কুন্দন শাহের মৃত্যুর খবরটা শুনেই মনে হচ্ছিল যে ছবিটার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন সেটা একটা প্রহসন… প্রথম ছবিই ছিল ‘জানে ভি দো ইয়ারোঁ’ আর তাতেই অসাধারণ মুন্সিয়ানা দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই পরিচালক। প্রহসন, ব্যঙ্গ এই ধরণের সৃষ্টি খুবই কঠিন ব্যাপার। তাই তো সুকুমার রায় এত মহান আর চন্দ্রবিন্দু (গানের দল) বাকিদের থেকে আলাদা।
আসলে ছাপোষা মানুষের জৌলুসহীন জীবনের জটিলতা নিয়ে মজা করার নামই রসিকতা। সাধারণ মানুষের জীবনটা তেমন সাজানো গোছানো হয় না তাই সেসব অসঙ্গতি থেকেই রসিকতার জন্ম নেয়। তবে সবাই তেমন রসিকতা করতে পারে না। মজা জিনিসটা অনেকটা মিঠে রোদের মতো, রোদের তাপ বাড়লেই যেমন মিষ্টত্ব চলে যায়, তেমনি জোর করে হাসাবার চেষ্টা করলেই বিরক্তি চলে আসে। হাস্যরসের কত প্রকারভেদ- নির্ভেজাল রসিকতা, প্রহসন, ব্যঙ্গ।  ‘জানে ভি দো ইয়ারো’ তখন নাকি বক্স অফিস পায়নি! এই ছবি সর্বকালের সেরা প্রহসনগুলোর মধ্যে একটা, মানুষ কিন্তু আজও ভালোবাসে এ’ছবি, কিন্তু চলেনি কেন কেউ জানে না। শ্রী শাহের টিভি ধারাবাহিক ‘ওয়াগলে কি দুনিয়া’ কিংবা ‘নুক্কড়ের’ কথা মনে পড়ে গেলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়… টিভি সিরিজে তখন হাসানোর জন্য ছেলেদের মেয়ে সাজানো হত না,  চড়া দাগের মেক-আপ, স্থূল সংলাপ, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি আর কাতুকুতু দিয়ে জোর করে হাসানোর মতো ঘটনাও ঘটত না, আর দর্শকদের হাসির বদলে বিরক্তিও আসত না, আর হাসি নাও পেতে পারে এমন অনিশ্চয়তায় ভুগে স্ট্যান্ড-আপ তামাশার শেষে হাসির আওয়াজের রেকর্ডও চালিয়ে দেওয়াও হত না, আসল হাসির বিকল্প হিসেবে। হাসির মধ্যে একঘেয়েমি ব্যাপারটা তখনও ছিল না। রোজকার জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলোই উপস্থাপনা, অভিনয় আর পরিচালনার গুণে মন জয় করত, সেই হাসি-মজায় সরলতা, স্বাভাবিকতা ছিল। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ছবিগুলিতেও যেমন একটা ফুরফুরে ভাব থাকত। তাই আজও সেসব ছবির একই দৃশ্য বারবার দেখেও হেসে ফেলি।
এ’বছর ‘বরেলি কি বরফি’, ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’ দেখে এ’দেশে কমেডি ছবির সার্বিক চিত্রটা নিয়ে ভাবছিলাম। ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম কারণ, ভালো লেগেছিল দুটি ছবিরই অনেকগুলি দিক। সেক্সিট জোক-বিহীন, রঙ, চেহারা, ভাষা নিয়ে পরিহাস-হীন, নির্ভেজাল মজা, খিলখিল হাসি দিয়ে দর্শককে আমোদিত করতে সাহস আর দক্ষতা প্রয়োজন। জানতে হয় কেমন করে সর্বসমক্ষে বলতে না-পারা কথাও পরিবেশনের গুণে হাস্যরস তৈরি করতে পারে আর সেটাই শিল্পে আর স্থূলতায় ফারাক করে দেয়। তাই অনেক কিছু ভালোর মধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিস (ক্লাইম্যাক্সে এবং অ্যান্টিক্লাইম্যাক্সে একটু বাড়াবাড়ি, যেমনটা রয়েছে ‘শুভ মঙ্গল সাবধান’ আর ‘বরেলি কি বরফিতে’) থাকলেও ছিদ্রান্বেষীর মতো শুধু সেটুকু তুলে ধরে পরিচালকের মুন্ডুপাত করার ইচ্ছে মোটেও হয়নি।
একদিকে যেমন সবসময়ই ‘বিবি নং ওয়ান’, ‘রাজাবাবু’, ‘জুড়ুয়া’, ‘গোলমাল’, ‘মস্তি’, ‘গ্র্যান্ড মস্তি’, ‘কেয়া কুল হ্যায় হাম’, ‘ধামাল’, ‘নো এন্ট্রি’, ‘ওয়েলকাম’, ‘হাউসফুল’ ইত্যাদি টিপিক্যাল ছবি  বা আদিরসাত্মক সেক্স কমেডি থাকবে অন্যদিকে তেমনি ‘পুষ্পক’, ‘পিপলি লাইভ’ ‘মুন্নাভাই সিরিজ’, ‘ভিকি ডোনর’, ‘বরফি’, ‘ভেজা ফ্রাই’, ‘বরেলি কি বরফি’ও, থাকবে। প্রিয়দর্শনের ঘরানার সঙ্গে রাজকুমার হিরানিও থাকবেন। বড় বড় স্টারেদের বিগ বাজেটের স্ল্যাপস্টিক কমেডির সঙ্গে কম বাজেটের ব্ল্যাক কমেডি (নিউটন)ও থাকবে। গোবিন্দা ছিল আবার রাজকুমার রাও থাকবেন।
bareilly ki barfi
‘বরেলি কি বরফি’র পোস্টার।
বিষয়, বাণিজ্য আর বিনোদন এই তিন ‘ব’ মাথায় রেখে পরিচালককে চলতে হয় জানি কিন্তু সুস্থ-রুচির দর্শকদের ভালো লাগে যখন কোনও পরিচালক এই তিন ‘ব’ এর মধ্যে ব্যালান্স করে চলতে পারেন। আবার এও ভালো লাগে যখন নতুন কোনও পরিচালক একটু ঝুঁকি নেন আর মা লক্ষ্মীর কৃপাও পান একই সঙ্গে, মনে হয় এই দেশে দর্শকের প্রাপ্তমনস্কতা একটু হলেও তো অগ্রসর হল। হাসির নামে স্থূল ভাঁড়ামো আর যৌনতাপূর্ণ অশ্লীল রসিকতার বাইরের হাস্যরসের কথাই চিরকালের শ্রেষ্ঠ রসিক মানুষরা বলে গেছেন।
 তবে আক্ষেপ হয় এখন বাংলায় সুস্থ হাসির ছবি এত কম কেন এই ভেবে। শেষ এমন ছবি পেয়েছিলাম ‘ভূতের ভবিষ্যত’ আর ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ তাও আবার একই পরিচালকের কাছ থেকে। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রজাপতি বিস্কুট’-এও হাস্যরসের ধরণ ও পরিবেশন হতাশ করেছে – উত্তরণের সুযোগ ছিল কিন্তু হয়নি। ‘নিউটন’ এর মতো ব্ল্যাক কমেডি কি হতে পারে না এখানে? কম বাজেটে কি অসাধারণ নির্মাণ। এখানকার জঙ্গল মহলের প্রেক্ষাপটে দিব্যি খাপ খেয়ে যায় এ ছবির গল্প। আমরা এখন এমন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেখানে পদে পদে অসঙ্গতি এবং দ্বিচারিতা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিউমার; এমন সময়েই তো হতে পারে দুর্দান্ত প্রহসন। আমাদের ভাবনার দীনতা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ‘বাই বাই ব্যাংকক’, ‘কেলোর কীর্তি’, ‘জিও পাগলা’, ‘কাঠমুন্ডু’, ‘দেখ কেমন লাগে’ যেমন এক শ্রেণির দর্শকের কথা মাথায় রেখে বানানো হয়, তেমন আর এক শ্রেণির দর্শকও তো আছে যাদের ঘুরে ফিরে ইউ-টিউবে সেই ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ‘শ্রীমান পৃথ্বিরাজ’, ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘ধন্যি মেয়ে’ কিংবা ‘মহাপুরুষ’ দেখতে হয়।