উত্তরবঙ্গের সাতটি জেলার ৫৪টি বিধানসভা আসনের ভোট শুরু হয়েছে।  উত্তরবঙ্গ ছিল দীর্ঘ দিনের বাম ঘাঁটি। ১৯৭৭ সালের প্রথম বামফ্রন্টের সময় বিধানসভার অধিকাংশ আসনেই তাঁরা জেতে। সুজাপুরে জেতে কংগ্রেসের গনি খান চৌধুরী, হরিশ্চন্দ্রপুরে জনতা পার্টির বীরেন মিত্র। এছাড়া, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, গোয়ালপোখর, ইসলামপুর, করণদিঘীতে বামেরা জিততে পারেনি। পরবর্তী নির্বাচনে বামেরা তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল প্রতিষ্ঠিত হবার পর ২০০১ সালে করিমপুর আসনে আবদুল করিম চৌধুরী এবং ২০০৬ সালে দিনহাটায় অশোক মণ্ডল জেতেন। ২০১১ সালের প্রবল মমতা হাওয়াতেও বামেরা ১৬টি আসন পায়, কংগ্রেস পায় ১৭টি, তৃণমূল ১৬টি। উত্তরবঙ্গ সেভাবে কোনওদিন তৃণমূলের দখলে ছিল না। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সরকারি ক্ষমতায় তারা উত্তরবঙ্গে আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। বামেদের আসন কমে হয় ৯টি। তৃণমূল কোচবিহারের ৯টির মধ্যে ৮টি, আলিপুরদয়ারে ৫টির মধ্যে ৪টি, জলপাইগুড়িতে ৭টির মধ্যে ৭টি, দার্জিলিং-এ ‘মিত্র শক্তি’ গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ৩টি, উত্তর দিনাজপুরে ৯টির মধ্যে ৪টি এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে ৬টির মধ্যে ২টি আসন পায়। মালদহে তৃণমূল কোনও আসন পায়নি। ১২টির মধ্যে ৮টি পায় কংগ্রেস, একটি বিজেপি, বাকি সব বাম সমর্থিত (টেবিল ২)। পরে অবশ্য দল  বদলের নানান ঘটনায় পাল্টে যায় রাজনৈতিক শক্তি।

টেবিল ১ : উত্তরবঙ্গে জেলার আসন ভিত্তিক  ভোটের নির্ঘণ্ট

টেবিল ২ : ২০১৬ সালের নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী ,দল আর  জয়ের ব্যবধান

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন উত্তরবঙ্গ রাজনীতির সব কিছু উলট পালট করে দেয়। এক সময়ের অপ্রতিরোধ্য বামেরা একটি আসনেও এগিয়ে থাকতে পারেনি, কংগ্রেস এগিয়ে ছিল মাত্র দুটি আসনে। সুকৌশলে বিজেপি দখল নেয় ৪০টি আসনে, রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও তৃণমূল ১২টির বেশি আসনে এগিয়ে থাকতে পারেনি (টেবিল ৩)। এতদিন সরকারি কর্মীদের মধ্যে বামপন্থীদের বড় প্রভাব ছিল, ২০১৯ সালের নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রভাব যে যথেষ্ট দুর্বল, তা স্বীকৃত। টেবিল ৪ থেকে স্পষ্ট, নির্বাচনী কাজে নিযুক্ত সরকারি কর্মীরা বিজেপিকেই চাইছেন। উত্তরবঙ্গ লোকসভার ৮ টির মধ্যে সাতটিতেই, পোস্টাল ব্যালটে বিজেপি এগিয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রায়গঞ্জ ছাড়া বাংলার সর্বত্র গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সর্বাধিক পোস্টালব্যালট ভোট পায়।

টেবিল ৩ : ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা আসনে তৃণমূল, বিজেপি’র ফলাফল

টেবিল ৪ : উত্তরবঙ্গে পোস্টাল ব্যালট( লোকসভা ভোট অনুযায়ী )

উত্তরবঙ্গে সংখ্যালঘু প্রভাব

শেষ লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী বিজেপি বিরোধী দলের কাছেই গেছে। উত্তর দিনাজপুরে চোপড়া, গোয়ালপোখর, ইসলামপুর, ইটাহারে   মুসলিম ভোট গেছে তৃণমূলে, মালদায় ভোট ভাগ হয়েছে কংগ্রেস এবং তৃণমূলের মধ্যে। সুজাপুরে (যেখানে কালিয়াচক ব্লক গুলি আছে), চাঁচলের মুসলিম ভোট পেয়েছে কংগ্রেস, রতুয়া আর হরিশ্চন্দ্রপুরের মুসলিম ভোট পেয়েছে তৃণমূল। মানিকচক, ইংলিশ বাজারে কংগ্রেস ও তৃণমূলে ভোট ভাগাভাগিতে এগিয়ে গেছে বিজেপি। ইসলামপুরে জনসখ্যার ৭১ শতাংশ মুসলিম, তবুও বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে ভোটের ব্যবধান ছিল মাত্র চার হাজার। বিজেপি প্রদত্ত ভোটের ৩৫ শতাংশ পায় ইসলামপুরে, ৪২.৮% ভোট পায় হেমতাবাদে, ৪১.৩% পায় করনদীঘিতে, ইংলিশ বাজারে ৬১.৫%, মানিকচকে ৪৩.৩% ভোট পায়। এটা স্পষ্ট ,উত্তরবঙ্গে সংখ্যাগুরু ভোট এক কাট্টা হয়েছে, মুসলিম ভোটের কিছু অংশও বিজেপিতে আসতে শুরু হয়েছে। আর তাতেই ২০২১ সালে উত্তরবঙ্গে বিজেপি অপ্রতিরোধ্য। এবারও ৫৪ আসনে বিজেপি ৪০ এর উপর আসন পেলে অবাক হবার কিছু নেই।

টেবিল ৫: উত্তরবঙ্গে যে সমস্ত ব্লকে সংখ্যালঘু  মুসলিমরা জনসংখ্যার অনুপাতে  ৩০% এর বেশি (২০০১ আদমশুমারি অনুযায়ী)