রাজ্যপাল-ঘটিত, রাজ্যপাল-কথিত বিতর্ক আর তেমন নতুন নয় আমাদের কাছে। রোজই কিছু না কিছু হচ্ছে এই রাজ্যে এবং তার পাল্টা যে ধরণের কথা, আচরণ সাধিত হচ্ছে তা তো গৌরবের নয়ই, বরং খুবই হাস্যকর। পরিবারের এমন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ থাকেন, যার মতামত আছে কিন্তু সংসারের কাজে সে মতামত ব্রাত্য।  পারিবারিক বিবাদে তিনি মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন সে কমবয়সীরা তার কথা শুনুক বা না শুনুক। আবার অনেক পরিবারে কিছু বয়স্ক পিতৃতুল্য মানুষ যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলে পিসেমশাই-সুলভ আচরণও করেন। নালিশ আর দোষারোপ চলতেই থাকে। কথায় কথা বাড়ে আর অশান্তিও লেগে থাকে কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমাদের দেশে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির দশা পরিবারের ওই বয়োজ্যেষ্ঠ বা পিসেমশাইয়ের মতো। তাঁদের পক্ষপাতিত্ব কখনও আলোর মতো স্পষ্ট। কখনও রেখে ঢেকে খাবার পরও গোঁফে সর লেগে থাকে… তাই বিতর্ক রোজই… এবার এই রাজ্যে নয়। বিতর্ক শুরু হয়েছে কেরলে।

কেরলে রাজ্যপালের পণপ্রথা বিরোধী প্রস্তাব নিয়ে হইচই হচ্ছে আমাদের রাজ্যে যেমন হয়ে থাকে প্রতিদিন। বিরোধীরা সরব হয়েছে পণ দেওয়া নেওয়ার বিরুদ্ধে। বিজয়ন সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে নানা ধরণের। এই কুপ্রথা প্রশমনের উপায় হিসেবে এক অভিনব প্রস্তাব দিয়েছেন সে রাজ্যের রাজ্যপাল, আরিফ মহম্মদ খান। শিক্ষার্থীরা যদি ভবিষ্যতে পণ নিয়ে বিয়ে করেন তাহলে তাদের ডিগ্রি বাতিল হয়ে যাবে। বেশ কড়া প্রস্তাব। এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। এইবার অন্তত এটুকুই বলার যে বিতর্ক যেন টিভির সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠানের ঘেরাটোপে আটকে না থাকে। যেন সত্যিই ইতিবাচক কিছু হয়। একদিনের প্রতীকী অনশন করেছেন আরিফ মহম্মদ খান। অন্যদিকে রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ডেকে আলোচনার সময়ে তাঁর এই প্রস্তাব পেশ করেছেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বা শংসাপত্র দেওয়ার সময় ছাত্রদের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হোক যে তাঁরা কোনওভাবেই পণ দেওয়া ও নেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকবেন না। যদি কারও বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তার ডিগ্রি বাতিল হবে। প্রস্তাব শুনে আপাতভাবে মনে হয়, ‘হোক তাই’।

আইনত তা সম্ভবপর হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খুনের অপরাধীর ডিগ্রিও কেড়ে নেওয়া যায় না। শিক্ষাগত যোগ্যতা খারিজ করার সংস্থান আইনে কীভাবে ঢোকানো সম্ভব? মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়ন রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কোনও সাফাই দেননি। তিনি ‘পিঙ্ক প্রোটেকশন প্রোজেক্ট’ চালু করার ব্যাপারেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। পণ বা গার্হ্যস্থ হিংসার ঘটনা ঘটলে থানায় অভিযোগ দায়ের করার ক্ষেত্রে যাতে সময় অপচয় না হয় এবং মহিলা পুলিশকর্মীরা যাতে খুব তাড়াতাড়ি তদন্ত শুরু করতে পারেন সে ব্যাপারে জোর দিয়েছে রাজ্যের বাম সরকার। নজরদারির জন্য থাকবে ‘পিঙ্ক পেট্রোল’ এবং সমস্ত জেলায় থাকবেন এক জন করে পণ প্রতিরোধ আধিকারিক। এসব ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র কার্যকরী হোক অবিলম্বে।

কেরলে যদি পণ প্রথা নিয়ে এই সমস্যা হয় তাহলে সমগ্র ভারতের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। উচ্চশিক্ষিত এবং কম শিক্ষিত উভয় শ্রেণীর মিল এসব ক্ষেত্রে ষোলো আনা। মনে আছে সেই বিচারকের কথা! কোর্টে যিনি ডিভোর্সের মামলায় মেয়েরা যাতে ন্যায় পায় তা নিয়ে রায় দিয়ে থাকেন, অত্যাচারিত মেয়েদের জন্য খোরপোষ ও অন্যান্য দাবি নিয়ে সম্যক ন্যায়ের কথা বলেন পেশাদারি জীবনে অথচ নিজের বাড়িতেই পুত্রবধূর ওপর অকথ্য অত্যাচারে সামিল হন কিংবা সব দেখেও চুপ থাকেন। ক্রমাগত পণের জন্য চাপ দেওয়া হয় তাঁর বাড়ির গৃহলক্ষ্মীর ওপর। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ!

২০০৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে পণের কারণে মহিলাদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান

*তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো।

আর কদিন পরেই নবরাত্রি, দুর্গাপূজা নিয়ে কত হইচই হবে, দেবীর মাহাত্ম্য গুণগান, পুজো, আরতি, অঞ্জলি, উপোস সব হবে। হয়ে আসছে বহু বহু বছর ধরে অথচ দেবীর মর্যাদা রক্ষার প্রতি নিবেদিত প্রাণ এ সমাজ মানবীদের প্রতি চরম উদাসীন। মহিলাদের প্রতি হিংসা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে পুজোর জাঁকজমক আর সংখ্যা। কী চূড়ান্ত ভণ্ডামি পদে পদে। গত সত্তর বছর ধরেই মেয়েদের প্রতি হিংসার ঘটনা এই দেশে ক্রমশ বেড়েছে। এসব ঘটনাকে তুচ্ছ করে দেখা রাজনীতিবিদদের কাজ। মেয়েদেরকে ছোট করে নানা কথা তারা বলে থাকেন। সালিশি সভায় সবসময় মেয়েটির দিকেই আঙুল তোলা হয়। মেয়েদের পোশাক, আচরণ, ঘরে ও বাইরের তাদের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেন রাজনীতির কারবারিরা। একবার নয় বারবার। আরিফ মহম্মদ খান অতীতে যে দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সেই দলের নেতারা সিদ্ধহস্ত মেয়েদের নীচু চোখে দেখার প্রতিযোগিতায়। তাই কার প্রচেষ্টা কতটা সৎ তা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার জায়গায় মেয়েরা আছে কি? বিজয়নের বাম দল অবশ্যই প্রগতিশীল কিন্তু মহিলা প্রতিনিধিত্ব তাদের দলেই বা কতটুকু? সুতরাং বিতর্ক সরিয়ে রেখে অন্তত কাজের কাজটুকু হোক। থানা, পুলিশ, প্রশাসন নিজেদের কাজটুকু করুন, দল, মত, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি আমল না দিয়ে সুরক্ষার বাতাবরণ নিশ্চিত হোক। এটুকুই কাম্য।

গত ছয় দশক ধরে এই প্রথা নিষিদ্ধ এই দেশে। কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আজও পুরুষের মান ও দাম বাড়াতে সমাজে এইসব প্রথা দিব্যি চলে আসছে। গত পাঁচ বছরে কেরলের মতো রাজ্যেই ৬৬ জন মারা গেছেন আর ১৫,১৪৩ বার পণের জন্য মানুষকে লাঞ্ছনা করার ঘটনার অভিযোগ নথিভূক্ত হয়েছে। সমগ্র দেশে ২০১৯ সালে ৭ হাজারের বেশি মানুষ পণপ্রথার বলি হয়েছে। আমরা কি জাত, ধর্ম, লিঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষ হিসেবে দেখতে পারি এই সমস্ত মৃত্যুগুলোকে? সমাজে পুরুষের গুরুত্ব বেশি এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে পারব? সাম্যের ধারণা যেদিন প্রত্যেকের মনে প্রোথিত হবে সত্যের মতো, আলোর মতো সেদিন সমস্ত অন্ধত্ব, কুপ্রথা, ভেদাভেদ লোপ পাবে, ততদিন পর্যন্ত কঠোর আইন বলবৎ হোক। শাস্তি পাক অপরাধীরা। কেরলে হেল্পলাইনের নম্বর বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, হাসপাতাল ও অন্যান্য সামাজিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, যাতে দ্রুত সংবাদ এসে পৌঁছয় এবং ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কেরল সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন দেশের কাছে দৃষ্টান্ত রেখেছে, এ ব্যাপারেও কড়া পদক্ষেপ নিতে বিলম্ব করবে না এটুকু আশা রাখি।