এপার বাংলায় যখন ইলিশের জন্য হাপিত্যেশ চলছে তখন বাংলাদেশের বাজারে এখন ইলিশের ছড়াছড়ি।

বাংলাদেশের জেলেদের জালে ধরা পড়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই জেলেরা ট্রলার, নৌকো ভোরে ইলিশ নিয়ে ফিরছে। এবারের ইলিশের সাইজগুলোও যথেষ্ট বড়। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশ কয়েক বছর পর এত বড়ো সাইজের ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে।  সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের এক মৎসজীবীকে বলতে শোনা গেছে- দু’রাত সাগরে জাল ফেলতেই বড় বড় ইলিশ। যা দীর্ঘ ২০ বছরের জেলে জীবনে দেখিনি। একেকটা ইলিশ দেড় কেজি থেকে দুই কেজি ওজনের।

ফলে মৎসজীবী, মাছ ব্যবসায়ী এবং সর্বপরি ভোজন রসিক বাঙালির খুশির অন্ত নেই। করোনার সঙ্কটকালে এই ইলিশ যেন বাংলাদেশের মানুষের মনে কিছুটা টাটকা বাতাসের সঞ্চার করেছে।

বাজারে জোগান যথেষ্ট থাকায় দামও কমেছে অনেকটা। ফলে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সকলেই এখন বাজার থেকে থোলে ভোরে ইলিশ নিয়ে ঘরে ফিরছেন। অন্যান্য মাছের জোগান ভাল থাকলেও এসময়ে ক্রেতারা ইলিশ মাছই পছন্দ করছেন। ভাবখানা এমন- এসব মাছ তো অন্যান্য সময়ও খেতে পারব কিন্তু এরকম বড়ো সাইজের ইলিশ এত সস্তায় তো আর সচরাচর পাওয়া যায় না!

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এক কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম ৭০০-৮০০ টাকার (বাংলাদেশের টাকায়) মধ্যে ঘোরা ফেরা করছে।  দেড় কেজি থেকে দু’কেজি ওজনের ইলিশ মাছের দাম দেড়হাজার টাকার (বাংলাদেশের টাকায়) মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। পাঁচশোর বেশী এবং এক কেজির কম ওজনের ইলিশের দাম ৪০০-৫০০ টাকার (বাংলাদেশের টাকায়) মধ্যে রয়েছ। স্থান বিশেষে দামের হয়ত কিছুটা হের ফের হচ্ছে, কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ইলিশের বাজারের সামগ্রিক চিত্রটা এরকমই।

বাংলাদেশে এবছর ইলিশের উৎপাদন এত বেশি কেন?

বিবিসি সূত্রে খবর, ইলিশের দাম এবছর কমে এমন জায়গায় এসেছে যা বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারত না।

গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই টানা ৬৫ দিন বাংলাদেশে ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সে দেশের মৎস্য দফতর। তবে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের জেরে নিষেধাজ্ঞার জারির অনেক আগে থেকেই বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ ধরা।

দীর্ঘ সময় বিরতির পর ২৪ জুলাই থেকে  বাংলাদেশের মৎসজীবীরা ট্রলার ভর্তি করে ইলিশ ধরা শুরু করে। পাশাপাশি এবছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ভাল হওয়ায় নদীতে ভাল স্রোত রয়েছে, ফলে বিপুল পরিমাণে ইলিশ জালে উঠছে। এরকমটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়াও বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ সরকার পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের ইলিশ গবেষক নিয়ামুল নাসের।

পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের আকাল

বর্ষা শেষ হতে এল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাজারে এখনও ইলিশের দেখা নেই। সামান্য যা আছে তা সাইজে ছোট এবং দাম চড়া। বর্ষায় নতুন ইলিশের জোগান এখনও সে ভাবে নেই। ফলত গঙ্গাপারের ইলিশ প্রিয় বাঙালিদের বর্ষায় ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। যা একজন বাঙালির কাছে করোনার যন্ত্রণা থেকে কোনও অংশে কম নয়।

আবহাওয়ার খামখেয়ালি স্বভাবকেই ইলিশের আকালের জন্য মূলত দায়ী করছেন মৎসজীবীরা। বারবার গভীর সমূদ্রে গিয়েও তাদের জালে ধরা পরেনি কাঙ্খিত ইলিশ। তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এবছর বিভিন্ন সময় তাদের সমুদ্র যাত্রা বন্ধ রাখতে হয়েছে। অতি সম্প্রতি দীঘার মোহনায় ট্রলার বোঝাই কিছু ইলিশ মাছ এসেছে, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা যৎসামান্য। ফলে দামও চড়া। মাছের সাইজও ছোট। বেশীর ভাগের ওজন ৫০০-৭০০ গ্রামের মধ্যে। এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ ছিল হাত গোনা।

বাংলাদেশের ইলিশ কূটনীতি

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের তথা ভারতীয়দের ইলিশের প্রতি যে বিশেষ দুর্বলতা আছে এবং তারফলে এদেশে বাংলাদেশের ইলিশের যে বিপুল চাহিদা আছে তা খুব ভালভাবেই জানে বাংলাদেশ সরকার। তাই বিভিন্ন সময় ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ইলিশ। বাংলাদেশের কেউ ভারতের সঙ্গে কোনও গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক আলোচনায় অংশ নিতে এলে ইলিশ উপাহার হিসেবে নিয়ে আসেন তেমনি বিভিন্ন দাবি আদায়ের ক্ষেত্রেও সুক্ষ্ম চালে ইলিশকে ব্যবহার করে থাকে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা শেষবার ভারত সফরে এসে ‘মজার ছলে’ বলেন আপনারা আমাদের তিস্তার জল দিন আমরা ইলিশ দেব।  ২০১২ সালে ভারতে ইলিশ রফতানি করার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার। ২০১৯ সালে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। গতবছর পুজোর সময় বাংলাদেশ ইলিশ পাঠিয়েছিল। বলা হয়েছিল বাংলাদেশের তরফে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য পুজোর উপহার। তবে এবছর এখনও বাংলাদেশের তরফে এপার বাংলায় মাছ রফতানি করা হয়নি। ত্রিপুরায় বাংলাদেশ থেকে কয়েকশো টন ইলিশ এসেছে বলে জানা গিয়েছে।

যেহেতু বাংলাদেশে এবার প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে এবং পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের বিরাট চাহিদা রয়েছে তাই ইলিশের চোরাচালানেরও খবর মিলতে শুরু করেছে।
৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১২৬ কেজি ইলিশ বেআইনি পথে ভারতে ঢোকার মুখে আটক করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। পেট্রাপোল সীমান্তে চেকিংয়ের সময় ধরা পড়ে ইলিশ বোঝাই ট্রাক।

বাংলাদেশ সরকার সূত্রে জানা যাচ্ছে, ভারতে ইলিশ রফতানির জন্য তাদের কাছে বিভিন্ন মহল থেকে আবেদন আসছে। কিন্তু করোনা আবহে এখনও এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

তবে এ কথা বলতেই হয় ইলিশ মাছও দু’দেশের কাঁটা তারের বেড়া জালে আটকে পড়ছে বারংবার। ফলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ইলিশ নিয়ে হাহুতাশ ছাড়া কোনও উপায় নেই অন্তত এই মুহূর্তে।

সব শেষে আশার কথা, কাকদ্বীপ, দীঘার মৎস্য ব্যবসায়ীরা আবহাওয়ার বর্তমান গতি প্রকৃতি দেখে মনে করছেন আগস্ট মাসের শেষেই গভীর সমুদ্র থেকে ট্রলার ভর্তি ইলিশ ঢুকবে।

ফলে এখন ইলিশের আশায় মরছে ভোজন রসিক বাঙালি (পশ্চিমবঙ্গের)!