বিশ্বকাপ বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের দুর্গাপুজো হলে ইউরো কাপ কালীপুজো আর কোপা আমেরিকা জগদ্ধাত্রীপুজো। ১১ জুন ২০২১। একটু পরেই রোমে শুরু হবে করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া ইউরো ২০২০। রোমের “অলিম্পিক স্টেডিয়াম” আজ শুরু করবে ইউরোর বোধন।ইটালি বনাম তুরস্ক ম্যাচ দিয়ে।করোনার ভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আজ এখানে রাজার মতো ফিরছে ফুটবল, দর্শকসমেত।আজ থেকে তাই রাত জাগা কালীপুজো আমাদের।
এখনই পৃথিবীর যাবতীয় ভিড় উপচে পড়ছে ঐ স্টেডিয়াম অঞ্চলে। যে জন্য ফোরো ইটালীয়া স্পোর্টস কমপ্লেক্সের (যার মধ্যে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে অলিম্পিক স্টেডিয়াম) স্টেডিয়াম প্রান্তে মেন গেটের বাইরে পৌঁছতে হলে আজ গাড়ি বাইরে রেখে বেশ খানিকটা, প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হচ্ছে।নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি রেখে অনেকটা যুবভারতীর Rampয়ের মতো খাড়াই রাস্তা ধরে অনেকে উপরে মেন গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তারই মাঝে রাস্তাটায় ওঠার মুখে একপাশে হুইলচেয়ারে বসা ইটালি’র নীল রঙের জার্সি পরা এক আধাপ্রৌঢ়। উদাস চোখদুটো যেন দেখছেন কিছুটা দূরের অলিম্পিক স্টেডিয়ামকে। হাতে একটা ডায়েরী। কলম দিয়ে দু-চারটে আঁচড় কাটছেন মাঝে মাঝে।খেলা শুরু অবধি এটা চলবে। মোটামুটিভাবে খেলা শেষ হবার সময়ের কাছাকাছি তিনি হুইলচেয়ারে বসে ভিড়ের উল্টো দিকে মিলিয়ে যাবেন। এবং তার ঠিক পরেই আর সেখানে ইতস্তত ঘুরতে থাকা এক যুবক পথচারী সেই আধাপ্রৌঢ়র ফেলে যাওয়া সদ্যলেখা ডায়েরীটি খুলে পড়ে ফেলবেন। হুবহু এই রকম লেখা থাকবে সেই অখ্যাত ইটালীয়ানের ডায়েরীতে-
এক অখ্যাত ইটালীয়ানের ডায়েরী / ১১ জুন ২০২১

তিন বছর আগে আমার ৫৯ বছরের জীবনে প্রথম ঘটেছিল এটা। আমার দেশ বিশ্বকাপের মূল পর্বের বাইরে চলে গিয়েছিল। আমার জন্মের (১১ জুন ১৯৫৯) একবছর আগে ১৯৫৮’র বিশ্বকাপে এটা শেষ ঘটেছিল, বাবার মুখে শোনা। মাঝে চলে গিয়েছিল ১৪টা বিশ্বকাপের মহোৎসব। তারপর ১৯৮২। ইতালির তৃতীয় বিশ্বকাপ জেতা। ২৩ বছর যখন আমার, ১৯৮২’র জুলাই, কি আনন্দ যে করেছিলাম আমার জীবনে প্রথম আমার দেশ বিশ্বকাপ জেতার পরে, এখনও স্পষ্ট মনে আছে। রাতভর রাস্তায় উদ্দাম নাচানাচি, বয়স নির্বিশেষে। বাবাও সঙ্গে ছিলেন সেদিন। ভোররাতে অনবরত বাজির শব্দে মহল্লার ঘুম ভাঙ্গানো। টানা সাতদিন চলেছিল উল্লাসপর্ব। বিশ্বকাপ বলে কথা! পাওলো রোসি, টারডেলি আর আলটোবেলি ফাইনালে দ্বিতীয়ার্ধে ৩ গোল দেবার পরে পশ্চিম জার্মানীর (তখনও বিভক্ত) পল ব্রাইটনার ১গোল শোধ করেছিলেন সেবার। বাবার জীবনে ওটাই শেষ বিশ্বকাপে জেতা। ২০০৫-এ মারা যাবার আগে আরও ৫টা বিশ্বকাপে মূল পর্বে খেলছিল ইতালি। কিন্তু আর জেতেনি। স্কিলাচি, বারেসি, মালদিনি, দিনো আর রবার্তো বাজ্জিও, দোনাদোনি আর ভিয়ালি, যাবতীয় মহাতারকার বিভিন্ন সময়ের চেষ্টাতেও, ইতালী আর জেতেনি, বাবার জীবদ্দশায়। জীবনের মতোই জাদুকর ফুটবল, তার খেলা দেখায় পরের বছর, ২০০৬ এ।
আবার বিশ্বকাপ জেতে ইটালি। দেখে যেতে পারেননি আমার বাবা। আমাকে ফুটবলের অমৃত পান করানো বাবা। যার ইচ্ছে ছিল, তার মতোই আমিও ফুটবলার হই। কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হওয়ার জন্য জন্মায় না।
ছোট বয়সে বড় চোট তার ফুটবল জীবনকে লম্বা হতে দেয়নি। আর আমার হয়নি অনিচ্ছে আর অলসতায়, শেষ পর্যন্ত পায়ের পঙ্গুতায়, স্থান মেলে হুইলচেয়ারে। কিন্তু সৎ ফুটবলের মজা আমার মজ্জায় ঢুকিয়ে দেন বাবা। তাই ২০০৬-এ মাতেরাজ্জি-জিদান এপিসোডের অস্ত্রে আমার জীবনে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ জেতায় সেই আনন্দ পাইনি, যা পেয়েছিলাম তার ২৪ বছর আগে। সেই ২০০৬-এ বুঁফো প্রথম খেলেন বিশ্বকাপে।সেই বুঁফো, আমার প্রিয়তম ফুটবলার বুঁফো ২০১৮তে চোখের জলে বিদায় জানালেন ফুটবলকে, মূলত ইটালি বিশ্বকাপের মূল পর্বের বাইরে চলে যাওয়ায়। ৫৯ বছরের জীবনে সেই প্রথম বিশ্বকাপের মূল পর্বের বাইরে ছিলাম আমিও। একটা খেলাও দেখিনি, এমনকি টিভিতেও না। যদিও তখন চিকিৎসার জন্য মস্কো রেড স্কোয়ারের কাছেই একটা হোটেলে উঠেছিলাম ফুটবলপ্রেমী সহধর্মিণীকে নিয়ে। চোখের সামনে ৩২টা দল বিশ্বকাপের জন্য লড়ে গিয়েছিল আর ৪ বার বিশ্বকাপ জেতা আমার দেশ ইটালি সেই ৩২টা দলের মধ্যে অনুপস্থিত, সেটা দেখার আর ফলো করার মতো মনের দৃঢ়তা আমার ছিল না। এজন্য আমি দুঃখিত। বুক ফেটেছিল, মাথা ছিঁড়ে পড়ছিল, হাত আর পায়ের কাঁপা আঙুলগুলো আরও কাঁপছিল। সেবার জুন-জুলাইতে হুইলচেয়ারটা চলেইনি প্রায়। সেদিন মনে মনে ভেবেছিলাম, আবার হয়ত বিশ্বকাপের মূল পর্বে ফিরে আসব কাতারে ২০২২-এ, ইটালির সঙ্গে। বাঁচতে আমাকে হবেই ততদিন। ফুটবলের কসম। বিশ্বকাপের কসম।
আজ ১১ জুন ২০২১ আমার ৬৩তম জন্মদিন। ৬২ পেরিয়ে আজ আবার ইটালীয় টিমকে নিঃশব্দে শক্তি জোগাতে মাঠের বাইরে আমি।এখন এতটাই শোচনীয় অবস্থা আমার হাত আর পায়ের কাঁপা আঙুলগুলোর যে হুইলচেয়ারের বাইরে কিছু ভাবতে পারি না।মাঠে ঢুকে খেলা টেলা দেখা তো অনেক দূরের কথা।ফুটবল খেলাই তো পরোক্ষে হুইলচেয়ার ধরিয়েছিল আমাকে। কলেজে তখন, ইন্টার কলেজ টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচ খেলে ফেরার সময়ে আমাদের বাসটাকে ধাক্কা মারে একটা মিনি ট্রাক।জ্ঞান ফিরেছিল একদিন পরে।হাত আর পায়ের আঙুলগুলোর কাঁপা শুরু হয় সেদিন থেকেই।বাবার পারিবারিক বড় ব্যবসার জন্য খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে অসুবিধে হয় না নিঃসন্তান আমার আর আমার স্ত্রীর। তবে ফুটবলের খবর রাখার বদভ্যাসটা আজও ছাড়তে পারিনি আমরা দু’জন।সেই অভ্যাসেই জানি, গ্রুপ এ-তে আমাদের সঙ্গে আছে সেনল গুনেসের কোচিংয়ে বাইন্ডির, সেলিক, ওজান কাবাব, কারামানের খেলা আর হাকান কালহানোগলুর ফ্রিকিক সমৃদ্ধ তুরস্ক ছাড়াও এমবোগো, বেনিটো, এমবোলোর সুইজারল্যান্ড আর ডেভিড, আমপাডু, বুকসের ওয়েলস। কঠিন গ্রুপে আছে কুয়ের্তোজ, বোয়াটা, কেভিন ডি ব্রুইনি, লুকাকুর বেলজিয়াম, জোনাস, অ্যান্ডারসম, ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের ডেনমার্ক আর ডুপিন, ফোমিন, বারিনভও ইয়োনোভের রাশিয়া (গ্রুপ বি)।
অপেক্ষাকৃত সহজ গ্রুপ সি-তে আছে ক্রুল, ব্লাইন্ড, দুই ডে জংয়ের নেদারল্যান্ডস আর আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর কোচিংয়ে ব্রুশ্চান, জিনচেঙ্কো, মাকারেঙ্কোর ইউক্রেন। গ্রুপ ডি-তে হেন্ডারসন, ম্যাগুইরে, হ্যারি কেন, মার্কাস, স্টার্লিংয়ের ইংল্যান্ড আর বারিসিক, লুকা মাদ্রিচ, পেরিসিকের ক্রোয়েশিয়াকে লড়তে হবে মূল লড়াই। এনরিকের কোচিংয়ে দে গিয়া, আলবা, বুস্কেতস, রুইজ, মোরাতা, পেড্রিজের স্পেন আর সেবাস্তিয়ান লার্সন, জনসন, হেলেন্ডার, মার্কাস বেগের সুইডেন এবং বেডনারেক, ক্লিচ, লিয়নডেস্কি, মিলিকের পোল্যান্ড লড়ে যাবে গ্রুপ ই-তে। আর গ্রুপ এফ এবার “গ্রুপ অফ ডেথ”, যাতে ১) ম্যানুয়েল, গোসেনস, টনি ক্রুজ, মুলার, ভোল্যান্ডের জার্মানী, ২) লরিস, হার্ণান্ডেজ, কন্তে, দেমবেলে, বেনজিমা, এমবাপের ফ্রান্স, ৩) প্যাট্রিসিও, রোনাল্ডো, ব্রুনো, ক্যানসেলোর পর্তুগাল আর ৪) বোগডান, ফিওলা, জেরি, হল্যান্ডারের হাঙ্গেরীর মধ্যে তুল্যমূল্য লড়াই দেখবে ফুটবলপ্রেমীরা। সবশেষে আমার ইটালি টিমের কথা। তুরস্ককে আজ সমঝে চলতে হবে ইটালিকে।কোচ মানচিনির উপর অগাধ আস্থা আমাদের।এবারে এই শতাব্দীর নবতম ফুটবল রেনেসাঁ-র স্বপ্ন দেখছি আমরা তাকে নিয়ে। গোলপ্রহরী দোনারুমা, ডিফেন্ডার বোনুচি, চিয়েলিন, মিডফিল্ডার লোকাটেলি, পেলিগ্রিনি আর ফরোয়ার্ড ইম্মোবিলে, ইনসিগ্নের সোনালী পারফরমেন্সে ভর দিয়ে মানচিনির ইটালি ভালো কিছু করবে, এই আশায় বুক বাঁধছি, কারণ ২০১৮র পর থেকে টানা ২৭ ম্যাচ অপরাজিত আছে ২০১৮’তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়া ফুটবল মহাকাব্যর আজুরি টিমটা। ২০২০’তে ইটালিতে বীভৎস মৃত্যুমিছিলের স্পনসর করোনাকে দশ গোল দিয়ে ইউরোপের বৃহত্তম টুর্নামেন্টে সগৌরবে ফিরছে ফুটবল, এটাই শেষ কথা। ইটালি, জার্মানী, স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা অন্য কোনও দেশ, শেষ পর্যন্ত ইউরো ২০২০ যেই জিতুক না কেন, এই টুর্নামেন্টে আসলে চ্যাম্পিয়ন হবে ফুটবল আর ফুটবলের প্রতি মানুষের ভালবাসা। ইউরোপের ১১টা মাঠেই আগামী ১১ জুলাই অবধি এক মাস আটকে থাকবে বিশ্বের কয়েকশো কোটি জোড়া চোখ। আমি তো শুনেছি, ইউরোপের যেকোনও দেশের থেকেও এই টুর্নামেন্টের ভিউয়ারশিপ সবচেয়ে বেশি হয় এশিয়ার একটা দেশের একটা রাজ্যে।এবারও শুনছি তার ব্যতিক্রম হবে না। এটাই এই টুর্নামেন্টের আসল জয়। পৃথিবী ছাড়া কোথাও ফুটবল খেলাটা নেই আর ফুটবল ছাড়া কোনও খেলার জন্য রাখা নেই সাধারণ মানুষের এত ভালবাসা। জয় ফুটবল।
-এক অখ্যাত ইটালীয়ান।
(সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
Comments are closed.