পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে সিপিআইএম তরুণ প্রজন্মকে সামনে রেখে লড়াইয়ে নেমেছে। গত দশ বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে রাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। বামেরা এই নির্বাচনে সেটাকে কাজে লাগাতে চাইছে। তরুণ প্রজন্মকে সামনে রেখে নিজেদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মানুষ কি এত সহজে এই ১০ বছরের আগের ৩৪ বছরের কথা ভুলে যাবে?
একজনকে খুন করলে খুনী, বহুজনকে খুন করলে রাজা, সবাইকে খুন করলে ঈশ্বর। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটচিত্রে প্রবাদটি মর্মান্তিকভাবে সত্যি। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএম ক্ষমতার সিংহাসনে ছিল ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। ’৭৭ সালে কংগ্রেস সরকারের অহঙ্কার, গর্বিত ক্ষমতার দাপট, জরুরি অবস্থার নিষ্পেষণে বাংলা যখন প্রাণপণে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাইছে তখন মানুষ বহু আশা নিয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে বামফ্রন্টকে সাদরে বরণ করে এনেছিল। কে জানত, তারা উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে লাফিয়ে পড়ল! সরকারিভাবে স্বীকৃত পরিসংখ্যানের দিকে একবার তাকিয়ে দেখি আমরা।
১৯৯৭ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (যিনি পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০০০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত) বিধানসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন ১৯৭৭ (যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে) থেকে ১৯৯৬, এই ১৯ বছরে পশ্চিমবঙ্গে ২৮,০০০ রাজনৈতিক হ্ত্যা ঘটেছে। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি মাসে ১২৫.৭ টি হত্যা ঘটেছে। দিনের হিসাবে দৈনিক চারটি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ এই ১৯ বছরের সময়কালে প্রতি ছয় ঘণ্টায় (গড়ে) একটি রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ এর মধ্যে বাৎসরিক রাজনৈতিক হত্যার হার দাঁড়ায় গড়ে ১৪৭৩। ১৯৭৭ সালে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন রাজনৈতিক হত্যার এই বিশাল পরিসংখ্যান স্বীকারের জন্য। স্বভাবতই সতর্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিসংখ্যান বদলে দিলেন যা সরাসরি বাতিলযোগ্য অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যার থেকে অনেক কম।
একটি বামপন্থী সাপ্তাহিক, মেইনস্ট্রিম (Mainstream) জানিয়েছে- “নয়ের দশকের শেষদিক থেকে সিপিআইএম দাবি করত পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটাতে তারা আরও অনেক বেশী দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে। সিপিআিএম-এর বর্ধিত দক্ষতার ফলশ্রুতিতে তাদের কৃত হত্যার হার স্বভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৬ এর মধ্যে বাৎসরিক রাজনৈতিক হত্যার হার দাঁড়ায় গড়ে ১৪৭৩। ১৯৭৭ সালে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন রাজনৈতিক হত্যার এই বিশাল পরিসংখ্যান স্বীকারের জন্য। স্বভাবতই সতর্ক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিসংখ্যান বদলে দিলেন যা সরাসরি বাতিলযোগ্য অর্থাৎ প্রকৃত সংখ্যার থেকে অনেক কম। ১৯৯৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ঘটা রাজনৈতিক হত্যার মোটামুটি একটা বিশ্বাসযোগ্য সংখ্যা নির্ধারণে আমরা ধরে নিচ্ছি হত্যার বাৎসরিক গড়সংখ্যা ২২৮৪, অর্থাৎ মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭,৪০৮। এই হিসাবে ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মোট হত্যার সংখ্যা ২৮,০০০ + ২৭,৪০৮ = ৫৫,৪০৮। গড়ে বৎসরে ১৭৮৭, মাসে ১৪৯ এবং দৈনিক পাঁচটি। অন্যভাবে বললে, পশ্চিমবঙ্গে প্রতি চার ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটে রাজনৈতিক কারণে একজন মানুষ খুন হয়েছেন। সিপিআইএম এই কৃতিত্ব দাবি করতেই পারে যে, ঘণ্টায় একটি খুনের পরিবর্তে তারা সংখ্যাটাকে সীমিত রেখেছিল প্রতি চার ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিটে একটি খুন করায়। কী অভূতপূর্ব কীর্তি!
২২ শে আগস্ট ২০১০-এ বামপন্থী সাপ্তাহিক মেইনস্ট্রিম নিজেই একথা প্রকাশ করেছে একটি প্রবন্ধে, লেখক ডি বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের প্রথম ৩২ বছরে অর্থাৎ ১৯৭৭ থেকে ২০০৯ সময়কালে কমপক্ষে ৫৫,০০০ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়।
কোন অপরাধমূলক কাজকে বিচার করা যেতে পারে তার পিছনের উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে। রাজনৈতিক অপরাধ সংঘটিত হয় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা রাজনৈতিক মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। অপরাধটি হতে পারে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং অপরাধমূলক কাজের যৌথ ফল, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির অত্যাচার এড়াতে ঘটানো অপরাধমূলক কাজ। সহজ কথায় খুনের ঘটনা ঘটে ব্যক্তিগত লাভ, লোভ বা প্রতিশোধের কারণে। রাজনৈতিক হত্যা ঘটে রাজনৈতিক লাভ, বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অথবা বিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য।
উপরের পরিসংখ্যানের বিচারে একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে, সিপিআইএম কোনও উচ্চ আদর্শে আর বিশ্বাস করে না, তারা আঁকড়ে ধরেছে হিংসার পথ, সংগঠিত ভাবে মানুষ হত্যাকে প্রয়োগ করে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে। গণতন্ত্র বলতে তাদের ধারণায় শতকরা ১০০ জন মানুষের সমর্থন। কখনও যদি একটিমাত্র বিরোধী মুখ কিছু বলতে চায়, তৎক্ষণাৎ তার শিরচ্ছেদ করে প্রমাণ করে ১০০ শতাংশ মানুষই তাদের সমর্থন করে। মার্কসবাদ পরিত্যক্ত, এখন পুঁজিবাদই তাদের আরাধ্য মন্ত্র।
কৃতজ্ঞতা : ডি বন্দ্যোপাধ্যায়।
Comments are closed.