মানুষ এমনিতেই একা। রোজের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া মানুষ আরওই একা। মানে আমার-আপনার চৌহদ্দির সীমানা পেরিয়ে নক্ষত্র হয়ে যাওয়া মানুষদের যখন নিজের একটা বলয় তৈরি হয়, সেই স্ফটিক স্বচ্ছ বুদবুদ-বলয়ে সে ভীষণ একা। স্তাবক থাকে, ম্যানেজার, সেক্রেটারি থাকে কিন্তু ভালোমন্দের কথা বলতে পারে, অন্ধকার দিনগুলোয় আলোর সন্ধান দিতে পারে এমন বন্ধু থাকে না তাদের। আমাদেরই আজকাল এমন বন্ধু বিরল… সব কিছুতে হ্যাঁ হ্যাঁ বলে যায় সবাই, না বলার, গঠনমূলক সমালোচনা করার লোকজন নেই খুব একটা। তাও যখন তোমার হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া থাকবে যখন তোমার নহবতে সানাই বাজবে, দেউটিতে আতশবাজি উড়বে তখন তোমার পাশে জ্বলজ্বল করবে অনেক মুখ, কিন্তু যখন একে একে নিভিবে দেউটি তখন তোমার পাশে ছায়া ছাড়া তেমন কেউ কি আর রইবে? আর দূরের গ্রহে যারা থাকেন তাদের স্বজনহীনতা যন্ত্রণাদায়ক। রাজা-রাজড়ারা যেমন ছিল সে আমলে…। গল্পে যতই পড়ি যে রাজকুমারের বন্ধু ছিল কোটালকুমার কিন্তু আদপে সমুদ্রগুপ্তের কিংবা শাহাজাহানের বন্ধুর কথা কি কেউ জানে? পারিষদ, জো হুঁজুর বলা আর ওই হ্যাঁ হ্যাঁ-বলা সং ছিল অনেক কিন্তু আসল স্যাঙাত কজন ছিল?
তখনকার যেমন রাজা, রাণি, মন্ত্রী, সেনাপতি… এখনকার তেমন সেলিব্রিটিরা। তুলনাটা করতে ইচ্ছে হল কারণ পর্দার তারকারদের মহিমা (পোলিও নির্মুল করাতেই হোক আর ভোট দেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতেই হোক তারকার মুখ লাগবেই এ দেশের সব প্রচারে, সব রকমের অনুষ্ঠানে) এ উপমহাদেশে অপরিসীম। সবার আলাদা আলাদা সাম্রাজ্য আছে, বলয় আছে, গোষ্ঠী আছে। উত্থান আছে, পতন আছে আর আছে অবসর… কিন্তু স্থায়ী বন্ধু নেই। অমিতাভ বচ্চন এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন তাঁর কোনও বন্ধু নেই। শত্রু অনেক আছে। কাজ থাকলে তিনি ভালো থাকেন আর কাজের মধ্যে থাকতে পারাটাই তাঁর কাছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এমন এক পেশা যেখানে অর্থ, যশ, অপযশ, পুরস্কার, প্রতিপত্তি সব থাকে কিন্তু পর্দায় যতই আদর্শ বন্ধুর জন্য ‘ইয়ে দোস্তি হম নেহি তোড়েঙ্গে’ গান গাওয়া হোক না কেন আসল জীবনে এই গানের সারমর্ম উপলব্ধি করার দোসর তারকারা পান না। তাই তাঁরা একা। কখনও কিছু লোক বন্ধু হয় তারপর অসময়ে তাঁদের চেনা যায়।
পেশার অসম্ভব চাপ, মারাত্মক প্রতিযোগিতা, নিরাপত্তাহীনতা, উচ্চাকাঙ্খা, অবসাদ সব মিলিয়ে মিশিয়ে দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নামই সেলিব্রিটি যাপন। এ সব কিছুই তাদের সেলিব্রেট করতে হয়। পেশাগত বৈষম্য, সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় সোফায় বসেও হতে পারে সম্ভ্রমহানি, আরও নানা দাবি-দাওয়া মেনে শুরু করা জীবনটায় যতই সুখের, সেলিব্রেশনের, শাটারের ঝলকানি থাক না কেন চরম অসহায়তাও আছে। শ্রীদেবীর জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা ছিল না কিন্তু জানার পর সত্যি কষ্ট হল খুব। শৈশব-হীন, স্কুল-কলেজ হীন, বন্ধু-বান্ধবহীন জীবন, যেন এক ‘টাকা তৈরির যন্ত্র’, মায়ের অসম্ভব কঠোর মনোভাব, বোনের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা, বিবাহিত অভিনেতার সঙ্গে স্বীকৃতি না-পাওয়া প্রেম, স্বামীর প্রথম বিয়ে ভাঙার অপবাদ কত কিছুর বিনিময়ে পাওয়া এই স্টারডমের এমন করুণ পরিণতি…। এগুলো তো জানা তথ্য, কত অজানা বেদনাক্লিষ্ট তথ্য হয়তো আঁচলচাপাই রয়ে গেল আজীবনের মতো। এই যে দিব্যা ভারতী মদ খেয়ে জানলা থেকে পড়ে মারা গেলেন- এত কী সহজ হতে পারে তারকাদের মরণ? তারপর পরভিন ববি, মীনা কুমারী, মেরলিন মনরো, মাইকেল জ্যাকসন, রবিন উইলিয়ামসদের কী মর্মান্তিক পরিণতি! “যত দূরে দূরে যাবে বন্ধু, একই যন্ত্রণা পাবে”… কবীর সুমনের গানটা সত্যি হয়ে ওঠে।
গত কয়েক বছর ধরেই কাগজের শিরোনামে উঠে আসছে এমন ঘটনা! সিরিয়ালের অভিনেত্রীরা এই কলকাতাতেই নিয়মিত কাজ না পেয়ে নিরাপত্তাহীনতা, হতাশায়, অবসাদে ভুগে শেষ করে দিচ্ছেন নিজেদের! নিজের কষ্ট, অপারাগতা বলতে পারার মতো কাছের কেউ নেই তাদের। নিজেদের ক্ষণস্থায়ী গ্ল্যামারের আলোকবর্তিকায় অন্ধ হয়ে চরম বিশৃঙ্খল দিন-যাপনও ডেকে আনছে মরণ। সাধারণ মানুষ তো মরছে যখন-তখন, সেসব কেই বা মনে রাখে? কিন্তু আমরা এই সাধারণ মানুষরাই তো দূরের তারাকে খুব কাছের ভেবে নিই আর তাদের খসে পড়াতে কষ্ট পাই। আর এই কষ্টটুকু আর ওই উন্মাদনাটুকুই তারকাদের পুঁজি। ‘নায়ক’ ছবিটায় অরিন্দমের গল্পটাই বেশিরভাগ তারকার জীবনের মর্মকথা- তাঁরা ভক্তদের ভালোবাসা ছুঁতে পারেন না- বড় গেট, তারের বেড়া, গাড়ির কাঁচের ওপারেই তা থমকে থাকে খুব সত্যি হয়ে অথচ সেই বেড়া বা আগল ভাঙার কোনও উপায় নেই। রাজার প্রতি প্রজার আনুগত্য এবং ভালোবাসা যেমন পথের দুপাশে, সিংহ দরজার বাইরেই এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে, এ তেমনই ভালোবাসা। তবু এছাড়া বোধহয় তারকাদের আর কিছু আপন থাকে না। একাকিত্ব, হলুদ হয়ে যাওয়া ছবি, ছেড়ে দেওয়া সিংহাসন- সব কিছুর ধুলো পেরিয়ে এই ভক্তি, ভালোবাসা নিয়েই কাটে ওঁদের বাকি জীবনটা আলো-অন্ধকারের ছায়ায়, সম্পর্কহীনতায়, স্মৃতিমেদুরতায়।