একথা ভুললে চলবে না, সাহিত্যে অনবদ্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাননীয়া ডিলিড প্রাপ্তা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সিন্ডিকেট অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পর তাঁকে ডিলিট প্রদান করেছেন! যা পাওয়া যত সহজ বহন করা তত সহজ নয়। তাঁর অঙ্গুলীহিলনে রামধনু রংধনুতে পরিণত হয়। বাংলা সাহিত্যে নবতম সংযোজনের কয়েকটি উদাহরণ না দিলে ভাবীকাল আমাদের ক্ষমা করবে না- ‘‘মোদীর মুখ দেখতে চান না, লুটেরা, দুর্যোধন, দুঃশাসন… (১৯ মার্চ, ২০২১)’’, ‘‘শ্রমিকদের হত্যাকারী, দাঙ্গাবাজ’’ ইত্যাদি (২০ মার্চ, ২০২১), ‘‘প্রধানমন্ত্রী মিথ্যুক, সিন্ধিকেট চালান’’ (২৪ মার্চ, ২০২১), ‘‘তুম শালা খুনি কা রাজা, খুনিকা জমিদার’’(২৫ মার্চ), ‘‘মোদীর স্ক্রু ঢিলে হয়ে গিয়েছে (২৬ মার্চ, ২০২১), ‘‘মোদী সবচেয়ে বড় মিথ্যুক ও বোকা’’ (১৩ এপ্রিল, ২০২১) প্রধানমন্ত্রীকে বলা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষা সন্ত্রাসের কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। বাংলা সাহিত্যের মণিকোঠায় হয়তো বা এই শব্দবন্ধ স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে!
প্রধানমন্ত্রী বাংলাভাষা জানেন না, বাংলা সংস্কৃতি জানেন না, বহিরাগত এই তকমা ব্যবহারের আগে রাজশেখর বসুর বাংলা অভিধানের চর্চা করে নিলে বাংলার মাথা এভাবে নত হত না। একথা বলতে কোনও দ্বিধা নেই এভাষা ‘মোদের গরব মোদের ভাষা–আমরি বাংলাভাষা’ নয়। নির্বাচনী যুদ্ধে পরস্পর পরস্পরকে যুক্তিগ্রাহ্য আক্রমণ করবে এবং প্রশ্নবানে বিদ্ধ করবে সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তা কখনোই সভ্যতা, ভদ্রতা, শালিনতা বিসর্জন দিয়ে হতে পারে না। এই ভাষা সন্ত্রাস ‘শিশু পাঠ্য কাহিনী’তেও মুখ ঢেকে থাকবে। চর্যাপদের পর চৈতন্য পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলার নবজাগরণের মধ্যে দিয়ে এবং বাঙালির চিন্তন ও মননের জগতে আমূল পরিবর্তন এসেছিল। তৎকালীন বাংলার রাজা দেব পাল নালন্দার বিক্রমশীলা প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি জাতির শিক্ষা সংস্কৃতি গৌরবোজ্জ্বল ভিত রচনা করেছিলেন। মেকলে করনিক তৈরি করতে চাইলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের কাজ করেছিল। কলকাতা ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতির রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৮-এ শিক্ষায় প্রথম স্থানাধিকারী রাজ্য আজ সাক্ষরতায় ১৯তম স্থানে। রাজ্যের প্রধানার ভাষণ ও ভাষা আমরা যত শুনছি তত লজ্জিত ও কুন্ঠিত হচ্ছি। রবীন্দ্রনাথের কথা অনুরণন করে বলতে হয় ‘‘রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি’’।
পরিশেষে আবারও বলব এভাষায় বাঙালি কথা বলে না। এভাষা বাংলা ভাষা নয়, এ বাংলার সংস্কৃতি নয়, এ বাংলার গরিমা নয়। অতীশ দীপঙ্কর, চৈতন্য মহাপ্রভু, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ঋষি বঙ্কিম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের পরম্পরা আমাদের নম্র ভদ্র শালিনতার শিক্ষা দিয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীর অধিকার নেই সেই শিক্ষার সংস্কৃতির পরম্পরাকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়। জীবনানন্দ দাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয় আবার আসিব ফিরে ‘‘এই ধান সিড়িটির তীরে হয়তো মানুষ নয়…।’’
Comments are closed.