ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় দেশের অনেকেই যখন ভেবেছিলেন করোনা বোধহয় এবার বিদায় নিচ্ছে, তখনই অনেকেরই অলক্ষ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সুনামির মতো আছড়ে পড়ে। সেই সময় আমাদের দেশে যখন করোনায় দৈনিক সংক্রমণের সাত দিনের গড় হিসেবে ছিল এগারো হাজার, তখন মে মাসের পাঁচ তারিখে তা বেড়ে সর্বোচ্চ চার লক্ষ বারো হাজারে গিয়ে পৌঁছয়। তবে এখন সংক্রমণ দ্রুত নামছে, এখন এই দৈনিক সংক্রমণের সাত দিনের গড় এক লাখের সামান্য বেশি। সংখ্যাটা যেভাবে কমছে তা দেখে মনে হয়, এই মাসেই অর্থাৎ জুন মাসেই এটা নতুন সর্বনিম্ন স্তরে চলে আসবে। পশ্চিমবঙ্গেও একই অবস্থা, করোনায় সংক্রমণের পরিসংখ্যান সর্বনিম্নস্তরে পৌঁছতে আর দেরি নেই, দিল্লি ইতিমধ্যেই সেই স্থানে প্রায় পৌঁছে গেছে। গোটা দেশের এবং পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লির প্রত্যহ নতুন সংক্রমণের রূপরেখা দিলাম নীচে।
চিত্র ১: ভারত- নতুন সংক্রমণের সাত দিনের গড় হিসেব

চিত্র ২: পশ্চিমবঙ্গ- নতুন সংক্রমণের সাত দিনের গড় হিসেব

চিত্র ৩: দিল্লি- নতুন সংক্রমণ, সাত দিনের গড় হিসেব

গোটা দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দু’কোটি মানুষ এবং মৃত্যুর সংখ্যা দু’লাখ। আর কিছু দিন করোনায় সংক্রমণের গতি একই থাকলে কি ধরনের প্রলয় হতে পারত, তা বুঝতে বোধহয় আমাদের কারোর অসুবিধে হচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে মানুষ করোনা বিধিতে আরও অভিজ্ঞ হওয়ায় এবং সেই সঙ্গে বয়স্কদের অনেকেই ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়ায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে এই মুহূর্তে অনেকটাই প্রতিহত করা গিয়েছে। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মাঝ বয়সীদের টার্গেট করে। ফলে দ্রুত সবাইকে ভ্যাকসিন না দিলে, তৃতীয় ঢেউ কিন্তু সব কিছু ওলটপালট করে দিতে পারে। ভাবা গিয়েছিল, সেপ্টেম্বর- অক্টোবরের মধ্যে দেশের ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলের টিকাকরণ হয়ে যাবে, ফলে তৃতীয় ঢেউ ডিসেম্বর মাস নাগাদ টিকা না-দেওয়া বাচ্চাদের দিকে এগোবে। বাচ্চাদের জন্য আলাদা টিকা তৈরী করা আর সেই সঙ্গে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলের কাছে টিকা পৌছানো এখন দেশের প্রধান কাজ ।
আর এই লক্ষ্যকে মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে নতুন জাতীয় টিকা নীতি ঘোষণা করেন গত ৬ জুন। স্বাস্থ্য রাজ্যের এক্তিয়ার ভুক্ত, আর সেই কথা ভেবে মে মাস থেকে রাজ্যের ওপর টিকা দেবার কিছু দায়িত্ব পড়ে। টিকা সংগ্রহের নানান অসুবিধার কথা উঠে আসে, মার খায় সার্বজনীন টিকাকরণ। চিত্র চারে পরিষ্কার দেশে গত মে মাসে টিকাকরণ কতটা কমেছে। ১৬ জানুয়ারি শুরু হয় টিকাকরণ প্রক্রিয়া। এপ্রিলের মাঝামাঝি দিনে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া গেছে, মে মাসের কোনও এক সময়ে এই সংখ্যাটা দিনে ১৫ লক্ষের নীচে নামে। এই অবস্থায় করোনার তৃতীয় ঢেউ রুখতে সমগ্র দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যবস্থাপনায় গণ টিকাকরণ ছাড়া বিকল্প ছিল না।
চিত্র ৪: দেশে দৈনিক করোনা টিকাকরণের হিসেব

অনেকেরই জানা নেই, একটা ডোজ টিকা নেওয়া মানুষের সংখ্যার নিরিখে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সবার আগে রয়েছে ভারত। কোনও সরকারই দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে মানুষকে সজাগ করেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম জন গননা হয় ১৯৫১ সালে, তখন জনসংখ্যা ছিল ৩৬ কোটি, আর এখন ১৩৬ কোটি। আর তাই পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষকে এক ডোজের টিকা দিয়েও জনসংখ্যার অনুপাতে তা খুবই নগণ্য। তাই লড়াইটা বেশ কঠিন।
চিত্র ৫: বিভিন্ন দেশে একটা ডোজ টিকা নেওয়া মানুষের সংখ্যা

চিত্র ৬ : জনসংখ্যার অনুপাতে যারা টিকা পেয়েছেন

দেশে এই মুহূর্তে তিনটি ভ্যাকসিন ভারত সরকারের ড্রাগস কন্ট্রোল দপ্তর দ্বারা অনুমোদিত। এছাড়া, ভারত সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) আর আমেরিকার ফুড এণ্ড ড্রাগস অ্যাডমিনিষ্ট্রেসন (এফডিএ) অনুমোদিত ভ্যাকসিন ভারতে ব্যবহারের নীতিগত অনুমতি দিয়েছে, লাইসেন্স ও জরুরি ভিত্তিতে দেওয়া হবে। তাই ফাইজার, মডারনা, জনসন এণ্ড জনসন যেকোনও সময়েই এসে পড়বে ।

দেশে ১৮ বছরের বেশী বয়সীদের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। তৃতীয় ঢেউ আসার আগেই, অর্থাৎ আগামী আগস্ট সেপ্টেম্বরে আমাদের ২০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে। সেটা কি পাওয়া যাবে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘ডিফেন্স প্রোডাকশন অ্যাক্ট’ লাগু করায়, ভ্যাকসিনের কাঁচামাল প্রস্তুতকারকরা সেদেশের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারীদেরই দিতে বাধ্য থাকত। তবে কোভিশিল্ড উৎপাদনে বিশেষ ছাড়ের কথা ঘোষণার ফলে এই ভ্যাকসিন ভারতে উৎপাদনে আর বাধা নেই। সরকারি তথ্য অনুযায়ী দেশে ছয়টি প্রধান ভ্যাকসিন নির্মাতা সংস্থার এই বছরের শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষমতা জানিয়ে রাখলাম। দেশে এই মুহূর্তে ২০২১-এর শেষ পর্যন্ত ২০০ কোটির বেশি ভ্যাকসিন তৈরীর ক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া অনেক প্রস্তুতকারক সংস্থা ট্রায়ালের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এখন প্রশ্ন, ১০০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার কাঠামো আমাদের আছে কি? এপ্রিলের মাঝামাঝি আমরা সর্বাধিক দিনে ৩৫ লক্ষ টিকা দিয়েছিলাম, সেই ধারায় মাসে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব। দেশে টিকা প্রয়োগের সর্ব শক্তি এতে নিয়োজিত হয়েছে বলে মনে হয় না। দেশের সামরিক শক্তি আর বেসরকারি উদ্যোগকে ব্যপক ভাবে কাজে লাগালে, ডিসেম্বরের মধ্যে সার্বজনীন টিকাকরণ অসম্ভব নয়।

ভারত বায়োটেক আপাতত বিবিভি ১৫৪ নামে একটি ইন্ট্রানাসাল করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছে। বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা সেল জানাচ্ছে, নাকের মধ্য দিয়েই মূলত করোনা ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে, প্রতি নাকে এক ফোঁটা ড্রপ দিলেই করোনা থেকে দূরে থাকা যাবে। অল্প বয়সীদেরও এই টিকা দেওয়া যাবে। এই টিকার ট্রায়াল চলছে। বৈজ্ঞানিক ভাবে সফল হলে এই টিকা ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় রোগ থেকে মানুষকে অনেকটা নিষ্কৃতি দেবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, দেশে ৭৫% টিকা বিনামূল্যে দেওয়া হবে। আর বাকি ২৫% বেসরকারি স্বাস্থ্য, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেবে সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট দামে। ৩ নম্বর টেবিলে আমরা সেটি তুলে ধরলাম।

টিকাকরণে এবার রাজ্যগুলির কি অবস্থা একটু দেখা যাক। ভারতের সাতটি রাজ্যে এক কোটির বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ এর টিকা দেওয়া হয়েছে। লাদাখ ও লাক্ষাদ্বীপ এই দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে প্রায় ৫০% মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছেন। হিমাচল, কেরল, গোয়া, ত্রিপুরা, সিকিম, চণ্ডীগড়, আন্দামান, মিজোরাম, দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ করোনার টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন।
টেবিল ৪ : ভারতের রাজ্যগুলির টিকাকরণ, ৯ জুন সকল ৭টা পর্যন্ত


দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ রুখতে সার্বজনীন টিকাকরণ খুব জরুরি। সরকার এক ব্যাপক উদ্যোগে সামিল হয়েছে। রাজনীতি বিদ্বেষ ভুলে আমাদের সকলকে এই কর্মযজ্ঞকে সাফল্যমণ্ডিত করতেই হবে।
Comments are closed.